- ইকতেদার আহমেদ
- ১২ জুলাই ২০২১
বাংলা ভারত উপমহাদের অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল। বাংলায় মূলত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে বাংলা পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সৌম্য, বজ্র, তাম্র্রলিপ্তি, সমতট, বঙ্গ প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল। এ জনপদগুলোর প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ও পৃথক ছিল। শশাঙ্ক ও লক্ষ্মণ সেন এ জনপদগুলো একীভূত করার চেষ্টা করলেও তারা কেউ সফল হননি। মোগল শাসন পূর্ববর্তী বাংলা কখনো এককভাবে একজনের শাসনাধীন ছিল না। মোগল সম্রাট আকবর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা সমন্বয়ে সুবাবাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আলীবর্দি খাঁকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। আলীবর্দি খাঁর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা সুবাবাংলার শাসনভার লাভ করেন।
পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরভূত করে ইংরেজরা এ উপমহাদেশে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তন করে; যা পরবর্তী সময়ে এক শ’ বছরের ব্যবধানে দিল্লি দখলের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায়। ইংরেজ আমলে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত বাংলা পূর্ণতা পায় যদিও এটি মোগল প্রবর্তিত সুবাবাংলার খর্বকৃত রূপ।
বাংলায় বিগত এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠী পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের মাধ্যমে বসবাস করে আসছিল। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা প্রথমত বাংলা ও পরবর্তী সময়ে পুরো ভারতের শাসনক্ষমতা দখলের আগে উপমহাদেশে কখনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশদের চিরাচরিত নিয়ম বিভাজন ও শাসনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগ পূর্ববর্তী বাংলায়ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হিংস্র্ররূপ পরিলক্ষিত হয়।
ইংরেজরা মুসলিম শাসককে পরাভূত করে বাংলার শাসনক্ষমতা লাভ করায় এ অঞ্চলে তাদের আগমনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে বাংলায় বসবাসকারী অপর ধর্র্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্রিটিশদের আনুকূল্য পেতে থাকে। এতে করে পূর্ব থেকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ মুসলমানরা এ অঞ্চলে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। এর ফলে দেখা যায়, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলায় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন ইংরেজ শাসকরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় যে, একই জাতিভুক্ত মুসলিমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সব ক্ষেত্রে অনগ্রসর; তখন তারা অনেকটা মুসলমানদের দাবির মুখে অনগ্রসর মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের হিন্দুদের সমকক্ষ বা কাছাকাছি নিয়ে আসার মানসে বাংলাকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলার এ বিভাজন ১৯০৫ সালে কার্যকর হয় এবং এ বিভাজনের ফলে পূর্ববাংলা আসাম সমন্বয়ে একটি পৃথক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে একজন ল্যাফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। এ বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলিমদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এ বিভাজন মেনে নিতে পারেননি। তাই বিভাজন-পরবর্তী এ বিভাজন রদ করতে তারা চূড়ান্ত আন্দোলন করেন।
বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার সাহিত্যাঙ্গনের পুরোধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, ক্ষোভ ও দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাংলার প্রতি ভালোবাসার অভিব্যক্তিতে বঙ্গভঙ্গের বছরই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা করেন। আমার সোনার বাংলা গানটি বাংলার অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার নিমিত্তে রচিত। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস গানটি খণ্ডিত বাংলার অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বাংলাদেশের মানুষের এ উদারতা কি এক জাতিসত্তার ভিত্তিতে একক দেশ বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথের আকাক্সিক্ষত পূর্বের অখণ্ডতা ফিরিয়ে দিতে পারবে?
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একই ভাষাভাষী এবং একই জাতিগোষ্ঠী কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভিত্তিতে আবার কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত। ভারতবর্ষভুক্ত বাংলা ও পাঞ্জাব ভারত বিভাজনের সময় ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভাজিত হয়। এরপর দেখা যায় ভারতভুক্ত পাঞ্জাব পুনরায় হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য বিশিষ্ট অঞ্চল নিয়ে পুনর্বিভাজিত হয়।
পৃথিবীর যে সব রাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে বিভাজিত হয়েছিল এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে জার্মানি, ভিয়েতনাম ও কোরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মিত্রশক্তির বিজয়ের পর পরাভূত জার্মানিকে বিভাজিত করে এর এক অংশ পশ্চিম জার্মানি নাম ধারণ করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। অপর অংশ পূর্ব জার্মানি নাম ধারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনুসারী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রভুক্ত হয়। জার্মানির এ রাজনৈতিক বিভাজন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে উভয় জার্মানি একীভূত হয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির মতো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবে ষাটের দশকে ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এ দু’টি নামে বিভক্ত হয়ে দু’টি পৃথক রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু সে বিভাজনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মার্কিন মদদপুষ্ট পুঁজিবাদের সমর্থক উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্টপন্থী দক্ষিণ ভিয়েতনামের কাছে পরাভূত হলে উভয় ভিয়েতনাম একীভূত হয়। বর্তমানে একীভূত ভিয়েতনাম এশিয়ার সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। ’৫০-এর দশকে রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে কোরিয়া দ্বিধাবিভক্ত হলেও আজ অবধি সে দ্বিধাবিভক্তি অক্ষুণ্ন থাকায় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামে রাষ্ট্র দু’টি যথাক্রমে কমিউনিস্ট ও পুঁজিতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুসরণ করে চলছে।
বঙ্গভঙ্গ রদ-পরবর্তী তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা পূর্ববাংলার মুসলমানদের রদের ক্ষতিগ্রস্তের সান্ত্বনাস্বরূপ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। কিন্তু এ ঘোষণার পর দেখা গেল, পশ্চিম বাংলার হিন্দু কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকেন। কিন্তু বিভাজন ও শাসনের নীতিতে পারঙ্গম সুচতুর ব্রিটিশদের তাদের এ আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ থেকে সরে আসার অবকাশ সৃষ্টি করেনি। ব্রিটিশরা তাদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যায়। ধারাবাহিকতায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
আমাদের আজকের বাংলাদেশের ভিত রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে। সেই ধর্মীয় জাতিসত্তার অনুসরণে ভারত বিভক্তির সময় পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক এবং পৃথক জাতিসত্তার কারণে পরবর্তী সময়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত যেভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল, পরবর্তী সময়ে দেখা গেল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ভারত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সেভাবে এগিয়ে আসেনি।
দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অল্পস্থান ছাড়া বাংলাদেশ পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম সীমান্ত স্থলে ভারত দিয়ে বেষ্টিত। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে বিপুলসংখ্যক বাংলা ভাষাভাষীর বাস। বাংলাদেশের স্থল সীমানার অপর অংশের বেশির ভাগ জনগণ একই জাতিসত্তাভুক্ত হওয়ার কারণে, প্রাচীনকাল থেকেই উভয় অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক লেনদেন অব্যাহত ছিল। এর ধারাবাহিকতায় উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য অব্যাহত থাকে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা রয়েছে তা শতভাগ কার্যকর করা গেলে উভয় দেশের অর্থনীতি যে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশ ঢাকার প্রতিকূলে ভারসাম্যহীনভাবে ভারতের সাথে সম্পাদিত হচ্ছে। ভারতের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্যকে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে সমতার পর্যায়ে আনা গেলে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি সম্ভাবনার দেশে পরিণত হবে সে বিষয়টি অনুধাবন করে বাণিজ্যবৈষম্য দূর করতে ভারতের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেখা গেছে, যখনই বাংলাদেশের কোনো পণ্য গুণ ও মানে উৎকর্ষতা ও প্রতিযোগী মূল্যের কারণে ভারতের বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করছে; ঠিক তখনই অশুল্ক বাধা আরোপের মাধ্যমে পণ্যের দাম এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে একদিকে ভারতের আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, অন্যদিকে পণ্যের দাম সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর প্রশ্ন আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিকদের দাবি অনুযায়ী ভারত আমাদের সৎ প্রতিবেশী হয়ে থাকলে কেন দীঘর্ দিন ধরে স্থল ও সমুদ্রসীমানা বিরোধ পারস্পরিক মতৈক্যের ভিত্তিতে নিরসন হচ্ছে না, কেন অসম বাণিজ্যবৈষম্য দূরীকরণে ভারতের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না, কেন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অবমাননাকরভাবে আমাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, কেন আমাদের স্থল সীমান্তের চার পাশে ১৩২টি মাদকপর্যায়ভুক্ত ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করে মাদকের চালান প্রবেশে উৎসাহিত করা হচ্ছে, কেন অভিন্ন নদীর সুষম পানির হিস্যা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, কেন অযৌক্তিকভাবে শুল্ক ব্যতিরেকে আমাদের কাছ থেকে স্থল ট্রানজিট দাবি করছে এবং কেন নেপাল ও ভুটানের সাথে সম্পাদিত আমাদের স্থল ট্রানজিট চুক্তি কার্যকর হতে দিচ্ছে না?
ভারত বরাবরই দাবি করে আসছে, আমাদের এ দেশ থেকে অহরহ তাদের দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে। পাচারকারীরা ভারত থেকে অবৈধভাবে গরুসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এ যুক্তিতে প্রায়ই ভারতের সীমান্তরক্ষীর গুলিতে বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিক হত্যা করা হচ্ছে। ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা যে পণ্যটি আমাদের অর্থনীতি ও যুবসমাজের ব্যাপক ক্ষতি করছে সেটি হচ্ছে মাদক পর্যায়ভুক্ত ফেনসিডিল। কিন্তু বিগত ৪০ বছরে ভারত কি একটি উদাহরণ দেখাতে পারবে, ভারত থেকে বাংলাদেশ ফেনসিডিল পাচার করতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিহতের ঘটনা ঘটেছে।
ভারত বিভাগের সময় পূর্ববাংলায় কোনো কলকারখানা না থাকায় এ অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ছিল। তা ছাড়া বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত যে অঞ্চল নিয়ে পূর্ববাংলা গঠিত এর এককভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ছিল না। যে কারণে অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসাম ছাড়া পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জনগণের কঠোর পরিশ্রমে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিতে প্রভূত অগ্রতি হয়েছে। আমাদের এ অগ্রগতিতে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের উল্লসিত হওয়ার কথা। বাস্তবে আমরা কি সে ধরনের কোনো উল্লøাস দেখছি, না বিপরীতধর্মী কিছু দেখছি; তা দু-চারটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করলে স্পষ্ট হবে।
আমাদের দেশে ভারতের ৪০টিরও বেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার অব্যাহত আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের দু’ডজনেরও বেশি টিভি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও এখনো আমাদের একটি চ্যানেলকেও সে দেশে সম্প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়নি। ভারতের এ মনোভাব ইঙ্গিত দেয় আকাশ সংস্কৃতি দিয়ে আমাদের যুবসমাজকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে সক্রিয়। ভারতের সাধারণ জনগণ আমাদের চ্যানেলের সম্প্রচারের পক্ষে। কিন্তু বাদ সাধছে সেখানকার রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা।
বাংলাদেশের ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর পশ্চিম বাংলার সংখাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তেমন উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়নি যেমনটা আমরা বাংলাদেশে দেখেছি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালগিষ্ঠ ভেদে এ দেশের সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপর বাঙালি অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে গোটা বাংলাদেশের মানুষ যখন শোকে মুহ্যমান তখন একই ভাষাভাষী পশ্চিম বাংলার প্রচার মাধ্যমসহ শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নিরুদ্বেগ আচরণ আমাদের জন্য পীড়াদায়ক।
আমাদের এ ভূ-ভাগসহ বর্তমানে পৃথিবীতে ধর্মের প্রভাব রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে এত প্রকট যে, ধর্মকে বাদ দিয়ে কোনো জাতির পৃথক অস্তিত্ব কল্পনায় আনার অবকাশ নেই। এ ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই এ দেশ খণ্ডিত এবং বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরও আশা থাকে- পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে অবলুপ্ত বিবেকের ইতি টেনে আমরা উভয়ের জন্য সমৃদ্ধির সোপান রচনা করতে পারি।
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিম কোর্ট
E-mail: [email protected]