‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল’

Daily Nayadiganta

‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল’ – ছবি : নয়া দিগন্ত

জীবন জগৎ তখনই বিস্বাদ, তিক্ত, কষ্ট, আর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে; বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে মানুষ জীবনের প্রতি; অপ্রাপ্তির বেদনা, বৈষম্যের শিকার এবং বঞ্চনা যখন দেখতে পায়, তাতে সম্মুখের সব আলো তার নিভে যায়। দৈন্য মানুষকে হীনবল, নির্জীব করে তোলে। সম্ভবত এমন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কবি লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। কাব্যের শিল্প সুষমা, অনাবিল সৌন্দর্য আর লালিত্য বজায় রাখা যায় না যখন জঠর জ্বালায়। আমাদের দেশ খাদ্যসঙ্কট অর্থনৈতিক টানাপড়েন নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকে গুরুতর সমস্যায় পড়ে আছে। এ সমস্যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

খাদ্যসঙ্কট আর অর্থনৈতিক টানাপড়েন উভয়ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। খাদ্যের ঘাটতি হলে তা পূরণে খাদ্য আমদানি করতে বহু অর্থের প্রয়োজন। ঘুরে ফিরে এটাই সত্য আর সার কথাÑ খোদ রাষ্ট্রকে আয় রোজগার বাড়াতে হবে। আয় বৃদ্ধির জন্য আমরা কোন খাতের ওপর বেশি নজর দেবো? সেটা অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাই ভেবেচিন্তে, মেধা প্রজ্ঞা বুদ্ধি খাটিয়ে গবেষণা করে বের করবেন। সে কাজ হয়েছে এমন বোধ করছি না। কেননা, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো খাতকেই এ পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সম্মুখে আনা হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমরা অর্বাচীনরা এতটুকু অনুভব করছি বা জেনেছি, প্রচুর ঋণ করে চলছে দেশ। সে ঋণের বোঝা ক্রমাগত বাড়ছে। ব্যক্তিজীবনেও ঋণ করা ভালো লক্ষণ নয়, ঋণকারীকে সমাজে হেয় হয়ে চলতে হয় এবং মারাত্মক হীনম্মন্যতায় দিন যাপিত হয়। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাদামাটা চোখেই আমরা এটা দেখি। দেশের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় নেই। সে কারণে আমাদের অর্থনীতির রুগ্ন দশা কিছুতেই কাটছে না। আমাদের সাম্প্রতিক আমদানি ব্যয় আর রফতানি আয়ের মধ্যে ব্যবধান অনেক।

মাত্র ১০ মাসে (জুলাই ২০২০ থেকে মে ২০২১) আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে চার হাজার ৮৫৫ দশমিক আট কোটি ডলার আর রফতানি হয়েছে তিন হাজার ১৯৭ দশমিক দুই কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি আর রফতানির ব্যবধান এক হাজার ৬৫৯ কোটি ডলার। এটা অবশ্যই নেতিবাচক।

এই অবস্থা তথা ব্যবধান থেকে এটা স্পষ্ট, জাতীয় বাজেটে রফতানি খাতকে এখনো কোনো মদদ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বরং এর উল্টোটা হলেই জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটা ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হতে পারত। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে আশা রয়েছে তাতে রফতানির অবদান ক্রমাগত স্ফীত করে তুলতে হবে। সে প্রয়াস সফল হলে বহু জনশক্তির কাজের সংস্থান হতে পারত। দেশে বেকারত্বের হার কমার পাশাপাশি বেকার মানুষ আত্মস্লাঘা থেকে মুক্তি পেত যা পরোক্ষভাবে জাতির জন্য বড় প্রশস্তির ব্যাপার হতে পারত।

সে যাক, রফতানি আয় থেকে জাতীয় বাজেটে কোনো মদদ দেয়া সম্ভব হয় না বিধায় ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ছে। এখন প্রতিটি মানুষের ঘাড়ে ২৩ হাজার ৪১৫ টাকা ঋণ রয়েছে। এটা হালনাগাদ পরিসংখ্যান নয়। একেবারে হালের পরিসংখ্যান পেলে দেখা যায়, আজ যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে ওর মাথায় আরো বেশি ঋণের বোঝা চাপবে। এদিকে, দিনে দিনে কমছে সহজ শর্তে বা স্বল্প সুদের ঋণ। ইতোমধ্যে ঋণের সুদ আর শর্ত বাড়িয়ে চলেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে, বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের অর্থ সঠিক এবং প্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয় করার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। চড়া সুদসহ বিভিন্ন কঠিন শর্তে ঋণ নিয়েই প্রকল্প গ্রহণের পথেই চলতে হচ্ছে সরকারকে। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম দুর্নীতি রোধসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন সময় মতো শেষ করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা বাস্তবায়নে দেরি হলে খরচ বেড়ে যায় এবং যথাসময়ে প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যায় না। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ এখন সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে আছে গূঢ় রহস্য। সেটা আকলমন্দ ব্যক্তি মাত্রই উপলব্ধি করেন।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান দুটো উৎস, পোশাক রফতানি এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ। এখন উভয় খাতেই আগের চেয়ে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। কোভিডের কারণে এই দুরবস্থা। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, কোভিড থেকে উত্তরণ ঘটলেও পূর্বাবস্থায় ফেরা কঠিন হতে পারে। কেননা বিশ্বে কোভিড পরিস্থিতি থেকে উন্নতি ঘটলেও পোশাক আমদানিকারীদের চিন্তার কোনো পরিবর্তন আসে কি না সন্দেহ, তা ছাড়া বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বহু শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। সেটা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? এসব খুবই জরুরি প্রশ্ন।

বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে চলতি বছরেও কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব থাকবে বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা। তাদের আশঙ্কা, ২০২১ সালেও পোশাক খাত অন্তত শতকরা ২০ ভাগ ক্ষতির মুখে থাকবে। জানা গেছে, গত বছর কোভিড শুরুর পর মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিত হয়ে গেছে। পরে পরিস্থিতি কিছু উন্নত হলেও ৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেনি। এ তো গেল এক দিক। অন্য দিকে সাড়ে তিন লাখের বেশি শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। তাদের এখন মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের কষ্টের সীমা নেই।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি খাত, জনশক্তি রফতানি বাবদ প্রাপ্ত রেমিট্যান্স। তা নিয়েও বেশ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রেমিট্যান্স এখন পর্যন্ত কিছুটা স্থিতিশীল হলেও জনশক্তি রফতানি কমেছে আর বহু মানুষ দেশ থেকে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারছেন না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কোভিড পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তাতে রেমিট্যান্সে ধাক্কা থাকছেই। উল্লিখিত দুই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা এখন অনুভূত হচ্ছে। এই দুই খাতের ওপর এত নির্ভরশীলতা অব্যাহত থাকলে বিপদ আসা অসম্ভব নয়। এ নিয়ে উপর মহলের বিকল্প খোঁজার কথা ভাবতে হবে। সরকার দীর্ঘদিন থেকে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন করার কথা বলে আসছে। কিন্তু বাস্তব কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। অথচ এই খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সুযোগ রয়েছে। ভারত তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ডাটা প্রসেসিং করে তা রফতানি বাবদ বিপুল অর্থ আয় করছে। আমাদের এখানে যখন থেকে তথ্যপ্রযুক্তির কথা হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে তাকে যদি ‘মিন’ করা হতো তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে দেশ কিছুটা অন্তত এগিয়ে যেতে পারত এবং অভিজ্ঞতা অর্জনসহ কিছু অর্থও আসতে শুরু করত। রফতানি খাতের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্র উন্মুক্ত হতে পারত। তবে এ জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগসহ অর্থ বিনিয়োগের প্রশ্ন আছে। তাতে যথাযথ সাড়া দিতে হবে।

রফতানি আয় বৃদ্ধি না পাওয়া ছাড়াও আরো কিছু কারণে জাতীয় বাজেট তৈরি করা এখন অনেক কষ্টকর। আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে নানা সমালোচনা করে এর লক্ষ্য, কোন শ্রেণীর মানুষ এই বাজেট থেকে কতটুকু উপকৃত হবে, খাতওয়ারী ব্যয় বরাদ্দ ইত্যাদি নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এসব আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, কেননা অর্থনীতি নিয়ে প্রত্যহ যাদের নাড়াচাড়া আর জ্ঞান ব্যুৎপত্তি, তাদেরই এসব বিষয়ে গভীরে যাওয়ার মতো জ্ঞান গরিমা ব্যুৎপত্তি রয়েছে; তাদেরই মতামত দেয়া সাজে। তাদের কথাবার্তা থেকে আমরা কিছুটা মাত্র উপলব্ধি করতে পারি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের পক্ষে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সে ঋণ আনতে গিয়ে উচ্চহারে সুদ গুনতে হয়। ঋণ পেতে লবিং করা, ধরাধরির প্রয়োজন হয়। ব্যক্তিজীবনের মতো, ধারকর্জ করতে যেমন অনেক তেল মালিশের দরকার হয়, নানা কটু কথা হজম করতে হয় এবং ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো দশা হয়।

জাতীয় ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতা সম্ভবত খুব একটা ভিন্ন বা সুখকর নয়। পঞ্চাশ বছর ধরে ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। সে জন্য ঋণের মূল আর সুদ মিলিয়ে বহু অর্থ বাজেটে রাখতে হয়। যত দূর জানা গেছে, তাতে এবার বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় হবে ৫৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ দিতে হবে পাঁচ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা।

আগের চেয়ে ঋণ পরিশোধের আনুমানিক ব্যয় বাড়ছে ছয় হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এটা কমাতে পারলে অনেক হিতকর কাজ তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ও জনজীবনের বৈষম্য দূর করা বাবদ ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো যেত। এসব বিষয় জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। আগে এ কথা বলে এসেছি, জাতীয় অর্থনীতিকে পরিপুষ্ট করা, মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য কোন পথে এগিয়ে যাওয়া হবে সেটা নির্ধারণ করা একটা মৌলিক বিষয়। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত না হলে হতে পারে হাল ভাঙা নৌকার মতো মাঝদরিয়ায় কেবল ঘুরপাক খাওয়ার অবস্থা। দেশে অনেক বিষয়ে অ্যাডহক বেসিসে কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। এর অর্থ হলো চরম লক্ষ্যহীনতা আর সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত নেয়ার দুর্বলতা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতেও কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাবে না। দেশের অবকাঠামোগত সঙ্কট, দেশী-বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের হাল, বিনিয়োগবান্ধব আইনকানুনের বেড়াজাল, আমলাতন্ত্রের ঘোরপ্যাঁচ, সরকারি সহযোগিতার অভাব, দক্ষ জনশক্তির সঙ্কট, উচ্চমানসম্পন্ন ব্যবস্থাপকদের স্বল্পতা, ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শত জটিলতা, রাজনৈতিক টাউটদের চাঁদাবাজি- সব মিলিয়ে দেশে শিল্পের বিকাশ ঘটানো প্রকৃতপক্ষে এক দুরূহ ব্যাপার। এ ছাড়া আরো অনেক কারণে দেশে যে কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলো পরিচালনা করা, তথা ব্যবসা করা এখন মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। অতীব দুঃখের বিষয়, দেশের বিদ্যমান অবস্থায় এসব প্রতিকূলতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ন বা রুগ্ন হওয়ার পথে। অথচ তার প্রতিবিধান করার কোনো সরকারি উদ্যোগ আছে বলে ভুক্তভোগীরা অনুভব করছে না। সে জন্য বড় শিল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা এই মুহূর্তে বোধ হয় সম্ভব হবে না। বড় প্রতিষ্ঠান না হলে শিল্প খাত থেকে রফতানি আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত থেকে যাবে। গত ৫০ বছরে শিল্প যতটুকু এগিয়েছিল তা এখন ক্ষয়ের দিকেই চলছে।

আমরা যে অনুমানের কথা উপরে বলে এসেছি, আমাদের আয় উন্নতি তথা সচ্ছলতা আনার জন্য কোন সেক্টরকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, তা এখনো সেভাবে নির্ণীত হয়নি। তাই সাধারণ বোধ বিবেচনা থেকে এটাই মনে হয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ এর ব্যাখ্যাটা এভাবে হতে পারে; দেশের শিল্পসহ কোনো একক খাত থেকেই যখন জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য নির্ভর করা যাবে এমন অবস্থা আছে মনে হয় না। তাই রফতানির ব্যাপক ‘ডাইভারসিটি’ আনতে হবে তথা বহুমুখীকরণ করতে হবে। ছোট ছোট খাতকেও গুরুত্ব দিয়ে, পরিচর্যা করে রফতানি আয় বৃদ্ধির যে সাধারণ চেষ্টা আছে, তাকে অসাধারণ করে তুলতে পারলে, ছোট ছোট খাত থেকে আয় একত্র করা হলে তার অঙ্ক অবশ্যই কিছুটা বাড়বে।

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে রফতানিমুখী করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কফি, কাজুবাদাম, ফলমূল চাষে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিকায়ন তথা যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষিকে রফতানিমুখী করা হবে।” কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে তার এই উপলব্ধিকেই আমরা বলতে চেয়েছি ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা বিন্দু বিন্দু জল।’ আসলে কৃষি এখনো অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরোপুরি মিটিয়ে আসতে পারছে না বটে কিন্তু এটা বৃদ্ধি করা হয়তো অন্যান্য সেক্টর থেকে কিছুটা অন্তত সহজ। তবে এ নিয়ে এখন যত অবহেলা আর অবজ্ঞা, এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কোনো কোনো মন্ত্রণালয় আর সরকারি সংস্থা নিয়ে আলোচনা ও প্রচুর সমালোচনা এবং সম্প্রতি সংসদেও এমন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে এর বিপরীতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখতে হবে। তারা সব দুর্বলতার ঊর্ধ্বে এ কথা বলছি না; তবে এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে ক’টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার বিজ্ঞানীরা যেসব গবেষণা করছেন তার ফলাফল আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, সেখানে নানা সাফল্যের তথ্য রয়েছে। তারা একের পর উচ্চ ফলনশীল ধানবীজ, বিরূপ পরিবেশ ও আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের মোকাবেলা করা দানাদার শস্য, ফলমূল শাকসবিজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য নানা সহায়তা দিয়ে চেষ্টা করছেন যা কৃষি ও কৃষককে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে। কৃষক তাতে লাভবান হচ্ছে, সেই সাথে জাতিও। কৃষি বিজ্ঞানীদের এসব উদ্ভাবন যদি না হতো তবে দেশের খাদ্যসঙ্কট আর শাকসবজির ঘাটতি কী পরিমাণের হতো তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করব। ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল দুই কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। এখন আনুমানিক হিসাব হচ্ছে, তা হ্রাস পেয়ে মাত্র ৫০ লাখ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটির মতো। ১৯৭১ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল বেশি আর জনসংখ্যা ছিল সাত কোটির মতো। তদুপরি তখন খাদ্যের ঘাটতি তথা সঙ্কট ছিল ভয়াবহ। এখন জমির পরিমাণ কমেছে অনেক, অপরদিকে জনসংখ্যা ১৯৭১ সালের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু খাদ্যসঙ্কট অতীতের মতো আর নেই। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরণীয়। তারা গবেষণা করে ধান গমসহ বহু শস্যের উচ্চ ফলনশীল বীজ উদ্ভাবন করেছেন। খাদ্যশস্যের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। সেই সাথে তাদের গবেষণা কার্যক্রম নিরন্তর চলছে। তাতে এই প্রত্যয় জন্মেছে, ভবিষ্যতে তাদের কাজের ফলাফলে দেশ খাদ্যে শুধু সয়ম্ভরই হবে না খাদ্যশস্য রফতানি করতে বাংলাদেশ সক্ষম হবে।

দেশের শ্রমশক্তির ৬০ শতাংশই কৃষিকাজে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই কৃষির অগ্রগতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু সে সম্ভাবনার চেয়ে এখন সমস্যাই যেন বাড়ছে। কারণ দিন দিন দেশের কৃষি জমি অব্যাহতভাবে চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। অনেক দিন থেকে শুনে আসছি, কৃষির সামগ্রীর সমস্যা বিবেচনায় রয়েছে এবং নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেটা হতে কতকাল যাবে? এমন পরিণতি না হয় যাতে ‘নুন আনতে পান্থা ফুরাবে’। দেশের নানা সমস্যার কথা উঠলে প্রশাসন থেকে বলা হয়, সমস্যা দূর হবে, হচ্ছে। তারপর কোনো খোঁজখবর থাকে না।

সন্দেহ নেই কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদানের কারণে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য এসেছে। দানাদার উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সবজি ফলমূলের উৎপাদন বেড়েছে বটে তবে এখনো চাহিদা পুরোপুরি মেটানো যাচ্ছে না। ডাল তেল ফলনের হার খানিকটা বাড়লেও এসব ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা এখনো বজায় রয়েছে। সব ফসলের উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা স্থিতিশীল নয়, এটি বাড়ছে বার্ষিক শতকরা ১ দশমিক ৪৭ ভাগ হারে। আর দেশের আবাদি জমি কমছে প্রতি বছর। এর পরিমাণ ন্যূনতম শতকরা শূন্য দশমিক ৫০ হারে। এ দুটো কৃষির অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না।

কৃষির আর যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে অল্প আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, অধিক শস্য উৎপাদনের জন্য মাটির ‘স্বাস্থ্য’ ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটিতে জৈবসার প্রয়োগ করে সেটা সম্ভব বটে, তবে সে পরিমাণ জৈবসার তৈরির উদ্যোগ তো আমাদের নেই। আগে প্রতি গৃহস্থের বাড়িতে গরু-ছাগল এবং মুরগি পালনের রীতি প্রচলিত ছিল বলে সহজেই পাওয়া যেত গোবর ও বিষ্ঠা। এসব একটি গর্তে জমা করে, কৃষক পেতেন জমিতে দেয়ার মতো জৈব সার। অথচ এখন বহু গৃহস্থের বাড়িতে গরু, ছাগল, মহিষ- এমনকি হাঁস-মুরগি পর্যন্ত পালনের নেই কোনো আয়োজন। ফলে সহজে জৈব সার পাওয়ার উৎসটা বহুলাংশে কমেছে।
চ্যালেঞ্জ রয়েছে পানিপ্রাপ্তি নিয়েও। সেটি যেমন ভূগর্ভস্থ পানি সমস্যা তেমনি ভূউপরিস্থিত পানির সঙ্কট। মাটির নিচের পানি ক্রমাগত উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহও কঠিন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানি জমিতে সেচের জন্য ব্যবহার করা কতটা যৌক্তিক, তা খুব দ্রুতই ভেবে নেয়ার সময় এসেছে।

তাছাড়া বৃষ্টির পানি শুকনো মৌসুমে ব্যবহার করার জন্য পানি ধরে রাখার মতো জলাশয় এখন
কোথায়? খাল বিল নদী নালা যা আগে ছিল তা তো পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এমন জলাশয় থাকলে সেচের পানির অভাব অনেকটা কমত। এই সমস্যা দূর করা খুব কঠিন নয়। খাল বিল নদী নালাগুলো সংস্কার করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে সমস্যার ভার অনেকটা হ্রাস পেত।
আমাদের কৃষির অন্যান্য চ্যালেঞ্জ হলো, খরা, লবণাক্ততা, আকস্মিক বন্যা। এসব ছাড়াও রয়েছে ঝড়, সাইক্লোনের মতো নানা বিপর্যয়। এসব মূলত বিশ্বের উষ্ণায়নের প্রভাব। এ নিয়ে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং তথ্য অনুসন্ধান আর প্রতিকারে পথ খোঁজার জন্য বিশেষজ্ঞদের এগিয়ে আসতে হবে। কিছু কাজ হচ্ছে না তা নয়। তবে তার সাফল্যের জন্য কর্তৃপক্ষের ভিজিলেন্স থাকতে হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জমি অনেক বেশি লবণাক্ততার কবলে পড়েছে। সমুদ্র উপকূলীয় সাতটি জেলায় লবণাক্ততা গ্রহণযোগ্য মাত্রার অনেক উপরে রয়েছে প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর জমিতে। এমন লবণাক্ততা সইতে পারে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম- তেমন ধানবীজের এখনো ঘাটতি রয়েছে। দু-চারটি ধানের জাত অবশ্য দেশে অবমুক্ত করেছেন আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা। ধানের পাশাপাশি জন্মাতে হবে অন্যান্য ফসল। এগুলো নিয়ে দ্রুত কাজ করা দরকার। খরাসহিষ্ণু ধান রয়েছে। বন্যায় ক্ষতি করে শস্য। এ রকম বন্যা সহনশীল ধান, বৈরী পরিবেশ উতরে যেতে পারে উন্নত ধানের জাত উদ্ভাবনের যে চ্যালেঞ্জ তা আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার আওতাভুক্ত হওয়া উচিত। বিজ্ঞানীদের এসব কাজের অর্থায়ন, মাঠপর্যায়ের কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিমন্ত্রী একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি এসব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল, তাই তার কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক।

[email protected]