ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১৭শ কোটি টাকার দুর্নীতি: হুলিয়া মাথায় পালানো আজিজ দেশে ফিরে প্রকাশ্যে

 

রহমান জাহিদ
১১ জুন ২০২৩

প্রযোজক আবদুল আজিজ

ক্রিসেন্ট গ্রুপের বহুল আলোচিত সতেরশ কোটি টাকা দুর্নীতির পাঁচ মামলায় ঋণের দুই শতাংশ ডাউন্ট পেমেন্ট দিয়ে সিনেমা প্রযোজক আবদুল আজিজ ছাড়া একে একে সব আসামিই আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। মামলায় ২২ আসামির মধ্যে জনতা ব্যাংকের ডিএমডিসহ ১৫ কর্মকর্তা এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও পাঁচ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাতজন রয়েছেন। আবদুল আজিজ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই দেশ ছেড়েছিলেন। আদালতের সেই হুলিয়া মাথায় নিয়েই কিছুদিন আগে তিনি দেশে ফেরেন। এখন প্রকাশ্যেই ঘুরছেন। তাকে গ্রেপ্তারে এ পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

আবদুল আজিজ আমাদের সময়কে বলেছেন, তিনি এখন দেশে অবস্থান করছেন। শিগগিরই জামিনের জন্য আদালতে যাবেন। আবদুল আজিজের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজ আদালতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলোর চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তার নামে পরোয়ানা জারি করেন আদালত। সে পরোয়ানা থানায় পাঠানো হয়েছে। এখন থানা থেকে পরোয়ানা তামিল করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে রিপোর্ট এলেই বিচার শুরু হবে। এ ছাড়া তিনি যদি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন, সে ক্ষেত্রে তার উপস্থিতিতে বিচার কাজ চলবে।’

আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, ক্রিসেন্ট লেদার, রূপালী কম্পোজিট ও লেদারওয়্যারের চেয়ারম্যান এমএ কাদের, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার স্ত্রী সুলতানা বেগম, রূপালী কম্পোজিটের পরিচালক ও এমএ কাদেরের মেয়ে সামিয়া কাদের নদী, রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান ও এমএ কাদেরের ভাই আবদুল আজিজ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবদুল আজিজের স্ত্রী লিটুল জাহান মির, ক্রিসেন্ট লেদারের পরিচালক রেজিয়া বেগম এবং মেসার্স লেক্সকো লিমিটেডের পরিচালক মো. হারুন-অর-রশীদ।

আসামির তালিকায় আরও রয়েছেন- জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ফরেন ট্রেড ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) মো. ফখরুল আলম, তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান (ঢাকা দক্ষিণ) ও বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মো. জাকির হোসেন, তৎকালীন ফরেন ট্রেড ডিভিশনের ডিজিএম এবং বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ, নোট প্রস্তুতকারী সিনিয়র অফিসার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, পরীক্ষণকারী সিনিয়র অফিসার মো. সাইদুজ্জামান, সুপারিশকারী প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. রুহুল আমিন, সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. মগরেব আলী, মো. খায়রুল আমিন, এজিএম আতাউর রহমান, অনুমোদনকারী ডিজিএম মো. রেজাউল করিম, মোহাম্মদ ইকবাল, একেএম আসাদুজ্জামান, জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার বাহারুল আলম এবং প্রধান কার্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার এসএম শরীফুল ইসলাম।

মামলার নথি বলছে, আসামিদের মধ্যে এমএ কাদের, হারুন-অর-রশীদ, জাকির হোসেন ও ফখরুল আলম গ্রেপ্তার হন। তারা বিভিন্ন সময়ে জামিন পেয়েছেন। যার মধ্যে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হওয়া কাদের সর্বোচ্চ এক বছর কারাভোগের পর ঋণের দুই শতাংশ ডাউন্ট পেমেন্ট দিয়ে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পান। অন্যরা তার আগেই জামিন পান।

এসব মামলায় গত ৫ জুলাই চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। তিনি মামলাগুলোর বাদীও ছিলেন।

চার্জশিটে দেখা যায়, জাকির হোসেন, রেজিয়া বেগম, মো. হারুন-অর-রশীদ ও সামিয়া কাদের নদীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। চলতি বছর ১৭ ও ১৯ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদন অনুযায়ী আসামিদের অব্যাহতি দিয়েছেন। একই দিন মামলাগুলোর চার্জশিট আমলে গ্রহণ করে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

মামলায় পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হওয়ার পর পলাতক আসামি সুলতানা বেগম, কাদেরের মেয়ে সামিয়া কাদের নদী, রিমেক্স আবদুল আজিজের স্ত্রী লিটুল জাহান মির, আবদুল্লাহ আলম মামুন, সাইদুজ্জামান, রুহুল আমিন, মগরেব আলী, মো. খায়রুল আমিন, আতাউর রহমান, রেজাউল করিম, মোহাম্মদ ইকবাল, আসাদুজ্জামান, বাহারুল আলম, কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ এবং শরীফুল ইসলাম গত ২ ও ১৩ মার্চ এবং ১৪ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

জামিন আদেশে ঋণের দুই শতাংশ ৪৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ডাউন্ট পেমেন্ট দেওয়ায় আসামিদের জামিন পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে একমাত্র রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান ও এমএ কাদেরের ভাই আবদুল আজিজ এখনো পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি আছে। তিনি মামলাগুলোর মধ্যে একটি মামলার আসামি।

২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজার থানায় এ মামলাগুলো দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।

মামলার এজাহারে বলা হয়, রপ্তানি বিল ক্রয় প্রক্রিয়ায় (ফরেন ডকুমেন্ট বিল পার্সেস বা এফডিবিপি) জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ক্রিসেন্টের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্ট ৫০০ কোটি ৭০ লাখ, ক্রিসেন্ট ট্যানারি ৬৮ কোটি, লেসকো ৭৫ কোটি, রূপালী কম্পোজিট ৪৫৪ কোটি এবং রিমেক্স ফুটওয়্যার ৬৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

মামলার তথ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট গ্রুপের রপ্তানি বিল কিনে নিয়েছে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা। নিয়ম অনুসারে আগাম টাকার প্রয়োজনে কোনো রপ্তানিকারক পণ্য রপ্তানির পর এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র জমা দিয়ে ব্যাংকের কাছে টাকা চাইতে পারে। এক্ষেত্রে ওই ব্যাংক বিল কিনে নিয়ে রপ্তানিকারককে ৯০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। ব্যাংকিংয়ের ভাষায় এ প্রক্রিয়াকে ‘ফরেন ডকুমেন্ট বিল পার্চেজ (এফডিবিপি)’ বলে। তবে এফডিবিপির ক্ষেত্রে অবশ্যই ১২০ দিনের মধ্যে ব্যাংকে টাকা পরিশোধে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মাধ্যমে ব্যাংককে শতভাগ নিশ্চিত হতে হয়Ñ বিলের টাকা পাওয়া যাবে। আর এ প্রক্রিয়ার (এফডিবিপি) মাধ্যমেই ক্রিসেন্ট গ্রুপ টাকা নিয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড শিপিং লাইন এবং ইউরো এশিয়া শিপিং লাইনের নামে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংকে দাখিল করা হয়। হংকং, থাইল্যান্ড ও দুবাইতে নিবন্ধিত সান পল লেদার ক্র্যাফট, বায়ো লি ডা ট্রেডিং করপোরেশন, মার্চেন্ট ট্রেড গ্যারান্টি করপোরেশন কোম্পানি, ব্রাইট বিউ জেনারেল ট্রেডিং নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিল দাখিল করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ডকুমেন্ট নেওয়া হয়েছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার এক্সিও ক্রেডিট ব্যাংক লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকে। এ ব্যাংক থেকে ২২১টি এলসি ইস্যু করা হয়। তবে আদৌ এ সংক্রান্ত কোনো এলসি খোলা হয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে বলে মামলার তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে।

মামলার নথি বলছে, এ ঋণের ক্ষেত্রে ক্রিসেন্ট গ্রুপ বেশ কয়েকটি আইনের তোয়াক্কা করেনি। রপ্তানি বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানে সন্তোষজনক ক্রেডিট রিপোর্ট জরুরি। আর প্রথম লেনদেনের আগে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এ নির্দেশনাও মানেনি জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা। ফলে নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্রিসেন্টকে একটি বিলের বিপরীতে ৩৪৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে বিশ্বাসভঙ্গ করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে রপ্তানি না করেও ভুয়া এফডিবিপি ডকুমেন্ট ও প্যাকিং ক্রেডিট দিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ প্রক্রিয়ায় গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ফলে এটি আত্মসাৎ বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত।

মামলায় বলা হয়, ক্রিসেন্ট গ্রুপের টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ব্যাংকের যেসব দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ দেশের বাইরের ব্যাংকের সঙ্গে এলসি খোলার সময় ওই ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কিনা তা যাচাই করেনি জনতা ব্যাংক। আর রপ্তানি চুক্তিতে কোনো সাক্ষীর স্বাক্ষর নেই, যা আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া এফডিবিপি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষর যাচাই করা হয়নি। জনতা ব্যাংকের নীতিমালায় ত্রুটিপূর্ণ বিল ক্রয় না করার নিয়ম থাকলেও সেটি মানা হয়নি। বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে আমদানিকারকের এক্সেপটেন্স (সম্মতি) বাধাত্যমূলক থাকলেও সেটি লঙ্ঘন করা হয়েছে। ব্যাংকের ডকুমেন্টের সঙ্গে রিলেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন না থাকায় সুইফট মেসেজ বিনিময়ের শর্ত লংঘন করা হয়েছে।