- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ জুলাই ২০২০
মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের করোনা পরীক্ষা করাতে মারধরের শিকার হয়েছেন ছেলে শাওন হোসেন। শাওন রাজধানীর মুগদার দক্ষিণ মান্ডা এলাকার বাসিন্দা। ভোর পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করানোর অনুমতি না পাওয়ায় কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের সাথে বাগ্বিতণ্ডা হয় শাওনের। একপর্যায়ে তার কলার ধরে হাসপাতালের ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যান আনসার সদস্যরা। এই ঘটনার ছবি তুলতে গেলে আনসার সদস্যরা লাঞ্ছিত করেন দুই ফটো সাংবাদিককে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় এই ঘটনা ঘটে।
উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আনসার সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার শাওন হোসেনের মা ক্যানসারের রোগী।
কেমোথেরাপি দিতে হলে করোনা শনাক্তের পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। লাইনের ক্রম অনুযায়ী তার আজই পরীক্ষা করানোর কথা। অথচ অসুস্থ মাকে নিয়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও তাকে না করে দেয়া হয়।
ভুক্তভোগী শাওন হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত দুবার মুগদা হাসপাতাল থেকেই করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করিয়ে তিনি মাকে কেমোথেরাপি দিয়েছেন। গত ২০শে জুন তৃতীয়বারের মতো বুথে পরীক্ষা করান। কিন্তু সময়মতো ফল না পেয়ে ২৩শে জুন তিনি অভিযোগ বক্সে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। তার পরও ফল না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী, ২৬শে জুন তিনি নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দিয়ে যান। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে আবারও নোটিশ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে বৃহস্পতিবার পুনরায় তার মাকে পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতাল থেকে বলা হয়।
শাওন আরো বলেন, করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালের সামনে দুটি লাইন থাকে। একটি লাইন যারা বিনা মূল্যে বুথে পরীক্ষা করাবেন তাদের। অন্যটি যারা ২০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে পরীক্ষা করাবেন তাদের। মাকে নিয়ে তিনি ভোর ৫টায় হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর লাইনে দাঁড়ান। লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা নিজেরাই একটি ক্রম করেন। সেই অনুযায়ী তার ক্রম ছিল ৩৬ নম্বরে।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষার জন্য টোকেন দেয়া শুরু করে। প্রথমে যারা বিনা মূল্যে বুথে পরীক্ষা করাবেন তাদের টোকেন দেয়া হয়। এরপর হাসপাতালে যারা পরীক্ষা করাবেন তাদের টোকেন দেয়া শুরু হয়।
আনসার সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার শাওন হোসেন বলেন, লাইনে অপেক্ষমাণ ব্যক্তিরা যাতে সুশৃঙ্খলভাবে টোকেন সংগ্রহ করেন, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আনসার সদস্যদের। কিন্তু তারা কিছুই না করে ফটকে বসেছিলেন। তখন তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে দায়িত্ব নিয়ে একজন একজন করে টোকেন সংগ্রহ করার জন্য পাঠাচ্ছিলেন। ৩৩তম ব্যক্তি যাওয়ার পরই যারা টোকেন দিচ্ছিলেন তারা আর টোকেন দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী অন্তত ৪০ জনকে তাদের টোকেন দেয়ার কথা। তার ক্যানসার–আক্রান্ত মা ৩৬ নম্বরে দাড়িয়ে ছিলেন।
শাওন বলেন, টোকেন না দেয়ার কারণ জানতে তিনি এগিয়ে যান। যারা টোকেন দিচ্ছিলেন তারা কোনো জবাব না দিয়েই সেখান থেকে চলে যান। তখন আনসার সদস্যদের কাছে তিনি কারণ জানতে চান। তাদের সাথে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তার কলার ধরে ভেতরের আনসার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে লাঠি দিয়ে দুটি বাড়ি দেয়া হয়। একজন আনসার সদস্য তার হাত বাঁধার জন্য রশিও নিয়ে আসেন। পরে মুগদা থানা থেকে পুলিশ আসে। তারাও ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করে। শেষমেশ তার পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা লিখে নিয়ে যায়। এ নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা না বলার জন্যও শাসানো হয় তাকে।
রুবেল রশীদ জানান, মুগদা হাসপাতালে কভিড-১৯ টেস্টের জন্য গতকাল ৪০ জনকে টিকিট দেয়া হয়। কিন্তু ৩৪ জনের পরীক্ষা করেই আনসার সদস্যরা বলেন আজ পরীক্ষা শেষ। তখন ৩৬ নম্বর সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা শাওন হোসেন নামের এক যুবকের সঙ্গে আনসার সদস্যদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আনসাররা তার গায়ে হাত তোলেন। তখন ওই ঘটনার ছবি তুলতে যান বাংলাদেশ প্রতিদিনের আলোকচিত্রী জয়িতা রায়। এ সময় আনসার সদস্যরা জয়িতাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করলে তিনি সরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন।
রুবেল রশীদ বলেন, এরপর ঘটনার ছবি তুলতে আমি এগিয়ে যাই। তখন আনসার সদস্যরা আমার ক্যামেরার ফিল্টার ভেঙ্গে ফেলে। তারা অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে নানা ধরনের হুমকি দেন। একপর্যায়ে তারা বলেন, এখানে সাংবাদিকদের রংবাজি চলবে না। আমাদের রংবাজি চলবে।
ফটো সাংবাদিক জয়িতা রায় বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি মুগদা হাসপাতালে পৌঁছেই আনসার সদস্যদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে দেখতে পান। তখন ছবি তুলতে গেলে একজন আনসার তেড়ে আসেন। তাকে চড় মারতে উদ্যত হন। তিনি কোনো রকম সরে পড়লে চড়টি তার গায়ে লাগেনি। তার এই পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে আসেন ফটোসাংবাদিক রুবেল রশীদ।
সাংবাদিকদের তোলা ছবি থেকে দেখা যায় দুজন আনসার সদস্য সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে না পারা ছেলেটির কলার ধরে টানাহেঁচড়া করছেন। তাকে রক্ষার জন্য পেছনে যান মা। এদের একজন আনসার সদস্য আফসারুল আমিন ফটো সংবাদিকদের ছবি তুলতে বাধা দিচ্ছিলেন। তবে লাঞ্ছিত দুই ফটোসাংবাদিক জানিয়েছেন, সেখানে আরো কয়েকজন আনসার সদস্য ছিলেন যারা খুব বাজে আচরণ করছিলেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুগদা জেনারেল হাসপাতাল আনসার ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষা করাতে না পেরে ছেলেটি (ভুক্তভোগী শাওন হোসেন) তাদের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলছিলেন। তখন সেখানে উপস্থিত একটি সংস্থার সাদাপোশাকের সদস্য ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলেন। তারা সেই কাজটিই করেছেন। পরে মুগদা থানার একজন উপপরিদর্শক এসে ছেলেটির নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে যান। ছেলেটিকে কোনো মারধর করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
মুগদা হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার টোকেন দেয়ার বিষয়টি তদারকি করেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার অনিমেষ। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার সামনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারা বুথ এবং হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর জন্য মোট ৫০ জন করে ১০০ জনকে টোকেন দিয়েছেন। সে হিসাবে লাইনের ৩৬ নম্বর যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তার অবশ্যই পরীক্ষা করাতে পারার কথা। তার দাবি, ক্যানসার–আক্রান্ত কোনো রোগী থাকলে তার কাগজপত্র দেখে সবার আগে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেন তারা।
তবে আনসার ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব সময়ই জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে পরীক্ষা করানোর কিছু টোকেন তাদের হাতে রেখে দেয়। আগে এই সংখ্যাটি ছিল ১৪-১৫টি। এখন ৬-৭টি রেখে দেয়া হয়। আর লাইনে দাঁড়ানো মানুষজন তাদের ওপর চড়াও হন।
মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রলয় কুমার সাহা বলেন, অকথ্য ভাষায় কথা বলায় আনসার সদস্যরা একটি ছেলেকে টানাহেঁচড়া করেছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তবে কোনো সাংবাদিককে মারধর করা হয়নি। গালমন্দ করে থাকতে পারেন। তবে এ নিয়ে কেউ তার কাছে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি।