কোন পথে বাংলাদেশ

 

সাঈদ ইফতেখার আহমেদ

গত ২৮ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। বিএনপি এর জন্য সরকারকে দায়ী করে জামায়াতসহ সমমনা ডান এবং কিছু বামপন্থি দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

সংকট নিরসনে আলাপ-আলোচনার পথে না গিয়ে সরকার হঠাৎ বিএনপির বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যায়। সরকারের কঠোর নীতির ফলে দলটির মহাসচিবসহ এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন কেন্দ্রীয় অনেক নেতাসহ মাঠ পর্যায়ের প্রায় ১১ হাজার নেতাকর্মী।

সরকার গত কিছুদিনে স্পষ্ট করেছে, তারা ভিসা নীতি বা নির্বাচন-পরবর্তী অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত নয়। তারা তাদের ভাষায় ‘সংবিধান অনুযায়ী’ যথাসময়ে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না এলে তার দায় সরকার নেবে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মনে করছে, জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলেই নির্বাচন বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিষয়টি দেখছেন ভিন্নভাবে। তারা মনে করছেন, সরকার কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে, অনেকটা ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতোই নির্বাচন করতে যাচ্ছে।

এ ধরনের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির ধরন বা রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ– কোনো কিছুই ভোটের সার্বিক ফলাফলের পরিবর্তন ঘটায় না। কারণ এতে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে ফলাফলের যে ধারাবাহিকতা; ২০২৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে ধারাবাহিকতার কোনো বদল ঘটবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন না।

এটি এখন অনেকটাই পরিষ্কার– বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন অবস্থানকে তোয়াক্কা না করে অতীতের দলীয় সরকারগুলোর মতোই একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারকে আপাতত বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। সরকারের এ ধরনের শক্ত অবস্থানে যাওয়ার ব্যাপারটি রাজনৈতিক সচেতন মহলের অনেকের হিসাবের বাইরে ছিল। তারা এখন বোঝার চেষ্টা করছেন– জাতীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো নিয়ামক সরকারকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।

এখানে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। এগুলো হলো– ক. আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছে যাওয়া এবং এর প্রতিফলন দেখা গেছে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না আসা; খ. ভারত-চীনসহ একাধিক দেশের কাছ থেকে সমর্থনের জোরালো প্রতিশ্রুতি পাওয়া। যার ফলে সরকার মনে করছে, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কোনো মার্কিন চাপ এলে তা মোকাবিলা করতে তাদের সমস্যা হবে না; গ. ইংরেজিতে যেটিকে বলে ‘ফুলহার্ডি’, অর্থাৎ সংকটের গভীরতা বা আদ্যোপান্ত না বুঝেই কঠোর ভূমিকা পালন।

এটি ঠিক যে, সরকারের আত্মবিশ্বাসের উৎস বুঝতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুটা সময়। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত তার অবস্থান আবারও স্পষ্ট করেছে। ভারত এখানেই ক্ষান্ত থাকেনি। তাদের এ অবস্থান তারা নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সামনেও তুলে ধরেছে।

ইসরায়েল-হামাস সংঘাত ঘিরে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটি শুধু বর্তমান বাইডেন প্রশাসনকেই নয়, বরং সোভিয়েত-পরবর্তী অনুসৃত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকেই গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর বিভাজন এবং অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ ক্রমেই সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের বিক্ষোভের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

এমতাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়াতে অনেকটা মিত্রহারা যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকানোর কৌশল থেকে ভারত, না বাংলাদেশকে বেশি গুরুত্ব দেবে? যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ভারতের লাইন অনুসরণ করবে, নাকি ভিসা নীতিসহ তাদের অনুসৃত নীতিতেই অটুট থাকবে– তা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে।

বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ায় সম্পূর্ণরূপে মিত্রহারা ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে তার নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে করছে। এটিকে তারা কোনোভাবেই হারাতে চায় না। নয়াদিল্লির দক্ষিণ ব্লক মনে করছে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের উত্থান ঘটবে এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।

এ দুটো বিষয় সর্বোতভাবে ভারতের স্বার্থের পরিপন্থি। অতীতে বিএনপির ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি এবং ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে গভীর সখ্য ভারতকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ বার্তা দিতে চাচ্ছে– বাংলাদেশে ইসলাম পন্থার রাজনীতি এবং চীনের উপস্থিতি শুধু ভারত নয়; মার্কিন স্বার্থেরও পরিপন্থি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ফোকাস গণচীন ও রাশিয়া। গণচীনের উত্থান ও রাশিয়ার পুনরুত্থান মার্কিন নীতিনির্ধারকদের গভীর শঙ্কায় ফেলেছে। সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়া আর কখনও বিশ্বরঙ্গমঞ্চে ফিরে আসতে পারবে না এবং গণচীনে পুঁজিবাদের যে বিকাশ, তা পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়েই বিকশিত হবে– এটিই ছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের ধারণা। বস্তুত, এ ভাবনাই রাশিয়া বা চীনের দিকে না তাকিয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রকে উৎসাহিত করেছিল। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব-বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রকে সেখান থেকে সরে এসে চীন ও রাশিয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাধ্য করেছে।

এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য সংকট বাইডেন প্রশাসনকে তাঁর ক্ষমতার সময়ের সবচেয়ে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এ সংকট রাশিয়া এবং চীনকে মধ্যপ্রাচ্যে অধিকতর ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেবে বলে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। সুতরাং, চীনকে প্রতিহত করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের শক্তিশালী উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে। ভারত সম্পর্কে এ উপলব্ধি ঘিরেই বাংলাদেশ বিষয়ে আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারিত হতে যাচ্ছে।

নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে চীনকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে ভারতের স্বার্থকে যদি যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে তা আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশেষ সুবিধা দেবে। ফলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যদি ব্যাপক সংখ্যক জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে না পারে, তাহলে বর্তমান সরকারের যে ধারাবাহিকতা, সেটি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে বিবদমান পরিস্থিতিতে কেউ কেউ তৃতীয় পক্ষের সামনে চলে আসার যে আশঙ্কা করছেন, বাস্তবতার নিরিখে সেই শঙ্কা অনেকটাই ক্ষীণ বলে প্রতীয়মান।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সময়ে পাস হওয়া বার্মা অ্যাক্টের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবৈধ, অসাংবিধানিক এবং সামরিক শাসনকে সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয় এবং প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের সময় নেওয়া নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কোনো অনির্বাচিত সরকারকে সমর্থন দেওয়া দুরূহ। এর সঙ্গে ভারত, চীন, রাশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকেও অনির্বাচিত কারও সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এ সবকিছুই বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় তৃতীয় পক্ষের সামনে আসার সম্ভাবনাকে সংকুচিত করেছে।

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: শিক্ষক, স্কুল অব সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজ, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র

সমকাল