কোটা নিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছে সরকার

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বাংলা বন্‌ধ্‌ বা বাংলা ব্লকেডের ডাক দিয়েছেন।

একদা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বন্‌ধ্‌ কথাটি বেশ চালু ছিল। সরকারের যেকোনো নীতি বিরোধী দলের পছন্দ না হলেই বন্‌ধ্‌ আহ্বান করা হতো। বাংলাদেশে আমরা যাকে হরতাল বা অবরোধ বলতাম।

বহু বছর পর সেই বন্‌ধ্‌ আবার বাংলাদেশে ফিরে এল। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বাংলা বন্‌ধ্‌ বা বাংলা ব্লকেডের ডাক দিয়েছেন। এটাকে বাংলা অচল করার কথাও বলা যায়। গত তিন বছরে বিরোধী দল সরকারের দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর কর্মসূচি দিতে পারেনি।

কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা সেটা করে দেখালেন। সারা দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গন এখন অচল। একদিকে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন, অন্যদিকে শিক্ষকদের পেনশন স্কিমবিরোধী আন্দোলন। এরশাদের পতনের পর শিক্ষাঙ্গনে এ রকম বড় আন্দোলন হয়েছে  বলে মনে হয় না।

আন্দোলনে তারুণ্য কখনো পরাভব মানে না। তারুণ্যের শক্তি আমরা দেখে আসছি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্র–তরুণেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁরা আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করেছিল।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে দুটি সফল আন্দোলন হয়েছে, তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্র–তরুণেরা। দুটি আন্দোলনই হয় ২০১৮ সালে। প্রথমে কোটাবিরোধী আন্দোলন, পরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন। পরে এই পরিষদের অন্যতম নেতা নুরুল হক ডাকসু নির্বাচনে ভিপি হয়েছিলেন। একপর্যায়ে তাঁরা গণ অধিকার পরিষদ নামে রাজনৈতিক দলও গঠন করেন। সেই রাজনীতি এখন বিভক্ত ও পথহারা। কিন্তু তাদের সূচনাটা ভালো ছিল।

কোটা নিয়ে এখন যে সারা দেশে উত্তাল অবস্থা চলছে, তার পেছনে আছে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। আন্দোলনকারীরা কোটাপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল চাননি কখনো। তাঁরা চেয়েছিলেন কোটার সংস্কার। সে সময় ৫৬ শতাংশ কোটা ও ৪৪ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, কোটা ৫৬ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। এমনকি তাঁরা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সরকার রেগেমেগে পুরোপুরি কোটাটা তুলে দিল। ফলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দির। সে সময় কোটা পুরোপুরি বাতিল না করলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

কোটার বিষয়ে সরকারের দ্বিমুখী দ্বিচারিতা আছে । সরকারি চাকরিতে কোটা থাকা কিংবা না থাকা উভয় ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতি হওয়া সমীচীন ছিল। কিন্তু সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোটা বাতিল করলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে ঠিকই সেটা রেখে দেয়। এসব পদে নিয়োগে দুর্নীতিরও অভিযোগ আছে।

যে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা রাখতে বদ্ধপরিকর, সেই সরকার শহীদ পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে লা–জবাব। তাঁদের জন্য কোনো সুবিধাই রাখা হয়নি। এখানে শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে আলাদা করা হয়েছে। কোটাসুবিধা ও বয়সসুবিধা নেওয়ার জন্য অমুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, সেই খবরও অজানা নয়। একাধিক সাবেক সচিব ভুয়া সনদ নিয়ে চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন।

একটি ভালো উদ্যোগ কীভাবে নষ্ট নয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা। প্রতিটি সরকারের আমলে নতুন তালিকা হয় এবং সেখানে নতুন নাম যুক্ত হয়। এমন ব্যক্তিও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, একাত্তরে যাঁর বয়স ছিল পাঁচ থেকে ছয় বছর।

কোটা নিয়ে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। আদালতে তারা কোটা বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু একই দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন আহমদ বলেছেন, কোটা বাতিল সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখতেই আপিল করেছেন।

তাহলে প্রশ্ন আসে, সরকার যে কোটা বাতিলের পক্ষে, সেই কোটার পক্ষে আন্দোলনকারীদের বাধা দিচ্ছেন কেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা? সরকারের এই দ্বিমুখী নীতি দেখে আবদুল আলীমের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানের কথাই মনে পড়ে। ‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো পুলিশ হইয়া ধরো, সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো’।

ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করেছে। এখন যদি তারা সেই অবস্থান থেকে সরে আসে,  তাহলে ছাত্রতরুণদের প্রতি সেটা প্রতারণা হবে। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে। আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না, আদালত কোটার পক্ষে। হাইকোর্টের রায় অনেক ক্ষেত্রেই আপিল বিভাগ বাতিল করে দেয়।

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, জনগণের আদালতের ওপরে কোনো আদালত নেই। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্তর্জাতিক আদালত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে গড়ে ওঠা আন্দোলন যদি অসাংবিধানিক না হয়ে থাকে, তাহলে কোটাবিরোধী আন্দোলন কেন অসাংবিধানিক হবে?

আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্মের নেতা  নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবির কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে আছে ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল; সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা, সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এখন কোটা ও পেনশন স্কিমের ওপর ভর করেছে। তাঁর এই দাবি হয়তো পুরোপুরি অযৌক্তিক নয়। যেকোনো  বিরোধী দল জনসমর্থনপুষ্ট আন্দোলনের প্রতি সহায়তা জানাবে, এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে তারাও জানাত।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কার ওপর ভরসা করছে?

prothom alo