- গোলাম মাওলা রনি
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
সেবার কী যে এক অদ্ভুত ঝামেলায় পড়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ২০১০ সালের দিকের ঘটনা। সে দিন বিকেলে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ঢোকার পর টের পেলাম, সবাই যেন আমার দিকে সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছেন। নির্ধারিত আসনে বসার সাথে সাথে সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ ব্যস্ত সমস্ত হয়ে আমার দিকে ছুটে এলেন। তিনি যেন বিব্রত এবং খানিকটা বিস্ময় চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলে আমাকে খবরটি জানালেন। বললেন, অধিবেশন শেষে প্রধানমন্ত্রী আমার সাথে জরুরি কথা বলবেন। আমি যেন প্রধানমন্ত্রীর লবিতে গিয়ে তার সাথে দেখা করি।
উল্লিখিত খবরের বাইরে আমার লেখালেখি-টকশো, সেমিনার-সংসদের বক্তব্য, সংসদীয় কমিটির বক্তব্য, ফেসবুকের স্ট্যাসাস ইত্যাদি নিয়েও ইতিবাচক এবং সাড়া জাগানো খবর প্রকাশিত হতো। তো প্রধানমন্ত্রী যে দিন আমায় জরুরি তলব করলেন সে দিন কোন বিষয়টি নিয়ে জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলো বোঝার জন্য আমি তাড়াতাড়ি সংসদ লাইব্রেরিতে গিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টাতে থাকলাম। সেখানে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার একটি ব্যানার হেড লাইন দেখে আমার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। যুগান্তর লিখেছে, এমপি রনির অভিযোগ! ‘প্রধানমন্ত্রীর কোনো চেইন অব কমান্ড নেই’। পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে বুঝতে পারলাম যে, গত রাতে চ্যানেল আই তৃতীয় মাত্রার টকশোতে আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম তাই বিকৃত করে ছেপেছে। পরে আমি কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর সামনে জোর গলায় জানালাম যে, আমি টকশোতে ওভাবে বলিনি। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন। ফলে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালাম।
আমি যখন রাজধানী ঢাকা অথবা দেশের অন্য কোনো বড় শহরে যাই তখন সেখানকার যানবাহন, রাস্তাঘাট, লোকজনের চলাফেলা, কথাবার্তা, গাছ-গাছালির ডালপালা, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর, ফুটপাথের কাঁচাবাজার, শ্রমজীবী মানুষের চাহনি দেখে বুঝতে পারি শাসন আসলে কিভাবে চলছে। আমাদের দেশের একটি প্রচলিত কথা হলো, মানুষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বোঝা যায় তার হাত-পায়ের নখ, অন্তর্বাসের দাগ বা গন্ধ এবং দাঁতের পরিচ্ছন্নতা দেখে। কেউ কেউ অবশ্য বাড়ির টয়লেটের পরিচ্ছন্নতা, সদর দরজার অবস্থা এবং বালিশের কভার ও বিছানার চাদরের অবস্থার ওপরও ব্যক্তির রুচি-অভিরুচি ও পরিচ্ছন্নতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে থাকেন।
কেউ যদি ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে জানতে চান তবে তার খানসামা-আয়া-বুয়া পিয়ন-ড্রাইভার, দারোয়ান এবং সাহায্য প্রার্থী ভিক্ষুকের সাথে যে সচরাচর ব্যবহার করেন সেটিই তার আসল চরিত্র বলে ধরা হয়। কোনো লোকের স্বার্থপরতা বোঝা যায় খাবার টেবিলে এবং সফরের সময়। মানুষের সাহস, আত্মত্যাগ, ধৈর্য, বুদ্ধি এবং বিনয় বোঝা যায় অতি সুখের সময় নতুবা অতি বিপদ-বিপত্তির সময়। মানুষের মূর্খতা প্রকাশ পায় তার বচনে এবং পাণ্ডিত্য প্রকাশিত হয় লিখনীতে। মানুষের কৃপণতা বোঝা যায় তখন যখন সে বণ্টনের অধিকার লাভ করে। অপব্যয়, লোভ-লালসা এবং ভোগের মাত্রা ধরা পড়ে যখন সে অন্যের ধনসম্পদ ব্যয় অথবা ভোগ করার সুযোগ পায়।
রাজ্য-রাজা-রাজধানীর ক্ষেত্রে উল্লিখিত সাধারণ সূত্র ছাড়াও আরো বেশ কিছু নিয়ামক রয়েছে যা দেখে বোঝা যায় সেখানে কে কিভাবে কেমন অবস্থায় আছে। যেমন ধরুন, রাজার বাড়িঘর যদি অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে তবে ধরে নেয়া হয় রাজাকে তার লোকজন সম্মান করে না এবং ভালোও বাসে না। রাজার সঙ্গী সাথীদের সততা, শিক্ষা, নিষ্ঠা এবং কর্তব্যপরায়ণতার ওপর নির্ভর করে রাজার সততা। সৎ রাজা কোনোকালে অসৎ লোকের সংস্পর্শে আসেন না। এ ক্ষেত্রে রাজার সৎ চরিত্র সূর্যের কিরণ এসিডের ঝলসে দেয়ার ক্ষমতা এবং আগুনের দগ্ধ করার ক্ষমতার মতো কাজ করে। ফলে সৎ রাজার কাছাকাছি হওয়া মাত্র অসৎ লোকেরা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
রাজা যদি জ্ঞানী হন তবে তিনি খামোশ থাকেন। নড়াচড়া কম করেন। তার পাত্রমিত্রদের অবস্থাও একই রকম হয়। রাজার লোকেরা কথা কম বলেন, কাজ বেশি করেন। তাদের কাজের ধরনও হয় অভিনব। তারা ছোটাছুটি লল্ফঝম্প ইত্যাদি করেন না অথচ অলৌকিকভাবে প্রতিটি কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সময় মতো সুচারুরূপে সমাধা হয়ে যায়। ভালো রাজা স্বল্পাহারী, মিতব্যয়ী এবং সত্যবাদী হয়ে থাকেন। কোনো রাজার স্বভাবে যদি মিথ্যাচার থাকে তবে তার মধ্যে যত গুণাগুণই থাকুক না কেন তা সব বিষে পরিণত হয়ে যায়। উত্তম রাজা ওয়াদার বরখেলাপ করেন না এবং নিজ দেহের অস্থিমজ্জার চেয়েও জনগণের অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দেন। যে রাজা যত বড় সেই রাজা ততোধিক সমপর্যায়ের মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্মানের ব্যাপারে সর্বদা সচেতন থাকেন। সমাজ সংসার রাষ্ট্রের উল্লিখিত সাধারণ সূত্রগুলো আপনি বর্তমান জমানার সুসভ্য শহরে বন্দর গ্রাম এবং পরিবারে গিয়ে যেমন দেখতে পাবেন তেমনই পৃথিবীর অসভ্যতম অঞ্চল বলে পরিচিত জনপদ পাহাড় সমুদ্র জঙ্গল ও মরুভূমিতে গিয়েও বুঝতে পারবেন। আপনি যদি বর্তমান জমানা বাদ দিয়ে মধ্যযুগ প্রাচীন যুগ লোহার তামা পাথরের যুগের পর্যটক হয়ে সারা দুনিয়া ঘোরেন তবুও সূত্রগুলোর কোনো গরমিল দেখতে পাবেন না। নিজে বর্তমান জমানার নামকরা সুসভ্য নগরগুলো বহুবার ভ্রমণ করেছি। বিশ্বের অনেক রাজা-বাদশাহ আমির ওমরাহর বাসভবন দেখেছি এবং রাষ্ট্রীয় দফতরগুলোও দেখেছি। আপনারা যারা আমার মতো কিংবা আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তারা দয়া করে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের চার দিক, সচিবালয়ের চার দিক, বাংলাদেশ ব্যাংক, গণভবন, বঙ্গভবন এবং মন্ত্রিপাড়ার চার দিকটা দেখে আসুন এবং শাসন সম্পর্কে ভাবুন।
উল্লিখিত স্থানগুলোদেখার পর আপনি রাজধানীর বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, হাসপাতাল এবং বড় বড় বিপণিবিতান ও কাঁচাবাজারগুলোর চার পাশটা চক্কর দিন এবং যা দেখলেন তা স্মরণ করুন। এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসস্থান ধানমণ্ডির সুধা সদনে আসুন। আমি আপনার সাথে সুধা সদনের চার দিকটা ঘুরব এবং যা দেখতে পাবো তা আজকের পাঠকদের জানাব।
সুধা সদনের সামনের রাস্তায় পা রাখামাত্র আপনি রাস্তার ওপর অসংখ্য ঝরাপাতা, বালির স্তর, কিছু পশুপাখির মল দেখতে পাবেন। আরো দেখতে পাবেন বহুকালের পুরনো একটি চাকাওয়ালা মুভিং বা চলমান জেনারেটর। এটির পাশে মাঝে মধ্যে চলমান একটি জীর্ণশীর্ণ পানির ট্যাংকও থাকে। তারপর সেখানে রাস্তার ওপর কয়েকটা টয়লেট বানানো হয়েছে। সম্ভবত বাড়িটির রক্ষী বা দায়িত্বরত পুলিশ আনসার বা অন্য নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য। আপনি যদি দয়া করে সেই টয়লেটের বিষয়ে একটু আগ্রহী হয়ে উঁকি মারেন তবে আপনার মনে সত্তরের দশকের একটি জনপ্রিয় শব্দ শটাং করে হাজির হয়ে যাবে। আপনি খুশিতে বলে উঠবেন এটা তো টয়লেট নয়, এটা হলো ঐতিহ্যবাহী টাট্টি। আপনি যদি সুধা সদনের যে অংশটিতে একটি স্টিলব্রিজ রয়েছে এবং লেকের মধ্যে একটি দ্বীপের মতো রয়েছে সেখানে যান তবে দেখতে পাবেন যে লেকের মধ্যে জাল দিয়ে এমন বাঁধ তৈরি করা হয়েছে যে পুরো লেকের ময়লা আবর্জনা এসে ওখানটাতে জমা হয়ে আলো বাতাসকে মুখরিত করে তুলেছে। এরপর আপনি ব্রিজের যে পাশটিতে পুলিশের তাঁবু রয়েছে সেখানে গিয়ে তাঁবু পুলিশ এবং সামনের রাস্তার দিকে যদি তাকান, দেখবেন মহিলা ও পুরুষ পুলিশরা কত গভীর মনোযোগ দিয়ে হাসিমুখে সুধা সদনের নিরাপত্তা নিয়ে পরস্পরের সাথে আলোচনায় মত্ত রয়েছে। তারা মাঝে মধ্যে ঝালমুড়ি, চা, সিগারেট এবং পান জর্দা খাচ্ছে এবং চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র এমনভাবে রেখেছে যা কিনা বিশ্বের যেকোনো নিরাপত্তাবাহিনীর জন্য একটি শিক্ষণীয় দৃশ্য বলে প্রতীয়মান হতে পারে।
আপনি যদি পুলিশের তাঁবুর উপরিভাগে তাকান তবে সেখানে কয়েক বছরের পুরনো ধুলোবালি এবং বিভিন্ন পাখির নানা রঙের মল মিলেমিশে একাকার হয়ে এক অপূর্ব দৃশ্যপট দেখতে পাবেন। তাঁবুর সামনের রাস্তার ভাঙাচোরা অবস্থা, টিন লোহা ও তারকাঁটা দিয়ে তৈরি কয়েক দশকের পুরনো কয়েকটা পুলিশি ব্যারিকেডের এলোমেলো অবস্থান, দুই একটা চলমান পানির ট্যাংকি। জরাজীর্ণ দুই চারটা পুলিশের গাড়ি এবং একটু দূরে ফুটপাথের উপর বড়সড় একটা চা পান বিড়ির দোকানের সামনে দায়িত্বরত পুলিশের জটলা দেখলে আপনি খুব সহজে বাংলাদেশের উন্নয়ন, শাসন এবং ‘প্রধানমন্ত্রীর লোক’ বলে গলা ফাটানো কীর্তিমানদের রুচি ও দায়িত্ব কর্তব্যবোধ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবেন।
আপনি যদি সামনের রাস্তা দিয়ে লেকের পাড়ে যে ওয়াকওয়ে রয়েছে সে দিকে এগোতে থাকেন তবে প্রথমে দেখবেন ছোট্ট একটা সেনা চৌকি। তারপর একটু দূরে একটা পুলিশের তাঁবু। তারপর আরেকটু দূরে যে বিশাল মসজিদ রয়েছে সেই মসজিদের পেছনে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত জঙ্গল এবং সেই জঙ্গলের পাশে বড়সড় আরেকটি পুলিশের তাঁবু। আপনার নাকে যদি সামান্য ঘ্রাণশক্তি থাকে তবে আপনি এই তাঁবুটির সামনে দাঁড়াতে পারবেন না। বিকট দুর্গন্ধ পাখিদের মল এবং ময়লা আবর্জনার জন্য ওখানে কারো পক্ষে এক মুহূর্ত দাঁড়ানো সম্ভব নয়। অথচ সেই বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও পুলিশ ভাইয়েরা আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে সদনের নিরাপত্তা নিয়ে যেসব সরব আলোচনায় মত্ত থাকে তা দেখার পর আপনার আর বুঝতে কিছুমাত্র বাকি থাকবে না, শাসন আসলে কেমন চলছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য