আহমাদ আব্দুল্লাহ : মাত্র কয়েকদিন আগেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষনে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর দম্ভে ভরে ইসরাইলকেন্দ্রিক নতুন একটি মধ্যপ্রাচ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার সেই স্বপ্নের মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য আরব দেশ থাকলেও ফিলিস্তিনিদের কার্যত কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অথচ আমলে না নেয়া সেই ফিলিস্তিন ইসরাইলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন হামাস বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমন চালিয়েছে ইসরাইলের ওপর। রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে ইসরাইল সাম্প্রতিক সময়ে কখনোই এতটা নাস্তানাবুদ হয়নি।
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস খুবই নিখুঁত একটি পরিকল্পনা করেছিল যা ইসরাইল অনুমানই করতে পারেনি। পরিকল্পনার আলোকেই তারা গাজা থেকে ইসরাইলী ভূখন্ডের ভেতরে প্রবেশ করে। আকাশপথে, স্থলপথে এমনকী নৌপথেও হামলা চালাতে শুরু করে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে যখন কয়েক হাজার মিসাইল ইসরাইলের বিভিন্ন লক্ষ্য অভিমুখে ছুটে যাচ্ছিল, ঠিক একই সময়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা আবার ইসরাইলের দক্ষিনাঞ্চলে সামরিক ও বেসামরিক কিছু স্থাপনায় হামলা করে। সবমিলিয়ে এই ঘটনায় সাত শতাধিক ইসরাইলী নিহত হয়, বিপুল সংখ্যক ইসরাইলী সেনা ও নাগরিকও আটক হয়। যাদেরকে ফিলিস্তিনিরা জিম্মি হিসেবে নিজেদের কাছে রেখেছে।
এই অভিযানের নেপথ্যে হামাসের যেসব উদ্দেশ্য ছিল, তার কোনোটিই গোপন নয়। প্রথমত, ইসরাইলী দখলদারি কার্যক্রমকে প্রতিহত করে বরং ইসরাইলকে কিছুটা পেছনে ঠেলে দেয়া। ইসরাইলের জুলুম, অবৈধ বসতি স্থাপন এবং মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনা বিশেষ করে আল আকসা মসজিদের পবিত্রতা বিনষ্ট করার বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় প্রতিরোধ করা।
দ্বিতীয়ত, আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মধ্য দিয়ে গোটা অঞ্চলে ইসরাইলকে যেভাবে পরাশক্তি বানানোর প্রক্রিয়ায় চলে গেছে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা । সর্বশেষ লক্ষ্য হলো আরেকটি কার্যকর বন্দী বিনিময় চুক্তি করার মতো প্রেক্ষাপট তৈরি করা। যাতে ইসরাইলী কারাগার থেকে গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের মুক্ত করে নিয়ে আসা যায়।
বন্দী বিনিময় ছাড়া নিজেদের নেতাদের মুক্ত করার আর কেনো কৌশল আপাতত হামাসের কাছে নেই। এ মুহুর্তে হামাসের গাজা শাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়াহিয়া সিনাওয়ার। তিনি নিজেও প্রায় ২২ বছর কারাবন্দী থাকার পর এভাবেই বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় মুক্তি পেয়েছিলেন।
হামাসের সামরিক শাখার বর্তমান প্রধান মোহাম্মাদ দেইফ ইসরাইলের বিরুদ্ধে খুবই আগ্রাসী। কারণ আরো অনেক ফিলিস্তিনি নাগরিকের মতোই তার নিজের প্রিয় সব মানুষগুলো ইসরাইলীদের হাতেই নিহত হয়েছে। তার নিষ্পাপ শিশু, তিন বছরের মেয়ে এবং স্ত্রী সবাই ইসরাইলী আক্রমনে নিহত হয়েছেন। তাই তার নেতৃত্বে হওয়া এবারের অপারেশনটি ছিল খুবই আক্রমনাত্মক ও কার্যকরী। এ কারণে এবারের হামাসের আক্রমনটি ইসরাইলের জন্য কেবল বিস্ময়কর ছিল না, রীতিমতো এক দু:স্বপ্নই ছিল।
ফিলিস্তিনিদের এবারের লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছে অপমান থেকে। ইসরাইলের অহংকারী ও দাম্ভিক নেতারা বিগত কয়েক মাস ধরে ক্রমাগতভাবে ফিলিস্তিনিদের অপমান করে আসছিলেন। নিজেদেরকে তারা অপ্রতিরোধ ও দুর্জেয় হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছিলেন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরবদের এরকম একটি আক্রমনেও তৎকালীন ইসরাইলী নেতৃবৃন্দ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে দেশটিতে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারাও বারবারই ফিলিস্তিনিদের ছোট বড়ো আক্রমনে বিস্মিতই হয়েছেন। তাদের কাছে আসলেই এটি একটি প্রশ্ন ছিল যে, এত বছরের জুলুম, বেকারত্ব ও দখলদারিত্বের পরও ফিলিস্তিন কীভাবে এসব অভিযান পরিচালনা করছে? তাদের সক্ষমতা আসলে কতটুকু তা নিয়েও ব্যাপক কৌতুহল ছিল ইসরাইলীদের।
১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে আগ্রাসন চালানোর পর লেবানিজরা যেভাবে প্রতিরোধ করেছিল তার জন্যেও ইসরাইল প্রস্তুত ছিল না। ইসরাইলীদের ৫০ বছরের দখলদারিত্ব এবং চারটি বড়ো যুদ্ধের পরও ফিলিস্তিনিরা ৮০’র দশকে প্রথমবার এবং এরপর ২০০০ পর যেভাবে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা করেছিল, তাও ইসরাইলীদের জন্য বিস্ময় জাগানিয়াই ছিল।
এবারও তাই ঘটেছে। ইসরাইলের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব হামাসের এত বিশাল অভিযান করার বিষয়ে আগাম কোনো ধারনাই করতে পারেনি। পুরো ঘটনাটিকে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা ও বিপর্যয় হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। যদিও ইসরাইলের একদম তৃণমূল পর্যন্ত গুপ্তচর নেটওয়ার্ক রয়েছে, অজস্ত্র ড্রোন এবং নজরদারি ডিভাইস চারিদিকে সক্রিয় রয়েছে, তারপরও হামাসের এই আক্রমনের বিষয়ে সামান্যতম আভাসও তারা পায়নি।
এরচেয়েও বড়ো কথা, এবারের আক্রমনে ইসরাইলের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নজিরবিহীন। শুধু সম্পদ বা কাঠামোর ক্ষতি নয়, বরং এবারের হামাস অভিযান ইসরাইলীদের জন্য রাজনৈতিক ও মনস্তত্বিকভাবেও বড়ো ধরনের বিপর্যয়। এতদিন যে দেশটি নিজেকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে বড়াই করে আসছিল, এবার তারা বিশে^র সামনে অসহায়, অপ্রস্তুত, দুর্বল এবং সাধারণ যোদ্ধাদের হামলা প্রতিরোধে অক্ষম হিসেবে প্রতীয়মাণ হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার যে স্বপ্ন তারা দেখতে শুরু করেছিল, এবারের হামলায় সেই স্বপ্ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। ইসরাইলী নাগরিকদের ঘরবাড়ি এমনকী শহর ছেড়ে পালানোর মতো অসংখ্য ভিডিও ও ছবি এখন নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো আগামী বহু বছর তাদেরকে দু:সহ স্মৃতি হিসেবেই তাড়িয়ে বেড়াবে। ৭ অক্টোবর দিনটি ইসরাইলের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক দিন। এতটা অপমানের মুখে এর আগে কখনোই তাদেরকে পড়তে হয়নি।
যা ঘটে গেলো, এরপর নেতানিয়াহু চাইলেও পরিস্থিতি আগের জায়গায় আর নিতে পারবেন না। বিশ্ববাসী একবার যা দেখে ফেলেছে নেতানিয়াহু হাজারবার চাইলেও তা মুছে ফেলতে পারবেন না। নিশ্চিতভাবেই ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এখন কৌশলগত ও সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের লোকসান পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। বড়ো ধরনের সামরিক অভিযান এরই মধ্যে তারা শুরুও করে দিয়েছে।
এসব হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বসে পড়ছে। ফিলিস্তিনের মানুষের জান ও মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে। আগেও এরকম বহু হামলা ইসরাইলীরা করেছে। কিন্তু বারবারই প্রমাণিত হয়েছে যে এসব হামলায় ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতিরোধ প্রয়াস কখনোই বন্ধ করা যায়নি।
সর্বশেষ ৭ অক্টোবরের ঘটনা তারই প্রমাণ। এ কারণে অনেকে এমনও মনে করছেন যে, ইসরাইল হয়তো এবার আক্রমনের দিকে প্রত্যাশার চেয়ে কম গিয়ে বরং গাজা ও পশ্চিম তীরের শহর ও উদ্বাস্তু শিবিরে সামরিক বাহিনীর মোতায়েন বৃদ্ধি করবে। এতে করে হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগঠনের কর্মীদের খুঁজে খুঁজে নিশ্চিহ্ন করাটা ইসরাইলীদের জন্য সহজ হবে।
ইসরাইলের সরকারের মধ্যে এমনও কিছু অংশীদার আছে যারা আরো বড়ো কিছুর স্বপ্ন দেখে। তারা পুরো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকেই ধ্বংস করতে চায়। ফিলিস্তিনের বর্তমান ভূখন্ডের অবশিষ্ট যা আছে সেগুলো দখলে নিয়েও গ্রেটার ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করাও তাদের অনেকের স্বপ্ন। কিন্তু এভাবে ফিলিস্তিনের মাটি ও মানুষ নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা ইসরাইলের জন্য আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করবে।
ইসরাইল এখন পুরো একটি যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। তেমনটা হলে ইসরাইল আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকটাই একা ও একঘরে হয়ে পড়বে। এমনকী পশ্চিমা নেতারা যেভাবে এতদিন ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে গেছে, তারা সেই সহায়তার মাত্রা কমিয়ে দিয়ে ইসরাইলীদের সাথে দুরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যেই ৭ অক্টোবরের ইসরাইলী বিপর্যয়ের পর এই অঞ্চলে তাদের কৌশলগত ও রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আরব যে দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবছিল তারাও হয়তো নিজেদের বোকামির জন্য এখন প্রতি মুহুর্তে আফসোস করতে শুরু করেছে।
এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় , নিজের ব্যর্থতা ও কোয়ালিশনের নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নেতানিয়াহু এবার মরনকামড় দেবেন। তবে সেই মরনকামড়ে তিনি যে সম্ভাব্য বন্ধুদের বন্ধুত্ব হারাবেন তাও অনেকটা নিশ্চিত। তার জন্য এখন আসলে উভয় সংকট। যে কৌশলেই তিনি অগ্রসর হন না কেন এর পরিণতি খুব একটা সুবিধাজনক হবে না।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যেমন একজন ব্যর্থ, অকার্যকর ও জনগনের সাথে সম্পর্কহীণ শাসক হিসেবেই বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়েছেন, নেতানিয়াহুর গন্তব্যও হয়তো সেদিকেই যাচ্ছে। আব্বাস নিজেও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তথাকথিত ভারসাম্যমূলক নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে। একদিকে তিনি যেমন ইসরাইলের দখলদারিত্বের নিন্দা করেন আবার অন্যদিকে তিনি ইসরাইলের সাথে সম্পর্কও উন্নত করার চেষ্টা করেন। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি চুড়ান্ত বিচারে কখনোই সফলতা পায়না।
তবে এত কিছুর ভেতর দিয়ে ভিন্ন একটি পরিবর্তন আসলে ঘটে গেছে। নেতানিয়াহু বা আব্বাসের পরিবর্তন বা তাদের সফলতা কিংবা ব্যর্থতার মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ নেই। সবচেয়ে বড়ো এই পরিবর্তনটি আসলে ঘটেছে দু দেশের মানুষের ভেতর। তারা এখন ভাবতে শুরু করেছে, এভাবে যুদ্ধ করেই কি তাদের জীবন যাবে নাকি শান্তিপূর্ন কোনো সমাধান হবে?
ফিলিস্তিনের মানুষ ৭ অক্টোবর জানিয়ে দিয়েছে তারা নিজেদের পায়ের ওপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাবে। লড়াই করতে করতে মারা যাবে এরপরও হাটু গেড়ে ইসরাইলীদের সামনে আর মাথানত করবে না। এমন পরিস্থিতিতে ইসরাইলী জনগণ তাদের আগামীর জন্য কী সিদ্ধান্ত নেয়, সবাই এখন সেদিকেই তাকিয়ে আছে।