কেন এত রক্তপাত!

আবু সাঈদ খান

সব আন্দোলনেই রক্ত ঝরেছে। বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও নব্বই সালে রক্ত ঝরেছে। তবে এত রক্ত ঝরেনি। এক সপ্তাহে দুই শতাধিক আন্দোলনকারী, পথচারী, ছাত্রলীগ ও পুলিশ প্রাণ হারিয়েছেন।
একদা পাখি শিকারে বাধা ছিল না। শিকারিরা পাখি দেখলেই গুলি করত। এমনকি পাখির ঝাঁকে ছররা গুলি চালাত। এতে ডজন ডজন পাখি মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। সম্ভবত সেখান থেকেই পাখির মতো গুলি করে মারার উপমাটি চালু হয়ে থাকতে পারে। এখন পাখি মারা নিষিদ্ধ। তবে উপমাটি চালু রয়েছে।

এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে বেপরোয়া গুলি বর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন, পুলিশ পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। এটি কি অতি কথন?
গৃহকোণে, বাড়ির ছাদেও মানুষ নিরাপদ ছিল না। হেলিকপ্টার থেকে বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সব ঘটনা সবিস্তারে সংবাদমাধ্যমে আসেনি। রাজধানীর এক কিশোরের মর্মস্পর্শী ঘটনাটি জেনেছি এভাবে– ‘জানালার পাশেই সামিরের পড়ার টেবিল, পড়ার বই, প্লাস্টিকের খেলনা, ঘরের মেঝেতে এখনও ছোপ ছোপ রক্ত। গত শুক্রবার জানালা দিয়ে আসা একটি বুলেট সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঝরে পড়ে ১১ বছরের সাফকাত সামির।’ (প্রথম আলো ২৪ জুলাই ২০২৪)। ১৯ জুলাই মিরপুরের কাফরুলে ঘটনাটি ঘটে। তখন সামিরের চাচা মশিউরের (১৭) কাঁধেও গুলি লাগে।

বড় ভাইদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে ধানমন্ডি এলাকায় মেধাবী কিশোর ফাইয়াজ মিছিলে গিয়েছিল। সে ছিল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র। বুকে গুলি লাগলে সতীর্থরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়।

আজিমপুরে সন্তানহারা এক বাবা আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমার ছেলের পায়ে গুলি করলে তাকে হারাতাম না।’ নারায়ণগঞ্জে বাড়ির ছাদে খেলার সময়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া।

১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পারলে আমার বুকে চালাও। তাঁর বুকে গুলি চালাতে পুলিশের হাত কাঁপেনি। ‘বীরত্ব’ দেখিয়ে গুলি আবু সাঈদের বুক ঝাঁজরা করে দিয়েছে। এভাবেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, বগুড়াসহ নানা স্থানে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করেছে, বর্বরতার স্বাক্ষর রেখেছে।
এ মৃত্যুযজ্ঞের দায় কেবল পুলিশের কিংবা আন্দোলন দমনের সহযোগী ছাত্রলীগ-যুবলীগের? আমি তা মনে করি না। দায় দেশের নীতিনির্ধারকদেরও নিতে হবে।

সবারই বোধগম্য, ২০১৮ সালেই কোটা সমস্যার সমাধান হতে পারত। তখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কার না করে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা বিলোপ করে সংকট জিইয়ে রাখে সরকার। সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটিতে তা অমান্য করা হয়।
২০১৮ সালের পরিপত্রটির মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল ২০২৪ সালে সৃষ্ট সমস্যার বীজ। সবারই জানা, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিপত্রটির বিরুদ্ধে রিট করলে হাইকোর্ট তা বাতিল করে দেন। বিষয়টি ছাত্রসমাজকে বিক্ষুব্ধ করে। তারা আন্দোলনে নামে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ। ১ জুলাই থেকে আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হয়ে উঠল। কিন্তু সরকারের টনক নড়ল না। ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হলো। বলা হলো, সরকারের কিছু করার নেই, আদালতেই সমাধান। উপরন্তু ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বললেন, আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় ছাত্রলীগ প্রস্তুত। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হওয়ার মধ্য দিয়ে সহিংসতার সূত্রপাত। দেখতে দেখতে দুই শতাধিক জীবন ঝরে গেল। সেতু ভবন, মেট্রোরেল স্টেশন, বিটিভি ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর প্রভৃতি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তখনই কেবল সরকার তৎপর হলো। অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল শুনানির তারিখ এগিয়েও আনা হলো। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, আদিবাসী ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হলো। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ১৫ জুলাইয়ের আগে এই পদক্ষেপ নিলে এতগুলো অমূল্য প্রাণ ঝরত না। প্রশ্ন হলো, এসব মৃত্যুর দায় কে নেবে?

সরকারের নানা ভাষ্যে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে। আগুন সন্ত্রাস ও নাশকতার জন্য জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। সরকারের কাছে এমন তথ্য-প্রমাণ থাকলে জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার; সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে রহস্য উন্মোচন করা দরকার। তার বদলে রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে। আসল রহস্য আড়ালে চলে যেতে পারে।
এটি সত্য, আন্দোলন এক পর্যায়ে কেবল ছাত্রদের ছিল না; ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। কোনো আন্দোলনই দীর্ঘদিন নির্দিষ্ট ছকে আটকে থাকে না, নানা ইস্যু যুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায় বেকার যুবক, ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, রেস্তোরাঁকর্মী, দোকানি, শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, লুটপাট, দুর্নীতি, বেকারত্ব, হতাশা, আয়বৈষম্য, সামাজিক বঞ্চনা, ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা ইত্যাদিতে ক্ষুব্ধ মানুষ মিছিলে যোগ দিয়েছিল। বিএনপি ও বাম দলগুলোর কর্মীরাও যোগ দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের একাংশও বিবেকের তাড়নায় আন্দোলনের সঙ্গে ছিল। হয়তো জামায়াত-শিবির ও ইসলামী দলের কর্মীরাও ছিল। কোনো বিবেচনায় তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা যায় না। ঘোলা জলে কেউ মৎস্য শিকারে নেমেছিল কিনা, তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি ছিল ছাত্র ও তাদের সমর্থক আম জনতা।

সরকারি ভাষ্য, বক্তৃতা-বিবৃতিতে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রাণহানির কথা বলা হচ্ছে না। মন্ত্রী-এমপিরা সন্তানহারা বাবা-মা, স্বামীহারা নারীকে সান্ত্বনা দিতেও গেছেন বলে শুনিনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সম্পদই বড়, মানুষের জীবন তুচ্ছ।

এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প মনে পড়ছে। তিনি আফগানিস্তানে গিয়ে শুনলেন, সবাই জীবন ও সম্পদকে মালজান বলে। তিনি জানতে চাইলেন, আমরা ‘জানমাল’ বলি। আপনারা কেন ‘মালজান’ বলেন? জবাব শুনে মুজতবা স্তম্ভিত। তারা বললেন, জান আমাদের অনেক আছে। কিন্তু মালের খুব অভাব। তাই মাল আগে, জান পরে। আমাদের রাষ্ট্রের কাঁধেও কি আফগান সংস্কৃতি ভর করেছে!
যেসব স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা মেরামত করতে পারব। কিন্তু দুই শতাধিক জীবন ফিরে আসবে না। প্রতিটি ব্যক্তির পেছনে রয়েছে একটি পরিবার, তাদের লালিত স্বপ্ন; যা কখনও পূরণ হবে না, সন্তানহারা মায়ের চোখের জল কখনও শুকাবে না, স্বামীহারা বধূর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না, পিতৃহারা শিশুর কান্না থামবে না। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, অন্তত স্বজনহারা পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা যেন অনাহারে না থাকে, এতিম শিশুরা যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। আর আহতরা যেন সুচিকিৎসা পায়।

শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনাও বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাডারমুক্ত করতে হবে। ক্ষমতাসীনসহ সব দলকে ছাত্রদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা ছাড়তে হবে। বরং নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সৎ ও মেধাবী নেতৃত্ব বিকাশে দৃষ্টি দিতে হবে।

আশু কর্তব্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা করা হবে না। হত্যাকাণ্ডে দায়ী পুলিশ বা অন্য ঘাতকদের খুঁজে আইনের আওতায় আনা হবে, সুষ্ঠু বিচার করা হবে। সেই প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হওয়া দরকার। একই সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনকে আত্মসমালোচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনোক্রমেই ঘটনার সামগ্রিক দায় তারা এড়াতে পারেন না।

আবু সাঈদ খান: লেখক ও গবেষক; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল

সমকাল