রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ আয়োজনের লক্ষ্যে বিদেশি কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ সফল করার লক্ষ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকরা দফায় দফায় নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করছেন। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তবে ‘স্পর্শকাতরতার বিবেচনায়’ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে চলমান উদ্যোগ নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। ঢাকায় নির্ভরযোগ্য সূত্র যুগান্তরকে সংকট নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা নিশ্চিত করেছে।
সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, সংলাপ অবশ্যই নিঃশর্ত হতে হবে। এছাড়া, ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন হাস। এ বৈঠকের ফলাফল উভয়পক্ষ গোপন রেখেছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধানের আওতায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংলাপ করার ব্যাপারে সরকারের দরজা খোলা রয়েছে। কুক বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতা ড. আব্দুল মঈন খানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গেও ব্রিটিশ দূতের বৈঠক হয়েছে বলে হাইকমিশনের ফেসবুক পেজে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সংলাপের লক্ষ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতার মুক্তি প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসাবে ভারতকেও এ উদ্যোগে জড়িত করার চেষ্টা করছে দেশগুলো। সূত্রমতে, বাংলাদেশে ভালোমানের নির্বাচন করার বিষয়ে ভারতেরও দ্বিমত নেই। দিল্লির এ অভিমত ঢাকাকে কূটনৈতিক চ্যানেলে জানানো হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। ৮ অক্টোবর কলকাতায় সুন্দরবন ও জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক ভারত সফরে যেতে পারেন। এই সুযোগে তিনি কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ উপদূতাবাসের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ নিয়ে মতবিনিময় করতে পারেন। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের পাশাপাশি কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপদূতাবাসও বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখে। কুক এই সুযোগে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা শুক্রবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বাংলাদেশে ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নির্বাচন নিয়েও আলোচনা করেছেন।
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্যে বিদেশি কূটনীতিকরা বরাবরই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আসছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো হস্তক্ষেপ করতে চান না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে সংকটের সমাধান করুক সেটাই তারা চান। কূটনীতিকরা এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হোক-এটা চান না বিধায় তারা প্রকাশ্য কোনো তৎপরতায় থাকবেন না। পর্দার আড়ালে থেকেই সমাধান সূত্র বের করার চেষ্টা করছেন। যদিও অতীতে বিদেশিদের উদ্যোগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সফলতা খুব বেশি দৃশ্যমান নয়।
দেশগুলো সম্প্রতি এক যুক্ত বিবৃতিতে সহিংস ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের তরফে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার দিনক্ষণ কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ায় কূটনৈতিক মহলে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। কূটনীতিকরা আশা করছেন, বিএনপি চলমান ২ দিনের অবরোধ কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক কোনো কর্মসূচিতে না গিয়ে কিছুটা সময় দিলে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ‘স্পেস’ পাওয়া যাবে। কূটনৈতিক উদ্যোগ সফল করার জন্য বিশেষ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হতে পারে। লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক পিছিয়ে যাওয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন কূটনীতিকরা। ৫ নভেম্বর এ বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ৯ নভেম্বর নির্ধারণ করেছে রাষ্ট্রপতির দপ্তর। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে চার নির্বাচন কমিশনারই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করা দীর্ঘদিনের রীতি রয়েছে। কমিশন এরই মধ্যে ১ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদের ৫ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বর্তমান সংসদের মেয়াদ ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি শেষ হবে। এক্ষেত্রে ৯০ দিনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে। বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আওয়ামী লীগের এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রপতি বড় ধরনের অপারেশন করার কারণে পূর্ণ বিশ্রামে আছেন। তাই তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের কর্মসূচি পিছিয়েছে। তবে ৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর নির্বাচন কমিশন ১২ নভেম্বর তফশিল ঘোষণা করতে পারে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কূটনীতিকরা সংবিধানের বাইরে গিয়ে আলোচনা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন না বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের বাইরে যেতে মোটেও রাজি নন। বিএনপি বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে সংলাপে অংশ নিতে রাজি হলে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনকে বেসামরিক ও পুলিশ প্রশাসনে রদবদল করে সমান ক্ষেত্র প্রস্তুত করার মতো ইস্যু সামনে আসতে পারে। পুলিশ হত্যা, হাসপাতালে হামলা করে অ্যাম্বুলেন্স পোড়ানো, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা এবং জ্বালাও-পোড়াও ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়িতদের বিষয়টি রাজনৈতিক মামলায় না আনাও বিবেচ্য হতে পারে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজনীতি এমন একটা জিনিস যার মধ্যে আলাপ-আলোচনা থাকবেই। তবে এর জন্যে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করে বিএনপির জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত আগে। এমন তাণ্ডব আমরা ২০১৩-১৪ সালেও দেখেছি। তাণ্ডব অব্যাহত রেখে আলোচনা হতে পারে না। যে কোনো আলাপ-আলোচনা সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে হতে হবে।’
সংলাপের ব্যাপারে বিদেশিদের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিএনপি মানুষ পোড়াচ্ছে, হাসপাতালে আগুন দিচ্ছে। এটা তো তাদের প্রভুরা থামাতে পারছে না। আমরা বিদেশিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। কিন্তু বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে আমরা পরিচালিত হব না। বাংলাদেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ। আলোচনা চাইলে সংবিধান মেনে আসতে হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার বিএনপির ওপর যে ধরনের সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে সেখানে কীভাবে আলোচনা সম্ভব। এটা সরকারের ফ্যাসিস্ট আচরণ। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, কিসের আলোচনা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটা জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এটা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এজন্য আমরা চাই, বর্তমান সরকার পদত্যাগ করুক, সংসদ বিলুপ্ত করুক। এটা আমাদের কোনো শর্ত নয়। এটা আমাদের দাবি।’
যুগান্তর