কুশাসক-সুশাসক নির্ণয়ের দাঁড়িপাল্লা!
- গোলাম মাওলা রনি
- ১৫ এপ্রিল ২০২১, ২১:০৬
মহামতি প্লেটোর একটি অমিয় বাণী দিয়ে আজকের নিবন্ধটি শুরু করতে চাই। প্লেটো বলেছেন, শাসন করার অভিলাষ দিয়েই কুশাসক-সুশাসক নিরূপণ করা যায়। সুশাসকরা ক্ষমতার জন্য লালায়িত হন না- ক্ষমতা পাবার জন্য অনাসৃষ্টি সৃষ্টি করেন না এবং ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য অন্যায়-অনিয়ম এবং পাপাচার করেন না। তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ সব সময়ই তাদের অভিলাষ বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে এবং ক্ষমতা পরিচালনার ব্যাপারেও তাদের অনাগ্রহ প্রবল থাকে। কেবলমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে তারা ক্ষমতায় থাকেন এবং যে কোনো সময় ক্ষমতা ত্যাগ করার জন্য উসিলা খুঁজতে থাকেন। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা, সমর্থন এবং সহযোগিতার কারণে এসব সুশাসক প্রায়ই ক্ষমতা ছাড়ার সুযোগ পান না।
প্লেটোর অমিয় বাণীতে যে অভিলাষের কথা বলা হয়েছে, সেখানে শাসন কবার অনাগ্রহ যাদের প্রবল থাকে তারাই কেবল সুশাসক হতে পারেন। কিন্তু যারা সর্বদা শাসক হওয়ার জন্য লালায়িত থাকেন এবং শাসন করার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন তারা কোনোকালে সুশাসক হতে পারেন না। এরা প্রায়ই কুশাসকরূপে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে জমিনে জীবন্ত গজবরূপে সাধারণ মানুষের ঘৃণা ও বদদোয়ার উপলক্ষ হিসেবে বিরাজ করেন। এরা কোনোকালে আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারেন না এবং অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে ক্ষমতাহীন অবস্থায় ইহলীলা সাঙ্গ করেন। এদের শাসন করার অভিলাষও কোনোকালে সার্থকতা পায় না। কারণ জনগণ তাদের শাসকরূপে মেনে নেয় না। সুযোগ পেলে অবাধ্য হয়- বিদ্রোহ করে এবং প্রতিশোধ নিয়ে অভিলাষী শাসকদেরকে জনগণ উচিত শিক্ষা দিয়ে থাকে।
প্লেটোর উল্লিখিত বাণীটি তামাম দুনিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিগত আড়াই হাজার বছর ধরে অন্যতম প্রধান সূত্ররূপে নন্দিত হয়ে আসছে। এই সূত্রের আলোকে পৃথিবীর সর্বকালের কয়েকজন সেরা সুশাসক এবং নিকৃষ্ট কুশাসকের শাসন করার অভিলাষ, শাসক হবার কাহিনী এবং আনুষঙ্গিক ঘটনা বর্ণনা করলেই প্লেটোর চিন্তাধারার বাস্তবতা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আলোচনার শুরুতেই উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারোয়ানের কাহিনী বলছি। তিনি মুসলিম জাহানের খলিফারূপে মোট কুড়ি বছর দায়িত্ব পালন করেন। তাকে ঐতিহাসিকরা একবাক্যে উমাইয়া বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে থাকেন। নরমে গরমে, কৌশলে এবং বীরত্ব দ্বারা তিনি একটি ধ্বংসপ্রায় সাম্রাজ্যকে এমনভাবে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন যার কারণে ইতিহাসে উমাইয়া বংশ প্রায় নব্বই বছরের কৃতিময় গৌরবগাথা রচনা করতে সমর্থ হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে মুসলমানরা এশিয়া আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে শাসন করার সুযোগ লাভ করে। এ কারণে খলিফা আব্দুল মালিককে ফাদার অব দি কিং বা রাজেন্দ্র বলা হয়ে থাকে।
সুশাসক, বিজেতা, ন্যায়পরায়ণ বিচারক হিসেবে খলিফা আব্দুল মালিকের যে সুখ্যাতি রয়েছে তেমনি রাজ্যবিস্তারে, প্রতিপক্ষ দমনে এবং প্রজাদের কল্যাণের জন্য তিনি তার প্রতিপক্ষের ওপর যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন তা আজো মানুষের হৃদয়ে ভয়ঙ্কর এক অনুভূতির জন্ম দেয়। আব্দুল মালিকের সফলতা, কৃতিত্ব এবং সুনাম সুখ্যাতির কথা শুনে ইতিহাসের পাঠক যতটা না আশ্চর্য হন তার চেয়েও বেশি অবাক হন যখন তারা জানতে পারেন যে, খলিফা মনোনীত হবার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিকে প্রবলভাবে ঘৃণা করতেন এবং রাজসিংহাসন ও ক্ষমতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সারাক্ষণ ইবাদত ও বন্দেগি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি দিনরাতের বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকতেন এবং আল্লাহর ইবাদতে এতটা ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে, দ্বীন- দুনিয়ার কোনো খবর তার জানা ছিল না। তার এই অতিরিক্ত মসজিদপ্রীতির জন্য তৎকালীন জমানার লোকজন তাকে মসজিদের ঘুঘু বলে সম্বোধন করতেন।
রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রতি আব্দুল মালিকের বিতৃষ্ণার কারণ ছিল তার বাস্তব অভিজ্ঞতা। তিনি ৬৪৬ সালে মদিনাতে যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান রা:-এর জমানা। তার বয়স যখন দশ বছর তখন হজরত ওসমান বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তার পিতা মারওয়ান ইবনে হাকাস ছিলেন হজরত ওসমান রা:-এর প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ উজিরে আজম। সব ঐতিহাসিক একবাক্যে সাক্ষ্য দেন যে, মারওয়ানের কূটকৌশল, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির কারণেই হজরত ওসমান রা: নির্মম পরিণতির শিকার হন। ফলে তার শাহাদত বরণের পর সবার ক্রোধ ও ঘৃণা গিয়ে পড়ে মারওয়ানের ওপর। এ অবস্থায় তিনি মদিনা থেকে পালিয়ে দামেস্কে চলে যান হজরত মুয়াবিয়া রা:-এর আশ্রয়ে। পরবর্তী সময়ে তিনি অত্যন্ত কৌশলে তার পরিবারবর্গকেও দামেস্কে নিয়ে আসেন।
চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রা:-এর পুরো জমানা ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, গুপ্ত হত্যা এবং রাজনীতিতে বেঈমানি, মোনাফেকি, রক্তপাত, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতির এক নিকৃষ্ট উপাখ্যান। ফলে মারওয়ানপুত্র আব্দুল মালিক তার শৈশব কাল থেকে যা দেখেছেন এবং যে নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তা তাকে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। বিশেষ করে তার পিতা যখন হযরত আলী রা:-এর হাতে বন্দী হলেন এবং ইমাম হাসান রা:-এর বাদন্যতায় মুক্তি পেলেন এবং পরবর্তী সময়ে ইমাম হাসান রা: যখন হজরত মুয়াবিয়া রা: এবং মারওয়ানের যৌথ কূটচালে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হলেন এবং বিষ প্রয়োগে নিহত হলেন তখন কিশোর আব্দুল মালিকের সহৃদয়-মন নিদারুণভাবে আহত হলো। আমির মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণ, কারবালার যুদ্ধ, ইয়াজিদের নির্মম মৃত্যু এবং মারওয়ানের খলিফা হওয়ার দৃশ্যপট এবং পর্দার অন্তরালের হাজারো রক্তাক্ত ঘটনা আব্দুল মালিককে বিষণœ করে তুলেছিল। ফলে তিনি দুনিয়ার সব কিছু পরিত্যাগ করে সারাক্ষণ মসজিদে পড়ে থাকতেন। এ অবস্থায় ছেলেকে সিংহাসনমুখী করার জন্য মারওয়ান তার উপদেষ্টারূপে আব্দুল মালিককে নিয়োগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে মিসরের ডিপুটি গভর্নর ও প্যালেস্টাইনের গভর্নর পদে মনোনয়ন দেন। কিন্তু আব্দুল মালিকের অনাগ্রহ এবং উদাসীনতা মারওয়ানকে ব্যথিত করে। এই পর্যায়ে তিনি তার উত্তরাধিকারীরূপে মালিকের পরিবর্তে তার অন্য পুত্র আবদ আল আজিজকে মনোনয়ন দেন। কিন্তু মিসর জয়ের প্রাক্কালে আবদ আল আজিজ নিহত হলে খলিফা মারওয়ান আব্দুল মালিককে তার উত্তরাধিকার নিয়োগ দিয়ে দলিল সম্পাদন করেন ৬৮৫ সালের শেষ দিকে।
আব্দুল মালিক-দ্বীন-দুনিয়া ভুলে সারাক্ষণ মসজিদে বসে ইবাদত বন্দেগিতে এতটা মগ্ন ছিলেন যে, খলিফা হিসেবে তার মনোনয়ন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। অন্য দিকে তার পিতা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিহত হবার সময়ও তিনি মসজিদে ছিলেন এবং রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তারা যখন মসজিদে এসে আব্দুল মালিককে দুটো খবর দিলেন যে, খলিফা মারওয়ানকে খুন করা হয়েছে এবং তাকে পরবর্তী খলিফারূপে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তখন তিনি পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায় ছিলেন। তিনি কুরআন পড়া বন্ধ করে ভাবলেশহীনভাবে রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনলেন এবং মহা বিরক্ত হয়ে আপন মনে বিড় বিড় করতে করতে প্রাসাদ অভিমুখে রওনা দিলেন।
খলিফা আব্দুল মালিকের মতো খলিফা দ্বিতীয় ওমর রা: অর্থাৎ ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের ক্ষমতা লাভ ও তার অভিলাষের বিরুদ্ধে হয়েছিল। আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের কাহিনীও প্রায় একই রকম। অন্য দিকে, অটোমান সম্রাটদের মধ্যে যিনি কিংবদন্তির বীর, নির্লোভ সম্রাট, সুশাসক ও বিজেতারূপে স্বীকৃত তার নাম সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ যিনি কোনো দিন সম্রাট হতে চাননি। অধিকন্তু নিজ সন্তান দ্বিতীয় মুহাম্মদের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করে অবসরে চলে যান। এই যুগান্তকারী ঘটনার তিন বছর পর রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাজ অমাত্যরা আবার তাকে জোর করে দ্বিতীয়বারের মতো খলিফারূপে নিযুক্তি দেন। প্রথম দফায় সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ চব্বিশ বছর রাজত্ব করেন এবং দ্বিতীয় দফায় করেন পাঁচ বছর। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদ পুনরায় খলিফা হন।
সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের মতো তার পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদও ছিলেন ক্ষমতার প্রতি অনাগ্রহী কিংবদন্তির সুশাসক, ইতিহাস যাকে-বিজেতা মুহাম্মদ অর্থাৎ মুহাম্মদ দ্য কনক্যুয়ারার উপাধিতে ভূষিত করেছে। কারণ তিনিই এক হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয় করেছিলেন এবং তার ব্যাপারেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
ইতিহাসের উল্লেখিত সুশাসকবৃন্দের বিপরীতে যদি আমরা কুশাসকদের ক্ষমতা লাভের লালসার বিষময় ইতিহাস বলি তবে একেকজন দুরাচারের লোভ-লালসার ইতিবৃত্ত নিয়ে একেকটি মহাকাব্য রচনা করা সম্ভব। ক্ষমতা লাভের পর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার কাহিনী এবং প্রায় সব ক্ষেত্রে কুশাসকদের নির্মম পরিণতি, অপমানজনক এবং বেদনাদায়ক মৃত্যু এবং তাদের বশংবদদের নাজেহাল হবার কাহিনীগুলো নিয়েও একাধিক মহাকাব্য রচিত হতে পারে। কুশাসকেরা তাদের জন্মের পর থেকেই একটি বিরূপ পরিবেশের শিকার হন এবং সুশাসকদের মতো ইতিবাচক চিন্তা না করে নেতিবাচক চিন্তা এবং প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বেড়ে ওঠেন।
চেঙ্গিস-হালাকু-হিটলার-মুসোলিনিসহ অন্যান্য নিকৃষ্ট শাসকের জন্ম-শৈশব-কৈশোর এবং ক্ষমতা লাভের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আপনি যে সমীকরণ পাবেন ঠিক একই সমীকরণ পাবেন ইরান-তুরান-উগান্ডা-বুগান্ডার কুশাসকদের চরিত্রে।
এখন প্রশ্ন হলো, সুশাসকরা কেন ক্ষমতার প্রতি নিরাসক্ত থাকেন এবং শাসন করার ব্যাপারে অনাগ্রহী মনোভাব পোষণ করেন! অন্য দিকে কুশাসকরা কেন নিজেরা রক্তের বন্যার মধ্যে পতঙ্গরূপে ভাসতে ভাসতে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে যাবার পর রক্তকে ভয় না পেয়ে উল্টো রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার জন্য অথবা রক্ত দিয়ে হোলিখেলার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন! বিষয়টি জটিল এবং গবেষণার বিষয়। সুতরাং অনাগত দিনে সময় সুযোগ হলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার আশা পোষণ করছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
সাবেক সংসদ সদস্য