দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোয় সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয় চরমভাবে। ফলে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে জাহাজীকরণ করা যায়নি। এর প্রভাব পড়ে কার্যাদেশে। তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্যাদেশ চলে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোয়। কারো কারো দাবি, এর পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশের মতো হবে। এতে সামনের বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমে যেতে পারে ৬ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, সম্প্রতিক সময়ে পোশাক খাতে কার্যাদেশ কমেছে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত।
এমন শঙ্কার মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি বেড়েছে সাড়ে ২১ শতাংশ। নগদ প্রণোদনা কমিয়ে দেয়া এবং গ্যাস সংকটের কারণে স্থানীয় উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার কারণেই পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি হয়েছে ৪৪৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৩৬৮ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। তুলা, সুতা, বস্ত্রসহ সব ক্যাটাগরির পণ্য আমদানিই এ সময়ে বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে বস্ত্র ও এ-সংক্রান্ত পণ্য। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে ২০৬ কোটি ১৬ লাখ ডলারের বস্ত্র আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময় হয়েছিল ১৬৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের। এক বছরের ব্যবধানে বস্ত্র আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি করেছেন উদ্যোক্তারা। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে পণ্যটি আমদানি হয়েছে ৯৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের, আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৮৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের। এ সময় তুলা আমদানি বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও জুলাইয়ে দু’দফায় রফতানিতে নগদ সহায়তার পরিমাণ কমিয়েছে সরকার। এতদিন দেশী সুতা ও বস্ত্র ব্যবহার করে উৎপাদিত তৈরি পোশাক রফতানি করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নগদ সহায়তা পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। তবে প্রণোদনা কমানোয় উদ্যোক্তাদের মুনাফা মার্জিন কমে গেছে। অন্যদিকে বেড়ে গেছে পোশাক উৎপাদনের ব্যয়। এ অবস্থায় ব্যয় কমাতে রফতানিকারকরা তুলা ও বস্ত্র আমদানির দিকে ঝুঁকছেন বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
তৈরি পোশাক খাতের কার্যাদেশ কমার পরও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। কার্যাদেশ না কমলে আমদানি আরো অনেক বেশি হতো বলে মনে করছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে রফতানিতে প্রণোদনা কমিয়ে দেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না। যার খেসারত বর্তমানে দিতে হচ্ছে এবং এ কারণে আমদানি বেড়েছে। প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই আমরা আমদানি বাড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের অজুহাত দেখিয়ে প্রণোদনা বন্ধ করা হয়েছে। এটি ২০২৬ সালেও বন্ধ করা যেত। এমনকি ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুসারে আরো তিন বছর পর্যন্ত প্রণোদনা বহাল রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে অদৃশ্য কারণে কারো স্বার্থ হাসিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ সহায়তা কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয়। নগদ প্রণোদনা কমানোর ফলে দেশী সুতা কিনতে যে খরচ পড়ে তার চেয়ে কম দামে সুতা আমদানি করা যায়। ফলে খরচ বাঁচাতে স্বাভাবিকভাবেই রফতানিকারকরা সুতা বেশি আমদানি করছেন। এতে মূল্য সংযোজনও কমেছে। গ্যাস সংকটের কারণে বস্ত্র কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। এর কারণেও বস্ত্র আমদানি বেড়ে গেছে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৯২৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৮৮২ কোটি ডলারের পণ্য। এক্ষেত্রে রফতানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ সময়ে নিট, ওভেন ও বিশেষায়িত বস্ত্র পণ্য রফতানি বেড়েছে। অন্যদিকে কমেছে হোম টেক্সটাইল রফতানি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতা আন্দোলনকে ঘিরে ইন্টারনেট বন্ধ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার প্রভাব পড়েছে তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদনের ওপর। এরপর সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন আবারো বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘটনার সম্মিলিত প্রভাবে পোশাক খাতের কার্যাদেশ কমেছে এবং এতে সামনের দিনগুলোয় পোশাক রফতানি কমতে পারে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট ও ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে রফতানির তথ্য বেশি দেখানো হয়েছে এবং এ কারণে আমদানি কম হয়েছে। এখন রফতানির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের অতিরঞ্জিত তথ্যের সঙ্গে বর্তমানের প্রকৃত তথ্যের তুলনা করেছে কিনা সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৫ শতাংশ রফতানি বেড়েছে। রফতানির প্রকৃত তথ্য প্রকাশের কারণে এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আমদানি বাড়বে। আগের বছরে তুলা আমদানি কম হয়েছিল, যেটি বর্তমানে বেড়ে গেছে। তাছাড়া গ্যাস সংকটের কারণে স্থানীয় সুতা উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে রফতানিকারকরা সুতা বেশি আমদানি করেছেন। এর প্রভাবেও আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে। আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেক কারখানায় কাজ কমে গেছে। ইউরোপে আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে এ বাজারে চীন ও পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি বেশি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। অন্যদিকে এখানে ভিয়েতনাম ও চীনের ভালো প্রবৃদ্ধি রয়েছে।’
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা আমদানি করা কাঁচামালের বড় অংশই এনেছেন ভারত থেকে। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশটি থেকে বাংলাদেশে ১৭৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের তুলা রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২৪ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সে হিসাবে তাদের রফতানি বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। পাশাপাশি এ সময়ে ভারত থেকে ফ্যাব্রিকস আমদানিও বেড়েছে। সুতা ও বস্ত্র রফতানি বাড়ার কারণে প্রতিবেশী দেশটির বৃহৎ টেক্সটাইল কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় বড় বাজার হয়ে উঠেছে। ভারতের লাহোটি ওভারসিজ লিমিটেড, স্কয়ার করপোরেশন, ইন্দোরামার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদিত সুতার উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশে রফতানি করে। সম্ভাবনার কারণে আকৃষ্ট হয়ে ভারতের আরো বেশকিছু কোম্পানি বাংলাদেশে সুতা রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। কভিড-পরবর্তী হঠাৎ করে আমদানি অনেক বেড়ে যাওয়ার আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে তুলা ও বস্ত্র আমদানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে অর্থ পাচারের সংযোগ রয়েছে কিনা সেটিও যাচাই করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের কাছ থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের মতামত শুনে আসছি। কেউ বলছেন পোশাকের কার্যাদেশ কমে গেছে, কেউ বলছেন এটি ঠিক না, আবার কেউ বলছেন যে কার্যাদেশ কমলেও সেটি খুব বেশি নয়। কাঁচামাল আমদানি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নির্দেশ করে যে বেশি কার্যাদেশ থাকার কারণেই এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে উপসংহার টানার জন্য আমাদের আরো তথ্যের প্রয়োজন রয়েছে।’
Bonik Barta