এক বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমা দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপে থাকায়– সেখান থেকে রপ্তানি কার্যাদেশ আসাও কমেছে। ফলস্বরূপ; অন্তত ২০ শতাংশ নিম্ন সক্ষমতায় কারখানা চালাতে হচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারকদের। তার সঙ্গে দেশে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতা, গোলযোগ তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে শুরু করলে– রপ্তানি কার্যাদেশ বৃদ্ধির আশা করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। কিন্তু, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখন ব্যবসার জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠেছে। এতে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতাই সময়মতো তাদের পণ্যের চালান পাওয়ার বিষয়ে সংশয়ী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সার্বিক অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন আশঙ্কার কথাই জানান তারা।
দেশের একটি অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান- প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড)-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মোহাম্মদ তানভির বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমরা আমাদের উৎপাদন ও রপ্তানি চালানের মসৃণ, বাধাহীন কার্যক্রম বজায় রাখতে চাই।”
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির-ও সহ-সভাপতি তানভির। তিনি বলেন, “বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে– এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত না হতে আমরা দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একান্ত অনুরোধ জানাই।”
এমন উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এর কথাতেও। তার মতে, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার সুবাদেই রপ্তানি ও অর্থনীতি বিকশিত হতে পেরেছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় পোশাক রপ্তানিকারকদের কাছে কার্যাদেশ আসা কমে যায়। পাশাপাশি, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধও তাদের ব্যবসাকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
“এই অবস্থায় যদি দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বায়াররা শঙ্কিত হবে, যা আমাদের ব্যবসার পক্ষে মোটেও অনুকূল হবে না। চলমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এই ধরনের আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারবেন না পোশাক রপ্তানিকারকেরা”- যোগ করেন তিনি।
“রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো না থাকলে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ব্যবসা, বাণিজ্য-ও তার ভুক্তভোগী হবে”
বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬.৬৭ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশের রপ্তানি পৌঁছায় ৫৫.৫৫ বিলিয়ন ডলারে। এর পেছনে মূল অবদান ছিল পোশাক খাতের শক্তিশালী পারফর্ম্যান্সের। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। কিন্তু, বৈশ্বিক চাহিদার মন্দা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক সংকট এবং পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে রপ্তানি আয় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪.২৮ শতাংশ কম হয়েছিল।
রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে এম শহিদ রেজা জানান, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তিনি অর্ডার বাড়বে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক বায়ার ধীরেসুস্থে অর্ডার দিচ্ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, “কয়েক মাস চেষ্টার পর সম্প্রতি আমরা এক কাস্টমারের থেকে অনুমোদন পাই। কিন্তু, সেই কাস্টমার এখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলছে।” রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কোরিয়ার একটি কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগের প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি টেক্সটাইল (বস্ত্র) উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “বর্তমানে এই শিল্পের অধিকাংশ ফ্যাক্টরি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে বেশিরভাগ টেক্সটাইল মিল মালিকরা পুঁজি সংকটে রয়েছেন। এরমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।”
ইউটিলিটি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ব্যবসায় গতি না থাকায় পুঁজি সংকটের মতোন নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
একজন রপ্তানিকারক আরও জানান যে, প্রায় ৪ মাস আগেই জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দিতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বায়ার তাকে সতর্ক করেছিলেন। একারণে তারা সতর্কভাবে অর্ডার দিচ্ছেন।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্ডার দেওয়ার বিষয়ে পশ্চিমা ক্রেতারা বেশি সতর্ক থাকে বলেও জানান তিনি।
গত ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে বিচ্ছিন্ন কিছু রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা ঘটলেও – ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর – দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শান্তি বজায় ছিল।
কিন্তু, বিএনপি বর্তমান সরকারের পতন ও নির্দলীয় নির্বাচন-কালীন সরকার প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবি ঘোষণার পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। এপর্যায়ে উভয় দলের পক্ষ থেকেই পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও মিছিলের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
এমতাবস্থায়, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থার সম্পর্ক তুলে ধরে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন মন্তব্য করেন, “রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো না থাকলে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ব্যবসা, বাণিজ্য-ও তার ভুক্তভোগী হবে।”
তিনি বলেন, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা।
গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক রুপান্তর ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে হরতাল, অবরোধের মতোন কর্মসূচি না নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের পুরোনো কৌশলের আঘাত সইতে পারবে না। “অর্থনীতি ও ব্যবসার সমৃদ্ধি, বিকাশের জন্য আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই।”
নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক বায়িং হাউজের হেড অব বিজনেস বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে, গোলযোগের আশঙ্কা থেকে অনেক বায়ার নিজেদের সরবরাহ চক্রকে সুরক্ষিত রাখতে ভারতমুখী হচ্ছে।
সব বায়ার-ই একটি স্থিতিশীল দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে চান। এছাড়া, কিছু ব্যক্তি-বিশেষের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা-নীতিও তাদের আরও সতর্ক হতে বাধ্য করেছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা অনুসরণ করে– সেকথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরাও।
সকল দলের প্রতি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দলীয় কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ পালনের আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, নাহলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়ে পতন হবে রপ্তানি আয়ের।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পড়ায় দেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
সকল রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। একইসঙ্গে, সকল নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান – পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, “যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতাই ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য নেতিবাচক। ইতোমধ্যেই সামষ্টিক-অর্থনীতির বিভিন্ন অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আমদানির বিধিনিষেধ ব্যবসাবাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।”