কারামুক্ত বিএনপি নেতাকর্মীর মালপত্রের হদিস নেই

কারামুক্ত বিএনপি নেতাকর্মীর মালপত্রের হদিস নেই.

কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলেও মালপত্র ফেরত পাচ্ছেন না বিএনপির নেতাকর্মী। বারবার সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে ধরনা দিয়েও হদিস মিলছে না মালপত্রের। এসব জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছে– মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ঘড়ি, মানিব্যাগ ও নগদ অর্থকড়ি। গ্রেপ্তারের সময় সঙ্গে থাকা ওই সব মালপত্র নিয়ে গেলেও এখন তা অস্বীকার করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অবশ্য বিএনপি নেতাকর্মীর এ অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করছে পুলিশ।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর রাজধানীর গুদারাঘাটের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের নেতা আল আমিন ও ছাত্রদলের আরেক নেতা। গ্রেপ্তারের সময় তাদের দু’জনের পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং ওই বাসার বাসিন্দাদের আরও দুটি ফোন ও একটি ল্যাপটপ নিয়ে যায় পুলিশ। গত ২৬ জানুয়ারি তারা দু’জনই জামিনে মুক্তি পান; কিন্তু ওই সব মালপত্র এখনও ফেরত পাননি। গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় কারাগারে ছিলেন তারা। আল আমিন বলেন, ‘মোবাইল ফোন-ল্যাপটপ কিছুই পাচ্ছি না। আনতে গেলে পল্টন থানা পাঠাচ্ছে গোয়েন্দা কার্যালয়ে, আবার গোয়েন্দা পুলিশ পাঠাচ্ছে পল্টন থানায়! ল্যাপটপ না পেলে তাঁর রুমমেটকে কিনে দিতে হবে।’

একই কলেজ ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক হামদে রাব্বী আকরাম গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হন গত ২২ নভেম্বর। তাঁর দাবি, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তারা মোটরসাইকেল (ঢাকা মেট্রো-ল-৫২-২৯২৯, ইয়ামাহা এফজেড), মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে নেয়। গাড়ি ভাঙচুর মামলায় প্রায় দেড় মাস কাশিমপুর কারাগারে থাকার পর ১১ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। আকরাম বলেন, ‘কারাগার থেকে মুক্তি মিললেও মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ফেরত পাইনি।’

গ্রেপ্তারের পর আকরামকে রাজধানীর পল্টন থানায় সোপর্দ করা হলেও ওই সব মালপত্র সেখানে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে থানা পুলিশ। সিটিটিসি বলেছে, সেগুলো আলামত হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু মামলার জব্দ তালিকায় মোবাইল ফোন ও মোটরসাইকেলের কথা উল্লেখ নেই বলে দাবি করেছেন ছাত্রদল নেতা আকরাম।

এ ব্যাপারে সিটিটিসির এসি নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘ছাত্রদল নেতা আকরামকে রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তাঁর কাছে মোটরসাইকেল ছিল না। তবে একটি মোটরসাইকেল তাঁর রয়েছে বলে তখন জানিয়েছিলেন। তাঁর মোবাইল ফোন ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেটি সম্পন্ন হলে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ফেরত দেওয়া হবে।’ গ্রেপ্তারের

পরদিন আকরামকে আদালতে সোপর্দ করেন পল্টন থানার উপপরিদর্শক বিজন কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আকরামকে যখন আমাদের হাতে দেওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে মোটরসাইকেল ছিল না।’
আল আমিন ও হামদে রাব্বী আকরামের মতো ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও বিএনপির অনেক নেতা জামিনে মুক্তি পেলেও গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছে থাকা মালপত্র ফেরত পাচ্ছেন না বলে জানান।
তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন জানান, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁর কাছে ছিল দুটি মোবাইল ফোন, নগদ সাড়ে ৭ হাজার টাকা ও একটি রাউটার। পুলিশ তাঁর কাছ থেকে সেগুলো নিয়ে নেয়। গত ২ জানুয়ারি তাঁকে রমনা থানায় হস্তান্তর করা হয়। এর পর ৯ ফেব্রুয়ারি জামিনে কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান ইমাম। সমকালকে তিনি বলেন, ‘জামিনে মুক্তি পেলেও মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ফিরে পাইনি।’ ইমাম হোসেনের অভিযোগ, তিতুমীর কলেজের অন্তত ৩০ নেতাকর্মীর ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে। জামিন হলেও তারা নিজের মোবাইল ফোন, মোটরসাইকেল ও মানিব্যাগ ফেরত পাননি।

পুলিশ বলছে, এ ধরনের ঘটনার কোনো সুযোগ নেই। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘এমন ঘটনার কথা প্রথম জানলাম। বিস্তারিত না জেনে কিছু বলতে পারব না।’

আইন অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের সময় কারও মালপত্র আটক করা হলে তার তালিকা করতে হয়। সেই তালিকায় ওই ব্যক্তির অথবা তাঁর স্বজনের সই নিতে হয়। যখন তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হবেন, তখন তাঁকে ওই সব মালপত্র বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকেন সংশ্লিষ্টরা। আর মামলার সঙ্গে যেসব মালপত্রের সংশ্লিষ্টতা থাকে, সেগুলো জব্দ তালিকায় দেখাতে হয়।
ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, ‘গ্রেপ্তারের সময় যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায়, সেগুলো যদি মামলার উপাদান না হয়, তাহলে তার একটি তালিকা থানা বা কারা কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। আর যদি সেগুলো মামলার উপাদান হয়, তাহলে জব্দ তালিকা বানিয়ে আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। কিন্তু যদি কোনোটাই করা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, মালপত্র আত্মসাতে কাজটি করা হয়েছে। এটি অবশ্যই অপরাধ।’

জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আরও যারা নিজের মালপত্র ফেরত না পাওয়ার অভিযোগ করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন– ডেমরা ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব রাজু আহমেদ। গত বছরের ১৩ নভেম্বর সায়েদাবাদ থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় তাঁর কাছে ছিল দুটি মোবাইল ফোন। গত ১১ জানুয়ারি কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলেও তিনি মোবাইল ফোন দুটি এখনও ফেরত পাননি।

শুধু ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল নয়, বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ঘড়ি ও মানিব্যাগ ফেরত না পাওয়ার অভিযোগ করেন। বিগত দিনে আন্দোলনের সময় বাসাবাড়ি থেকে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তারাও অনেকে একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানান।

বিভিন্ন ইস্যুতে ২০২২ সালে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর পর হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতাদের দাবি, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে সারাদেশে তাদের ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ১৮৪ মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৪ জনকে। এক সাংবাদিকসহ ২৮ জন নিহত ও ৯ হাজার ৭০৪ জন আহত হয়েছেন।
বিএনপি নেতাদের দাবি, বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের সময় তাদের প্রত্যেকের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও ব্যক্তিগত অনেক জিনিস নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সেগুলো ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। বিশেষ করে মোবাইল ফোন ফেরত নিতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। নানা টালবাহানা করা হচ্ছে।

ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা শ্রমিক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রুবেল হাওলাদার জানান, গত বছরের ১৮ নভেম্বর তাঁকে মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন তাঁর কাছে ছিল দুটি মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও রোল্যাক্স হাতঘড়ি। পুলিশ তাঁর কাছ থেকে এগুলো নিয়ে নেয়। গত ২৬ জানুয়ারি তিনি জামিনে কারামুক্ত হওয়ার পরও ওই সব মালপত্র ফেরত পাননি। তবে মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যক্তিগত মালপত্র অবশ্যই ফেরত দেওয়া হয়।’

ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজও অভিযোগ করেন, গত বছরের ২ নভেম্বর গুলশান থেকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ তাঁর তিনটি স্মার্টফোন ও পাঁচটি সাধারণ ফোন নেয়। গত ৩০ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও ওই সব মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ফেরত পাননি। রমনা থানা পুলিশ এ নিয়ে শুধু ঘোরাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তবে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। অনেকে মালপত্র নিতে থানায় যাচ্ছেন না। যেমন– ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক জুলহাস মৃধা জানান, গত ৬ জানুয়ারি তাঁকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। পরদিন তিনি জামিন পান। কিন্তু এখনও থানা থেকে মোবাইল ফোন সংগ্রহ করেননি। কবি নজরুল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি সাইদুর রহমান সাঈদকেও গত ৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা পুলিশ। ১০ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তির পর গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন তিনি। নিজের মোবাইল ফোন নিতে এখনও থানায় যাননি।

samakal