ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গত এক সপ্তাহে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি কোম্পানির কারখানা বন্ধ হওয়ার তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে। সম্প্রতি সংস্থাটির একটি দল সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে এসব কোম্পানির কারখানা বন্ধের তথ্য পেয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো ফ্যামিলিটেক্স, উসমানিয়া গ্লাসশিট, রিজেন্ট টেক্সটাইল, দুলামিয়া কটন ও নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং।
পাঁচ কোম্পানির মধ্যে নর্দার্ন জুটের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানাই খুঁজে পায়নি ডিএসইর পরিদর্শক দল। এমনকি কোম্পানিটির ওয়েবসাইটেরও কোনো অস্তিত্ব নেই এখন। বহুল আলোচিত পি কে হালদারের মালিকানাধীন এই কোম্পানি ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত।
বিনিয়োগকারীসহ বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এসব কোম্পানির ভবিষ্যৎ কি? তাদের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদেরই বা কী হবে? প্রশ্নগুলোর কোনো সদুত্তর মিলছে না।
ডিএসইর নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো বন্ধ থাকলেও বিনিয়োগকারীদের এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্যই জানায়নি। সরেজমিন পরিদর্শনে আমরা কোম্পানি বন্ধের বিষয়টি জানতে পারছি। এসব বন্ধ কোম্পানির বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে ব্যাপারে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা চাইব। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সরেজমিন পরিদর্শনে আমরা কোম্পানি বন্ধের বিষয়টি জানতে পারছি। এসব বন্ধ কোম্পানির বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে ব্যাপারে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা চাইব। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তারিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘নানা কারণে কোম্পানি বন্ধ হতে পারে; কিন্তু সে তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানাতে হয়। ভবিষ্যতে কোনো কোম্পানি বন্ধ হলে বিনিয়োগকারীরা যাতে তাৎক্ষণিকভাবে সে তথ্য জানাতে পারেন, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করব আমরা।’
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, আলোচ্য কোম্পানিনগুলোর মধ্যে কয়েকটি দীর্ঘদিন ধরে সিকিউরিটিজ আইনের বিভিন্ন বিধিবিধান পরিপালন করছে না। কোনো কোনোটি লভ্যাংশ ঘোষণার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণ করছে না। আবার কোনো কোনো কোম্পানির উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। কোনো কোনো কোম্পানি নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম করছে না। ফলে এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হচ্ছেন না। কোম্পানিগুলো সময়মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোও বিনিয়োগকারীদের জানাচ্ছে না। এ কারণে এসব কোম্পানি পরিদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডিএসই–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পরিদর্শন কার্যক্রম শেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। ডিএসই যে ১৪টি কোম্পানির সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শন করছে, তার একটি বড় অংশই ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর তালিকাভুক্ত হয়। ফলে এক যুগ ঘুরতে না ঘুরতেই এসব কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এসব কোম্পানির বেশির ভাগেরই প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও অনুমোদনের আগে বিভিন্ন পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল। মানহীন কোনো কোম্পানিকে যাতে বাজারে আনা না হয়, সে জন্য ডিএসইর পক্ষ থেকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপত্তিও জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের ক্ষমতাবলে আইপিও অনুমোদন দেয়। আইপিওর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেন কোম্পানির মালিকেরা।
ডিএসই গত এক সপ্তাহে যে পাঁচ কোম্পানির কারখানা বন্ধের তথ্য প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে ফ্যামিলিটেক্স ও রিজেন্ট টেক্সটাইলকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়েছিল বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। শুধু তা–ই নয়, যে ১৪ কোম্পানির পরিদর্শন হচ্ছে, তার মধ্যে আটটি তালিকাভুক্ত হয়েছিল তাঁর আমলে। কোম্পানিগুলো হলো ফরচুন শু, ন্যাশনাল ফিড মিলস, সেন্ট্রাল ফার্মা, ফ্যামিলিটেক্স, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন, রিজেন্ট টেক্সটাইল, জাহিন স্পিনিং ও জাহিনটেক্স।
এদিকে কারখানা বন্ধ থাকলেও বাজারে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, চড়া দামে কেনাবেচাও হচ্ছে। যেমন: পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি নর্দার্ন জুটের শেয়ারের দাম গত বুধবার ৩ শতাংশের বেশি বেড়ে ২০২ টাকায় উঠেছে। অথচ স্কয়ার ফার্মা ও ব্র্যাক ব্যাংকের মতো ভালো মৌলভিত্তির অনেক শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে।
করণীয় কী
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, শুধু কারখানা বন্ধ—এটুকু তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কাজের কাজ কিছু হবে না। কোম্পানিগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে বারবার এসব কোম্পানি নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটবে। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বারবারই ক্ষতির মুখে পড়বেন। কারণ, কারসাজিকারীরা কোম্পানি বন্ধ নাকি খোলা, এ বিষয়কে আমলে নেন না। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ডিএসইর উচিত কোম্পানিগুলোকে তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ নেওয়া।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, অনেক সময় যৌক্তিক কারণে কোম্পানি বন্ধ হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মালিকদের অনিয়ম ও লুটপাটে কোম্পানি খারাপ হয়। যেসব কোম্পানি অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলোর মালিকদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে শেয়ারবাজারে এ ধরনের ঘটনা বারবারই ঘটতে থাকবে এবং বিনিয়োগকারীরা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।