ফিরোজ মাহবুব কামাল
Posted on July 1, 2022
কেন এ বিচার?
বাংলাদেশে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদাটি বিশাল। তাঁকে দেয়া হয়েছে জাতীয় কবির মর্যাদা। এটি এক বিরল সম্মান। তবে এটি শুধু তাঁর প্রতি সম্মানের বিষয়ই নয়, তাঁর চেতনা ও সাহিত্য থেকে বহু কিছু প্রত্যাশার বিষয়ও। সাধারণ কবি ও জাতীয় কবির মধ্যে পার্থক্যটি বিশাল। যে তার কর্মে, চরিত্রে ও ভাবনায় অন্যদের থেকে অনন্য ও অনুকরণীয় -সেই কেবল এই বিরল সম্মান পায়। কাউকে জাতীয় কবি, জাতির নেতা বা জাতির পিতা রূপে বরন করার অর্থ, জাতির সামনে তাঁকে অনুকরণীয় মডেল বা আদর্শ রূপে খাড়া করা। এরূপ সম্মানের আসনে বসানোর উদ্দেশ্য, দেশবাসী তাঁর কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি ও দর্শন থেকে দিক-নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পাবে। কাউকে এরূপ সম্মানিত করার মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়। সেটি হলো, জাতির অন্যরা তাঁর মত গড়ে উঠলেই দেশের মহা কল্যাণ। জীবন গড়ায় নতুন প্রজন্ম তাঁকে “ফিগার অব হাইনেস” মনে করবে। সে হবে জনগণের স্বপ্নের মানুষ। দেশ এমন মানুষে ভরে উঠবে –সেটিই সবার কাছে কাঙ্খিত।
অনুকরণ মানব জীবনের অতি সহজাত ধর্ম। পছন্দের কাউকে অনুকরণ করেই মানুষ বাঁচে ও বেড়ে উঠে। কিন্তু যাকে কোন দিন দুই চোখে দেখাই হয়নি, তার অনুসরণ কীরূপে সম্ভব? তাকে নিয়ে নানা রূপ উদ্ভট কল্পনা করা যায়, কিন্তু তার সঠিক ছবিটি কখনোই আঁকা যায় না। অনুকরণের জন্য এই জন্যই চোখের সামনে আদর্শ মডেল চাই। মহান আল্লাহতায়ালা চান মানুষ উত্তম চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠুক। কিন্তু সে উত্তম চরিত্র বলতে কি বুঝি। সেটি দেখতে কেমন? সেটি বুঝাতে ও দেখাতেই মহান আল্লাহতায়ালা মানবের সামনে অনুকরণীয় মডেল রূপে নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন। আর সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল হলেন মহানবী মুহম্মদ (সা:)। একজন চিত্রশিল্পী যেমন তাঁর চোখের সামনে দৃশ্যমান কোন কিছুর অনুকরণে ছবি আঁকে, তেমনি অন্যরাও নিজেদের গড়ে তোলে সে অনুকরণীয় চরিত্রকে সামনে রেখে। এ জন্যই জরুরি হলো, এসব জাতীয় চরিত্রকে বিচারের মানদন্ডে তোলা। নজরুলের চেতনা, চরিত্র ও সাহিত্য এজন্যই বিচার-বিশ্লেষণের দাবীদার। কারণ দূষিত চেতনা ও বিভ্রান্ত চরিত্রের কোন ব্যক্তিকে সে অনুকরণীয় মডেলের আসনে বসানোর বিপদ তো ভয়ানক। যারা তাঁকে অনুকরণ করে তারা তখন বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়। গণতন্ত্র-হত্যাকারী কোন দুর্বৃত্ত ফ্যাসিস্টকে জাতির বন্ধু বা জাতির জনকের আসনে বসিয়ে কি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়? তখন তো প্রতিষ্ঠা পায় দুর্বৃত্তি ও উগ্র ফ্যাসিবাদ। এরূপ উদাহরণ তো ইতিহাসে প্রচুর। মন্দিরের মুর্তিপূজারী ঠাকুরকে যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাভরে হৃদয়ে স্থান দেয়, সে যে মুর্তিপূজারী হবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। তাই কোন দূষিত চিন্তার বিভ্রান্ত, দুর্বৃত্ত ও পথভ্রষ্ট মানুষকে জাতির পিতা, জাতির নেতা বা জাতীয় কবির আসনে বসানোর বিপদ ভয়াবহ। এতে সমগ্র জাতি বিপদে পড়ে। দেশবাসী তখন ভ্রান্ত পথনির্দেশনা পায়।
ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, নিজ পথ্রষপনিজ গুণে বা নিজ সামর্থ্যে নির্ভূল হওয়াটি যে কোন ব্যক্তির পক্ষেই অসম্ভব –সে ব্যক্তিটি যত বড় প্রতিভাবানই হোক। তেমনি আদর্শনীয় ও অনুকরণীয় হওয়ার বিষয়টিও। মানুষ সঠিক পথ পায় বা সত্যকে চিনে একমাত্র মহান আল্লাহর অনুগ্রহে। পথ দেখানোর দায়িত্বটিও একমাত্র তাঁর। পবিত্র কুর’আনের ঘোষণা,“ইন্না আলাইনাল হুদা” অর্থ: নিশ্চয়ই (মানবকে) পথ দেখানোর দায়িত্বটি আমার।–(সুরা লাইল, আয়াত ১২)। তাই মানুষের সামনে সে পথের মডেল বা পথপ্রদর্শক রূপে কাউকে পেশ করার দায়িত্বও একমাত্র তাঁর। তিনি সে কাজটি সমাধা করেছেন নবী-রাসূলদের প্রেরণ করে। পবিত্র কুর’আনের ভাষায় হযরত মহম্মদ (সা:) হলেন সেই উসওয়াতুন হাসানা তথা সর্বোত্তম আদর্শ। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো নবীজী(সা:)’র সে আদর্শকে মডেল রূপে গ্রহণ করা। অনুসরণের সে দায়িত্বটি যেমন প্রতিটি নাগরিকের, তেমনি শাসকেরও। তাই যারা ইসলামের অনুসারী তাদের কাছে নতুন মডেলের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ নবীজী(সা:) পথ দেখান সর্বক্ষেত্রে। এজন্যই ইসলামের চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে শত শত মহামানব জন্ম নিলেও জাতির পিতা, জাতীয় নেতা বা জাতীয় কবির ধারণা নেই। হাফিজ শিরাজী, শেখ সাদী, মাওলানা রুমী, আল্লামা ইকবাল মুসলিম ইতিহাসে বিখ্যাত কবি। কিন্তু তারা কোন মুসলিম দেশেরই জাতীয় কবি নন। যদিও তাদের কবিতার মধ্য দিয়ে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে ইসলামী চেতনা, এবং ধ্বনিত হয়েছে মুসলিম উম্মাহর স্বপ্ন ও আকুতির কথা। তাদের জ্ঞানদীপ্ত লেখনীতে অগণিত মানুষের চিত্ত আলোকিত হয়েছে, আন্দোলিতও হয়েছে।
মুসলিম দেশগুলিতে জাতীয় নেতা ও জাতীয় কবির ধারণাটি এসেছে মূলত সেক্যুলারিষ্টদের পক্ষ থেকে। বাঙালি সেক্যুলারিষ্টগণ এ ক্ষেত্রে পাগলপ্রায়। কারণ তাদের সামনে নাই কোন অনুকরণীয় মডেল-চরিত্র। নেই তেমন গর্বের কেউ। মহান নবীজী (সা:)কে বা ইসলামে অঙ্গীকার আছে এমন কোন ব্যক্তিকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করা সেক্যুলারিষ্টদের কাছে সাম্প্রদায়িকতা। ফলে তারা বরনীয় রূপে বেছে নেয় ইসলাম থেকে দূরে সরা লোকদের মধ্য থেকে। এখানে কাজ করে রাজনৈতিক মতলব। নিজেদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ধারণাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে জাতীয় কবির মর্যাদাকে তারা বাহন রূপে ব্যবহার করে। কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে তুলে এনে বাংলাদেশের জাতীয় কবির আসনে বসানোর মধ্যে রয়েছে তেমন একটি রাজনৈতিক মতলব। কাজী নজরুল ইসলাম যেহেতু জাতীয় কবির আসনে আসীন, তাঁর মন ও মনন, সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক আদর্শের মূল্যায়নের বিষয়টিও তাই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাহিত্য, দর্শন ও চেতনা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের জন্য কতটা উপকারী বা কতটা ক্ষতিকর সেটিও বিবেচনার বিষয়। এ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে তেমন এক প্রেক্ষাপটে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও নজরুল
জাতীয় কবির সবচেয়ে বড় দায়ভারটি হলো, তাঁর সাহিত্যকে সমগ্র জাতির পক্ষ হয়ে কথা বলতে হয়। তাঁর সাহিত্যে বিমূর্ত হতে হয় সে জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস, চেতনা, আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া, হাঁসী-বেদনা ও ইতিহাস। সর্বোপরি তাঁকে মুক্ত হতে হয় সকল ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতি থেকে। এবং ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির পরিমাপে যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাঝে কাজ করে সেগুলোকেও তাঁকে মেনে নিতে হয়। তাকে সে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে চলে না। একমাত্র তখনই সে সাহিত্য থেকে দেশবাসী পায় বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি, পায় দর্শন এবং পায় নির্দেশনা। জাতীয় কবির চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও দর্শনকে আপন করে নিয়ে নতুন প্রজন্ম পায় বেড়ে উঠার প্রেরণা। রবীন্দ্র নাথ বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি। কিন্তু তাঁর সাহিত্যে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির চেতনা ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেনি, বিখ্যাত কবি হয়েও তিনি জাতীয় কবি হতে পারেননি। কিন্তু সে বিচার নজরুল কতটা উত্তীর্ণ? এ নিবন্ধে সেটাই আলোচনার বিষয়।
কোন দেশবাসীই নিছক পানাহারে বাঁচে না। সভ্যরূপে বাঁচবার প্রয়োজনে খাদ্য-পানীয়’র পাশাপাশী তাহজিব ও তমুদ্দনও গড়ে তুলতে হয়। সে লক্ষ্যে দর্শনও লাগে। দর্শনই দেয় কর্মে, যুদ্ধে ও আত্মত্যাগে প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা। দর্শনের বলেই প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ে তুলেছে। সে দর্শনটি দুর্বল হলে বা বিলুপ্ত হলে নিঃশেষ হয় স্বাধীন ও সভ্য জাতি রূপে বাঁচবার শক্তি ও প্রেরণা। আজকের মুসলিম দেশগুলি বর্তমান দুরাবস্থায় পৌঁছেছে তো এ পথেই। মূলত দর্শনই দেয় স্বাধীন ভাবে বাঁচবার পক্ষে যুক্তি ও শক্তি। দেয় একতা। দেয় রাজনীতি ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। ভাষার বলের চেয়ে এখানে প্রবল ভাবে কাজ করে দর্শনের বল। পাকিস্তুানের সৃষ্টিতে সে দর্শনের বলটি জুগিয়েছিল ইসলাম। আর সে দর্শনকে জনগনের মাঝে বলবান করেছিলেন শত শত লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। আল্লামা ইকবাল তাঁদেরই অন্যতম। তিনি শুধু পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, আদর্শনীয় এবং অনুকরণীয় চিন্তানায়কও ছিলেন। তাঁর সে মহান আদর্শটি হলো, ভাষা, বর্ণ, আঞ্চিলকতার উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামিক চেতনায় বেড়ে উঠা। তিনি নিজে দৃষ্টান্ত গড়েছেন ভাষা ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে। মাতৃভাষা পাঞ্জাবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কবিতা লিখেছেন উর্দু ও ফার্সিতে। ভাষা যেহেতু দর্শন ও ভাবনার বাহন, সে জন্যই তিনি বেছে নিয়েছিলেন উর্দু ও ফার্সি ভাষাকে –যা সুযোগ করে দেয় ভারত, আফগানিস্তান, ইরানসহ কয়েকটি দেশের কোটি কোটি মুসলিমের চেতনার ভূমিতে পৌঁছার। ঈমানদারের সাহিত্যকর্ম হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। উর্দু ও ফার্সি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করায় আল্লামা ইকবাল জিহাদের সে ক্ষেত্রকে বিশাল করতে পেরেছিলেন। মাতৃভাষায় সীমিত রাখলে সে সুযোগ তিনি পেতেন না। এক্ষেত্রে ইকবাল অতি বিরল প্রতিভার অধিকারী। ইতিহাসে আর কেউই মাতৃভাষার বাইরে এরূপ উচ্চমানের কবিতা চর্চা করতে পারেননি। তাঁর সমগ্র চেতনা জুড়ে ছিল সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ চিন্তা। তাই তাঁর কল্যাণের ভাবনাটি ভাষা ও আঞ্চলিক ভূগোল দিয়ে সীমিত ছিল না। ১৯৪৭য়ে সে প্যান-ইসলামিক চেনতাটিই উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে প্রবলতম রূপ নেয়। এ চেতনার সে প্রবল শক্তিটি না পেলে বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, গুজরাতী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান –এরূপ নানা ভাষায় বিভক্ত উপমহাদেশের মুসলিমের পক্ষে বিশাল হিন্দু প্রতিপক্ষের প্রবল বিবোধীতার মুখে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব হতো? পাকিস্তান আজও যে বেঁচে আছে সেটি সেদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে তেমন এক প্যান-ইসলামী চেতনা বেঁচে থাকার কারণেই, নইলে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় আরো ৪টি স্বাধীন দেশের জন্ম হত। পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশেরই আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সে সামর্থ্য জর্দান, কাতার, কুয়েত বা ওমানের ন্যায় জাতিসংঘের অর্ধেকের চেয়ে বেশী সদস্য রাষ্ট্রের চেয়ে অধিক।
প্রশ্ন হলো, এক্ষেত্রে নজরুলের অবস্থানটি কোথায়? তাঁর সাহিত্যের দর্শনটি কি? তিনি কোন পক্ষের কবি? নিরপেক্ষতা গরু-ছাগল, গাছ-পালা ও মৃত মানুষের সাজে। জীবিত মানুষের নয়। তাই রাজনীতির নেতা-কর্মী ও ভোটারদের ন্যায় কবি-সাহিত্যিকদেরও একটি পক্ষ থাকে। তাই ইকবালের একটি পক্ষ ছিল। কিন্তু নজরুলের পক্ষ কোনটি? আল্লামা ইকবাল যেমন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছেন, নজরুলও কি বাংলাদেশের ন্যায় কোন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন? সেটি কি ভারত ভেঙ্গে? এবং সে স্বপ্ন দেখে থাকলে সেটি তাঁর কোন কবিতায় বা কোন গানে প্রকাশ পেয়েছে? আরো প্রশ্ন হলো, স্বাধীন ভাবে বাঁচবার লক্ষ্যেই বা বাংলাদেশীদের চেতনা ও দর্শনে কতটা বল জোগাচ্ছে নজরুল সাহিত্য? প্রশ্ন হলো, আজকের বাংলাদেশে কি নজরুলের বাংলা? নজরুল যে বাংলায় বাস করতেন সে বাংলায় মুসলিমের সংখ্যা শতকরা ৫৫ ভাগের বেশী ছিল না। আজকের বাংলাদেশে শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ মুসলিম। তিন দিক দিয়ে ভারত ঘেরা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব ও তার বিচিত্র ভূগোল নিজেই একটি দর্শন ও একটি চেতনার ঘোষণা দেয়। সেটি যেমন ভারতের নয়, তেমনি ভারতভূক্ত বাঙালির পশ্চিম বাংলারও নয়। নজরুল যে বাংলায় কবিতা চর্চা করেছেন সে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ময়দান ছিল রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম চ্যাটার্জী এবং তাদের ভক্ত ও সতীর্থ সাহিত্যিকদের দ্বারা অধিকৃত। রাজনীতিতে আধিপত্য ছিল ভারতীয় কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও কম্যুনিষ্ট পার্টির ন্যায় ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারহীন দলের। কলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ-হিন্দুদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার প্রেরণাতেই বেরিয়ে আসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা। এবং সেটি অখণ্ড বাংলাকে খণ্ডিত করে। ১৯৪৭ সালের সে খণ্ডিত পূর্ব-বাংলাটিই হয় পূর্ব-পাকিস্তান। বাংলার মুসলিমগণ তখন একাত্ম হয়েছিল মহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব ও ইকবালের প্যান-ইসলামী দর্শনের সাথে। পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে ছিল ইকবাল ও জিন্নাহ এ তত্ত্ব। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরাজয় হলেও বাংলাদেশ আজও যে পশ্চিম বাংলার সাথে একাত্ম হয়নি সেটি এই ভিন্ন ইসলামী দর্শনের বলেই। ভাষা, জলবায়ু বা ভূ-মৃত্তিকার কোন বিশেষ বৈশিষ্ঠের কারণে নয়।
কি ছিল নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন?
প্রশ্ন হলো, নজরুল-সাহিত্য কতটা সম্পৃক্ত বাঙলার এ নতুন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ভূগোলের সাথে? নজরুল তার মানসিক সুস্থতা হারান ১৯৪২ সালে। এবং স্বাধীন পাকিস্তানের ধারণাটি আসে ১৯৩০ সালে। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৯৪০ সালে। অতএব নজরুলের কাছে পাকিস্তানের ধারণাটি অজানা বা অপরিচিত ছিল না। প্রশ্ন হলো, সে সময় নজরুলের প্রতিক্রিয়াটি কি ছিল? তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসটিই বা কি ছিল? হিন্দুদের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসা বা ভারত-বিভক্তির ধারণাটি কি তিনি সমর্থন করতেন? নজরুল শুধু কবি ছিলেন না, তিনি অতি সক্রীয় ছিলেন রাজনীতেও। নিজে যেমন রাজনৈতিক দলও গড়েছেন, তেমনি সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। পত্রিকায় রাজনৈতিক কলাম লিখে তিনি জেলে গেছেন। রাজনৈতিক দলের মুখপত্র ‘লাঙ্গল’ ও ‘নবযুগ’র সম্পাদকও ছিলেন। তাই নজরুলকে চিনতে হলে শুধু তাঁর ব্যক্তি ও পরিবারিক জীবন এবং সাহিত্য-কর্মকে নয়, তাঁর রাজনীতিকেও চিনতে হবে। তাছাড়া কোন ব্যক্তির চেতনা ও বিশ্বাসের সবচেয়ে নিখুঁত ও সুক্ষতম পরিচয়টি ধরা পড়ে তার রাজনীতিতে। কারণ কি তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কি তাঁর দর্শন, কি তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং কারা তাঁর শত্রু ও মিত্র -সেটি কখনোই রাজনীতিতে লুকানো যায় না। বরং সেসবের সুস্পষ্ট পরিচিতি নিয়ে রাজনীতির অঙ্গণে হাজির হয়।
তবে নজরুলকে চিনতে হলে তার শিক্ষা ও বেড়ে উঠার পরিবেশকেও জানতে হবে। মানুষ যা খায় বা পান করে তারই প্রকাশ ঘটে তার স্বাস্থ্যে। তেমনি সে যেরূপ শিক্ষা পায় বা যেভাবে বেড়ে উঠে -সেটাই বিমূর্ত হয় তার সাহিত্যে। শিক্ষার মাধ্যমে চেতনায় যে বীজটি রোপন করা হয় সেটিই বিকশিত হয় সাহিত্যকর্মে। ইকবাল ও রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য -সেটি তো শিশুকাল থেকে দু’জনের শিক্ষা ও বেড়ে উঠায় প্রচণ্ড ভিন্নতার কারণেই্। ইকবাল তার শিক্ষার হাতে খড়িটি পেয়েছেন মক্তবে আরবী-ফারসী জানা একজন প্রসিদ্ধ আলেমের কাছে। পড়েছেন সমৃদ্ধ ফার্সি সাহিত্য। শিক্ষালাভ করেছেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় পৃথিবীর নামকরা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেমব্রিজে পড়াশুনা করেছেন বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেছে। দর্শনে পিএইডি করেছেন জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্যারিস্টারী পাশ করেছেন লন্ডনের লিংকন্স ইন থেকে। তিনি ৪টি বছর আরবী ভাষায় শিক্ষাকতা করেছেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ওরিয়ান্টাল কলেজে। বলা যায়, আল্লামা ইকবাল ছিলেন সমগ্র উপমহাদেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি। শুধু ভারতে কেন, সমগ্র পৃথিবীতে ইকবালের ন্যায় উচ্চ শিক্ষিত সাহিত্যিক একজনও ছিল না। এজন্যই উপমহাদেশের বিজ্ঞজনেরা তাকে আল্লামা বলে সম্বোধন করতেন। অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্য শিক্ষাটি পেয়েছেন তাঁর নিজ গৃহে বাহ্মণ ঠাকুরের কাছে। পড়েছেন বেদ, পুরান, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত ও কালিদাসের সাহিত্য। বিলেতে যান লেখাপড়া করতে। সেখানে ব্রাইটন শহরে স্বল্পকাল থেকে কোন ডিগ্রি না নিয়েই দেশ ফিরেন। দেশের বা বিলেতের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালাভ ঘটেনি। ফলে তার কবিতায় যত ভাব, যত আবেগ ও যত কল্পনার দাপট, ততটা জ্ঞান ও দর্শনের গভীরতা দেখা যায় না। অথচ মানুষের চরিত্র, কর্ম ও রাজনীতি পাল্টে যায় দর্শন ও জ্ঞানের প্রভাবে। ফলে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি ও বুদ্বিবৃত্তিতে তেমন কোন প্রভাবই ফেলতে পারেননি -যতটা পেরেছে আল্লামা ইকবাল।
অপরদিকে উচ্চশিক্ষা ও ইসলামী চেতনায় বেড়ে উঠার সুযোগটি নজরুলের জীবনে আসেনি। ছোট বলায় তিনি তাঁর পিতার কাছে কুর’আন পাঠ শিখেছেন, কিন্তু শিক্ষার সে ধারা বেশী দিন চলেনি। ৯ বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। দশ বয়সে মসজিদের মোয়াজ্জিন হয়েছেন, মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন এবং সেবক হয়েছেন মাজারের। কিছুদিন চাচার সাথে লেটো’র দলে কাটিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাটক করেছেন ও গান গেয়েছেন। লেটো’র দলে নজরুল ইসলামের চাচা আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষায় মিশ্রিত গান লিখতেন। কারণ ঐ এলাকাটি ছিল বাংলার পশ্চিম প্রান্তে এবং বিহার ও উত্তর প্রদেশের কাছাকাছি। ফলে সেখানে বাংলার সাথে উর্দুর মিশ্রন ছিল। সে সময় বিহার ছিল বৃহত্তর বাংলারই একটি অংশ। নজরুল ইসলামও তখন ঐ এলাকার বাংলা-উর্দুর মিশ্রনের সাথে পরিচিত হন এবং সবক পান মিশ্রিত ভাষায় গান লেখার। ১১ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন। ষষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত পড়ে আবার কর্ম জীবনে ফিরে যান। চা-রুটির দোকানে কাজ, গৃহে খানসামা -এরূপ নানা কাজে কিছু কাল কাটিয়ে আবার স্কুলে ফিরে আসেন। কিন্তু দশম শ্রেণীও তিনি শেষ করতে পারেননি। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ অবধি কাটিয়েছেন সেনাবাহিনীতে, বেশীর ভাগ সময় থেকেছেন করাচীতে। এরপর সামরিক জীবন শেষে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। প্রবন্ধ, গান ও কবিতা লেখা শুরু করেন। নজরুলের জীবনে এভাবে নান পেশার নানা বৈচিত্রতা আসলেও, নিরবিচ্ছিন্ন জ্ঞানার্জনের সুযোগ আসেনি। অথচ সাহিত্যচর্চায় এ প্রস্তুতিটুকু অতি গুরুত্বপূর্ণ। চাষাবাদে নামতে হলে জমি চাই, চাষাবাদের দক্ষতা চাই, সে সাথে বীজও চাই। তেমনি সাহিত্যকর্মে চাই গভীর জ্ঞান। মুসলিমের জন্য সে জ্ঞানটি হতে হবে পবিত্র কুর’আন ও নবীজী (সা:)’র জীবনচরিত ও হাদীসের জ্ঞান। সে জ্ঞান না থাকলে সাহিত্য পরিণত হয় অসত্য ও অজ্ঞতাপ্রসূত ভাবের ও কল্পনার বাহনে। সাহিত্য তখন চেতনায় বিষ ছড়ায় এবং অকল্যাণের কারণ হয়। এরূপ সাহিত্যই যুগে যুগে জনগণকে বিভ্রান্ত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
ইসলামে অঙ্গীকারহীনতার রাজনীতি
কাজী নজরুল ইসলামের যখন সাহিত্য চর্চার শুরু তখন বাংলা সাহিত্যে ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিতে চলছে প্রবল জোয়ার। সে জোয়ারটি গড়ে তুলেছিলেন কলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ-হিন্দু সাহিত্যিকগণ। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং আরো বহু হিন্দু কবি-সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের গগনে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাহিত্যে জোয়ার সৃষ্টির পাশাপাশি শুরু হয় বাঙালি হিন্দুদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ। মুসলিমদের তখন দারুন দুরাবস্থা। তাদের সাহিত্যের আকাশে যেমন ঘন অন্ধকার, তেমনি দুরাবস্থা তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও অর্থনীতিতেও। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তি ইঞ্জিনের কাজ করে। কিন্তু মুসলিমগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের হাতে সে ইঞ্জিনটাই ছিল না। বাঙলায় ইসলামের আগমনের পর এদেশে হিন্দু সংস্কৃতির পাশাপাশি মুসলিম সংস্কৃতির যে ধারাটি গড়ে উঠেছিল তখন সেটির বিপন্ন দশা। উপমহাদেশ জুড়ে ইতিমধ্যে শুরু হয় হিন্দু-মুসলিমের রাজনৈতিক লড়াই। এবং সে লড়াইটি তীব্র ভাবে হচ্ছিল ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ বাংলায়। ইংরেজদের তখন বিদায়ের দিন, কিন্তু তাদের বিদায়ের পর কারা নিবে ভারতের উপর দখলদারী? সে দুর্ভাবনায় মুসলিমগণ অস্থির। হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসানামলকে ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রস্তুতিকাল রূপে, সেটি সমগ্র ভারত জুড়ে রামরাজ্য স্থাপন কল্পে। তার টের পেয়েছিল, ব্রিটিশ শাসনের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। এরপরই দখলটি নিজ হাতে নিতে হবে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও আর.এস,এস গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেটি। হিন্দুত্ববাদের আধুনিক প্রবর্তক সাভারকার, গোলওয়ালকার, হেগডের লেখনি ও বক্তৃতায় সে বিষয়টি সুস্পষ্ট। ব্রিটিশ আমলেই হাজার হাজার আর.এস,এস কেন্দ্রে হিন্দু যুবকদের সামরিক প্রশক্ষিণ দেয়া শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনের পর কীরূপে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে –তা নিয়ে। সে দুর্দিনে মুসলিমদের মাঝে রাজনৈতিক লড়ায়ে লোক পাওয়া গেলেও সাহিত্যের ময়দানে শক্তিমান যোদ্ধার ছিল প্রচণ্ড অভাব। বাঙালি মুসলিমগণ সে সংকটে কাজী নজরুল ইসলামকে সহযোদ্ধা রূপে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু নজরুল ইসলাম থেকে তাদের আশা পুরণ হয়নি। তিনি বাঙালি মুসলিমদের দলে যোগ দেননি। তিনি রাজনীতির যুদ্ধটি লড়েছেন সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট (সাম্যবাদী) ও সমাজবাদীদের দলে মিশে। নিবিড় সম্পর্ক গড়েছেন কম্যুনিষ্ট নেতা কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদের সাথে। তিনি সম্পাদনার দায়িত্ব দেন কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকা “লাঙ্গল”য়ের। তাঁর মগজে তখন কম্যুনিজমের সাথে সেক্যুলারিজম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্লাবন। তিন তখন ভেবেছেন, হিন্দু-মুসলিমের মিলন নিয়ে। সে মিলনের স্বপ্ন নিয়েই বিয়ে করলেন কুমিল্লার হিন্দু পরিবারের মেয়ে প্রমিলাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত না করেই। সে নিরেট হারাম কর্মটি তার কাছে হারাম গণ্য হয়নি। তার কাছে ইসলাম, খেলাফত, ইসলামের জাগরণ ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি দায়বদ্ধতা -এসব চিহ্নিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা রূপে। এভাবে নজরুল নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন ইসলাম থেকে এবং নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও অমুসলিমদের মাঝে। হিন্দুত্ববাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তিনি প্রচুর কীর্তন, ভজন সঙ্গিত ও শ্যামা সঙ্গিত লিখেছেন।
প্রশ্ন হলো, নজরুল ইসলামের প্রতি বাঙালি মুসলিমদের আব্দার ও প্রত্যাশা কি ছিল? সে আব্দার ও প্রত্যাশার প্রতি নজরুলের জবাবই বা কি ছিল? নজরুল ইসলামের দর্শন ও তাঁর সাহিত্যের মূল সুরটি ধরতে হলে সেটি জানা জরুরি। বাঙলার মুসলিমগণ কীরূপ আশা নিয়ে নজরুলকে আহবান জানিয়েছিল সেটি ফুটে উঠে নজরুলকে লেখা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর একটি চিঠি থেকে। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কবি নজরুল ইসলামকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। নজরুলের যে সাহিত্যে অসামান্য প্রতিভা ছিল, সেটি ইব্রাহিম খাঁ জানতেন। তিনি এটাও লক্ষ্য করছিলেন, প্রচণ্ড অপচয় হচ্ছে সে প্রতিভার। খরচ হচ্ছে হারাম পথে। কিছু হামদ-নাত ও কিছু গজল লিখলেও, তখন প্রচুর লিখে চলেছেন হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি ভক্তিমূলক ভজন, কীর্তন এবং শ্যামা-সঙ্গীত। এতে অতি উগ্র হিন্দুত্ববাদি হিন্দুরা তাকে দাদা বলে হাততালি দিচ্ছে। অপর দিকে হিন্দু দেব-দেবীদের মাথায় তোলার কারণে নজরুলের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হচ্ছিল ইসলামপ্রেমী জনগণ ও আলেম সমাজ। গভীর আবেগ আর দরদ দিয়ে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ বিষয়টিকে নজরুলের দৃষ্টিতে আনতে চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য জগতের লড়াইয়ে তিনি নজরুলকে মুসলিমদের পক্ষে যোগ দেয়ার জোড়ালো আব্দার রেখেছিলেন। আল্লাহতায়ালা ফরজ করেছেন, প্রতিটি মুসলিম তাঁর পক্ষ নিবে এবং তাঁর নির্ধারিত দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করতে জিহাদে নামবে। নিরেপক্ষ থাকাকে তিনি হারাম করেছেন। কারণ কোন মুসলিম নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় হলে তাতে মুসলিমের শক্তিহানী হয়। তখন বিজয়ী হয় শয়তান ও তাঁর অনুসারীগণ। অথচ রাজনীতির সে ক্রান্তিলগ্নে নজরুল ইসলাম মুসলিমদের পক্ষ নেননি।
প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ’র পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে লেখা চিঠিটির কিছু অংশ তুলে ধরা যাক: “আজ তোমায় কয়টি কথা বলব, গুরু রূপে নয়, ভাই রূপে, ভক্ত রূপে।.. কথাগুলি বুকের তলে অনেক দিন তোলপাড় করছে। ..সমাজ মরতে বসেছে; তাকে বাঁচাতে হলে চাই সঞ্জীবনী সুধা, কে সেই সুধা হাতে এনে এই মরণোন্মুখ সমাজের সামনে দাঁড়াবে, কোন সুসন্তান আপন তপোবন গঙ্গা আনয়ন করে, এ অগণ্য সাগর গোষ্ঠিকে পুনর্জ্জীবন দান করবে, কাঙ্গাল সমাজ উৎকণ্ঠিত চিত্তে করুণ নয়নে সেই প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে। কে জানিনা; কিন্তু মনে হয়, তোমায় বুঝি সে সাধনার বীজ জমা আছে। হাত বাড়াবে কি? একবার সাহসে বুক বেধে সে তপশ্চারণে মনোনিবেশ করবে কি?…বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দরিদ্র, সবচেয়ে বেশী অজ্ঞ, সবচেয়ে বেশী আত্মভোলা তোমারই ভাই এই মুসলিমগণ। আর বাঙ্গালা সাহিত্যে সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে কলঙ্কিত, সবচেয়ে নিন্দিত ও কুলিখিত বিষয় হলো ইসলাম। ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য, সভ্যতা, ইতিহাস নিয়ে আলোচনা বাঙ্গলা সাহিত্যে হয় নাই। যা হয়েছে সেটির বেশীর ভাগ বিকৃত রূপে। যিনি বাঙ্গলা সাহিত্যে ইসলামের সত্য সনাতন নিষ্কলঙ্ক চিত্র দান করবেন, যিনি ‘এই সব মুক ম্লান মুখে’ ভাষা দিবেন, ‘এই সব ভগ্ন শ্রান্ত বুকে’ আশা ধ্বনিয়ে তুলবেন, যিনি ইসলামের সত্য স্বরূপ দেশের সম্মুখে ধরে মুসলিমের বুকে বল দেবেন, অমুসলিমের বুক হতে ইসলাম অশ্রদ্ধা দূর করতঃ হিন্দু-মুসলিম মিলনের সত্য ভিত্তির পত্তন করবেন, তিনিই হবেন বর্তমানের শ্রেষ্ঠতম দেশ-হিতৈষী, তিনিই হবেন বাঙ্গালা মুসলিমের মুক্তির অগ্রদূত। তুমি চেষ্টা করলে তাই হতে পার; তুমি সেই মহাগৌরবের আসন দখল করতে পার, তুমি এইরূপে তোমার কবি,তোমার জীবনকে,তোমার মানবতাকে সহজতম রূপে সার্থক করতে পার।…তাই আজ বড় আশায়, বড় ভরসায়, বড় সাহসে, বড় মিনতির স্বরে তোমায় বলছি, ভাই, কাঙ্গাল মুসলিমের বড় আদরের ধন তুমি, তুমি এই দিকে পতিত মুসলিম সমাজের দিকে, এই অবহেলিত ইসলামের দিকে একবার চাও; তাদের ব্যথিত চিত্তের করুণ রাগিনী তোমার কণ্ঠে ভাষা লাভ করে আকাশ-বাতাশ কাঁপিয়ে তুলুক, তাদের সুপ্ত প্রাণের জড়তা তোমার আকুল আবেগের উন্মাদনায় চেতনাময়ী হউক, ইসলামের মহান উদার উচ্চ আদর্শ তোমার কবিতায় মুক্তি লাভ করুক, তোমার কাব্য সাধনা ইসলামের মহাগীতিতে চরম সার্থকতার ধন্য হোক। আমিন।–ইব্রাহীম খাঁ।” -াই (সুত্র: সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।
এটি ছিল কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি জনাব ইব্রাহীম খাঁ’র অতি হৃদয়স্পর্শী আকুল আবেদন। কিন্তু তাতে নজরুল ইসলাম সাড়া দেন নাই।সে চিঠির উত্তরে কাজী নজরুল ইসলাম কি লিখেছিলেন সেটি তাঁর লেখা চিঠি থেকেই উদ্ধৃতি দেয়া যাক: “বাঙলার মুসলিম সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহু দিন হতে। আমায় মুসলিম সমাজ ‘কাফির ’ খেতাবে যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনদিন অভিযোগ করেছি বলে তা মনে পড়ে না। … হিন্দুরা লেখক-অলেখক জনসাধরণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালবাসা দিয়ে আমায় এত বড় করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তা হলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য, কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু সভা’ওয়ালা আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙ্গুল দিয়ে গোণা যায়।…আপনার ‘মুসলিম সাহিত্য’ কথাটির মানে নিয়ে অনেক মুসলিম সাহিত্যিকই কথা তুলবেন হয়ত। ওর মানে কি মুসলিমের সৃষ্ট সাহিত্য, না মুসলিম ভাবাপন্ন সাহিত্য? সাহিত্য যদি সত্যিকার সাহিত্য হয় তবে তা সকল জাতিরই হবে।… আমার বিশ্বাস, কাব্যকে ছাপিয়ে উদ্দেশ্য বড় হয়ে উঠলে কাব্যের হানি হয়। আপনি কি চান, তা আমি বুঝতে পারি- কিন্তু সমাজ যা চায়, তা সৃষ্টি করতে আমি অপরাগ।…জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি, দিয়ে যাব আমি নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।… -নজরুল ইসলাম।” (সুত্র: সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।
নজরুল সাহিত্যে বিভ্রাট
ইব্রাহীম খাঁ’র আকুল আব্দার নজরুল ইসলামকে তাঁর পথ থেকে ফেরাতে পারেনি। তাঁকে প্রভাবিত ও আন্দোলিত করতে পারিনি মুসলিম সমাজের নিদারুন পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিও। নজরুল তাঁর নিজের ধারা অব্যাহত রাখেন। সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য এবং সাহিত্য সৃষ্টির তীব্র আনন্দবোধই তাকে আপন ভূবনে ডুবিয়ে রেখেছিল। সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য নয়, বরং একজন মু’মিনকে সাহিত্যের ময়দানে নামতে হয় মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার প্রবল তাড়না নিয়ে। একজন মু’মিনের কাছে সেটি বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। এ জিহাদটি অগণিত মানুষের চেতনার ভূবনে ইসলামকে বিজয়ী করার। এ কাজ ছিল প্রতিটি নবী ও রাসূলের। প্রতিটি ঈমানদারকে বাঁচতে হয় নবী-রাসূলদের সে সূন্নতকে নিয়ে। কিন্তু নজরুলের মধ্যে সে তাড়না ছিল না। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে জিহাদের সে ধারণা বা জজবা –কোনটাই ছিল না। সাহিত্যের অঙ্গণে তিনি ইসলামকে স্থান দিতে রাজী ছিলেন না। বরং তাঁর মাঝে ছিল হিন্দুদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার প্রবল তাড়না। হিন্দুদের থেকে বাহবা পাওয়াটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন মনে হতো। ইসলাম ও মুসলিমদের পক্ষে লেখালেখি অন্যান্য বামপন্থী সেক্যুলারিস্টদের ন্যায় তার কাছেও সাম্প্রদায়িক পশ্চাদপদতা গণ্য হয়। নজরুলের বড় অক্ষমতা ও দুর্বলতা এখানেই। এ অক্ষমতার মূলে হলো, ইসলাম ও মুসলিমের বিজয়ে তাঁর অঙ্গীকারহীনতা। দুর্দান্ত অভাব এখানে ইসলামী চেতনার। হিন্দুদের কাছ থেকে তিনি যে প্রচুর সমাদর পাচ্ছিলেন -সেটিই তাকে আত্মতৃপ্ত ও বিভোর করে রেখেছিল। মুসলিমদের কল্যাণ নিয়ে ভাবার সময় তাঁর তেমন ছিল না। এখানেই নজরুল সাহিত্যের সবচেয়ে বড় বিভ্রাট -যা এসেছে তাঁর ঈমানের দুর্বলতা ও চেতনার ভ্রষ্টতা থেকে।
কাজী নজরুল ইসলামের বিশ্বাস, সাহিত্য রচনায় কোন রূপ উদ্দেশ্য থাকলে সাহিত্যের শ্রী হানি হয় -যা তিনি উক্ত চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। কোন মুসলিম কি এমনটি ভাবতে পারে? তাকে তো জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত বাঁচতে হয় একটি মাত্র উদ্দেশ্যকে অবলম্বন করে। সে উদ্দেশ্যটি হলো মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা ও তাঁর প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। সে হুকুমের বিরুদ্ধে এক মুহুর্তের বিদ্রোহও তার সমগ্র বাঁচাটাই ব্যর্থ করে দেয়। পণ্ড করে দেয় তার সারা জীবনের মেহনত। মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ তাঁকে জাহান্নামের আগুনে নিয়ে পৌছায়। তাই মু’মিনের জীবনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সীমিত নয়, সেটি থাকে প্রতি মুহুর্তের ভাবনায়, কথায় ও কর্মে। সেটি যেমন তার রাজনীতিতে, তেমনি সাহিত্যে ও শিল্পে। এজন্যই বুদ্ধিবৃত্তি হলো সকল ধর্ম ও সকল মতবাদের উপর মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার পবিত্রতম জিহাদ। ঈমানদার কলম ধরে নিজের মনে “সৃষ্টিসুখের উল্লাস” বাড়াতে নয়, বরং তা দিয়ে জিহাদ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের চেতনার ভূমিতে কুর’আনী সত্যকে বিজয়ী করতে। কিন্তু সে জিহাদ থেকে নজরুল স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে নিজেকে সরিয়ে নেন। এটি নজরুল জীবনের বিচ্যুতি। সে সাথে সেটি ছিল ইসলামের শাশ্বত এজেন্ডার সাথে গাদ্দারী।
দূষণ পৌত্তলিকতার
হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমান ঈমান থাকলে কোন ঈমানদার কি কখনো দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি ভরে ভজন বা কীর্তন লিখতে পারে? এরূপ পৌত্তলিকতায় কি ঈমান বাকি থাকে? সাহিত্যিক রূপে খ্যাতি লাভ কখনোই মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য নয়। সে তো প্রতি মুহুর্ত বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালাতে পূর্ণ আত্মসমর্পিত মুসলিম হওয়ার সাধনায়। সে লক্ষ্যে সে শুধু কলম ধরে না, অস্ত্রও ধরে। ঈমানদার মাত্রই সাহিত্যকে ব্যবহার করে সত্যকে বিজয়ী করতে এবং অন্যায়-অসত্যকে নির্মূল করতে। তাই দেব-দেবীর সন্মানে ভজন বা কীর্তন লেখা কোন সাহিত্য নয়, সেটি জঘন্য পাপকর্ম। ইসলামে এটি হারাম। উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ এক কদমও পা বাড়ায় না, সাহিত্য তাই উদ্দেশ্যহীন হয় কি করে? “সাহিত্যে কাব্যকে ছাপিয়ে উদ্দেশ্য বড় হয়ে উঠলে কাব্যের হানি হয়” নজরুল এ অভিনব বিশ্বাসটি কোত্থেকে পেলেন? এটি নজরুলের অজ্ঞতা। ইকবালের কবিতার ছত্রে ছত্রে একটি প্রবল উদ্দেশ্য মূর্তমান। তাতে কি তার কবিতার শ্রীহানী হয়েছে? সাহিত্যহানি নিয়ে নয়, মুসলিমকে সদা সতর্ক থাকতে হয় ঈমানহানি নিয়ে। কিন্তু নজরুলের কাছে কাব্যের যাতে হানি না হয় -সে বিষয়টি বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। কবিতার খাতিরে কবিতা লিখতে গিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নজরুলের কাছে সাহিত্যের অলংকার গণ্য হয়েছে। তার লেখা ভজন ও কীর্তনে তো সেটিই হয়েছে।“হিন্দুরা লেখক-অলেখক জনসাধরণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালবাসা দিয়েছে” -নজরুলের কাছে সেটি জীবনের অতি মূলবান অর্জন মনে হয়েছে। এ নিয়েই যেন তাঁর প্রচুর আনন্দ। ইসলামের মৌল শিক্ষা থেকে কতটা বিচ্যুতি ঘটলো এবং কতটা সুস্পষ্ট কুফরি হলো –তা নিয়ে নজরুলের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হিন্দুদের কাছে কতটুকু গ্রহনযোগ্যতা বাড়লো –সেটিই গুরুত্ব পেয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে পৌত্তলিক হিন্দুদের প্রশংসার কি আদৌ কোন মূল্য আছে? তাদের এ প্রশংসা তো রোজ হাশরের বিচার দিনে তাদেরই দলভূক্ত করবে। ঈমানদার তো প্রতি মুহুর্তে বাঁচে এবং কর্মে ও লেখনিতে আত্মনিয়োগ করে –এমন কি জিহাদে প্রাণ দেয় তো মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে। পৌত্তলিকদের কাছে তাদের কট্টোর শত্রু হওয়ার মধ্যেই তো মু’মিনের ঈমানদারী। পবিত্র কুর’আনে ঈমানদারের সে পরিচয়টি হলো “আশাদ্দু আলাল কুফ্ফার” অর্থ: কাফেরদের প্রতি কঠোর। আল্লাহর হুকুমের প্রতি গভীর নিষ্ঠা ও প্রবল আত্মনিয়োগের কারণে এমন কি নবী-রাসূলদের মত মহৎ গুণের মহা-মানুষগণও দেবদবীর উপাসকদের কাছে প্রিয় হতে পারেননি। তাদের হৃদয়ে ভালবাসার আসন অর্জনটি কি কোন মুসলিমের কাম্য হতে পারে? এখানে আপোষ হলে কি কেউ আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে বাঁচতে পারে?। ইসলাম তো ব্যক্তির জীবনে তাঁর বাঁচা মরার সুস্পষ্ট লক্ষ্য বেঁধে দেয়। এখানে কোন আপোষ চলে না, কোন বিচ্যুতি বা বিরতিও চলে না। কিন্তু নজরুল সে বিধানকে মানতে রাজী ছিলেন না। এক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের বদলে স্বেচ্ছাচারী হওয়াকে তিনি সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতা ভেবেছেন। ইসলামের পক্ষে নয়, সকলের মাঝে বাঁচাটিই তাঁর কাছে জীবনের ব্রত, সাধনা ও তপস্যা গণ্য হয়েছে। নজরুল সাহিত্যে বিভ্রাট ও চেতনার ভ্রষ্টতার আরো কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখলেন,“বাংলার শিয়রে প্রহরীর মত জেগে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গিরি হিমালয়। এই হিমালয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুণি-ঋষি যোগিরা সাধনা করেছেন। এই হিমালয়কে তারা সর্ব দৈব শক্তির লীলা নিকেতন বলেছেন। এই হিমালয়ের গভীর হৃদয়-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদী রূপে আমাদের মাঠে মাঠে ঝরে পড়েছে।” এখানে নজরুল হিমালয়কে বড় করে দেখলেন। সে পাহাড়ে মুণি-ঋষি-যোগির সাধনাও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। পৌত্তলিকতা যে তাঁর চেতনায় কতটা প্রবল ভাবে বাসা বেধেছিল -এ হলো তার প্রমাণ। বাংলার নদনদীর জন্ম হিমালয়ের হৃদয় গুহা থেকে সেটি তাঁর কবি মনকে আন্দোলিত করেছে। কিন্তু উল্লেখ নাই সেই মহান আল্লাহতায়ালার যিনি হিমালয়ের স্রষ্টা। নদ-নদীর স্রষ্টা যে হিমালয় নয়, বরং সেগুলির স্রষ্টা যে মহান আল্লাহতায়ালা -সেটিও তিনি ভূলে গেছেন। নজরুলের চেতনায় শিরক যে কতটা প্রবল ভাবে বাসা বেঁধেছিল -এ হলো তার নমুনা।
নজরুল ইসলাম লিখেছেন:
“এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির-আমাদের।
দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’
তাড়াবো আমরা, করি না ভয়
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
‘রামা’দের ‘গামা’দের।”
বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।
উপরুক্ত কবিতায় নজরুল ইসলাম কট্টর বাঙালি জাতীয়তা-বাদী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। সকল পরদেশীরা তাঁর কাছে শত্রু রূপে গণ্য হয়েছে। রামাদের সাথে তিনি গামাদেরকে তাড়ানোর শপথ জাহির করেছেন। এখানে ‘গামা’ বলে বুঝাতে চেয়ে অবাঙালি মুসলিমকে। নজরুল যে সময় এ কথাগুলো বলেছেন যখন বাংলার মুসলিমগণ অবাঙালি বিহারী, অসমিয়া, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ¸ গুজরাটি মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে। অর্থাৎ নিজ ভাষা, নিজ প্রদেশ ও নিজ অঞ্চলের উর্দ্ধে উঠে উপমহাদেশের মুসলিমগণ তখন উদ্বেলিত হচ্ছিল প্যান-ইসলামী চেতনায়। আর এটিই তো নির্ভেজাল ইসলামী চেতনা –যা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সাহাবায়ে কেরামদের হাতে মুসলিমদের গৌরব কালে। অথচ সে মুহুর্তে নজরুল ইসলাম চলেছেন উল্টো দিকে তথা ভাষাভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে -যা নিছক প্রাক-ইসলাম জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা। একমাত্র ইসলামের শত্রুগণই তাতে খুশি হতে পারে।
কাজী নজরুল ইসলাম আরো লিখেছেন:
“একবৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলিম
মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ।”
“মুসলিম আর হিন্দু মোরা দুই সহোদর ভাই
একবৃন্তে দুইটি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই।”
“ভারতের দুই নয়ন তারা হিন্দু মুসলিম,
দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান।
এ কবিতার মতলবটি কি? ‘দেশ জননী’র এ ধারণা নজরুল কোত্থেকে পেলেন। হিন্দু-মুসলিম যে দেশ জননীর প্রিয় যুগল সন্তান সে ধারণাটিই বা তিনি কোত্থেকে পেলেন? মুসলিম ও হিন্দু – উভয়কে তিনি দুই সহোদর ভাই বলেছেন। তাদের উভয়ের জন্ম ভারতের গর্ভে –সে কথাও বলেছেন। হিন্দুত্ববাদের গুরু বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরম” গান থেকে এ গানের পার্থক্য কোথায়? কথা হলো, হিন্দু-মুসলিম সহোদর ভাই হলে মুসলিমদের পক্ষে আলাদা সাহিত্য, আলাদা সংস্কৃতি, আলাদা রাজনীতি ও আলাদা দেশ গড়ার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে কি? এমন চেতনার ধারক হলে কি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেত? বাংলাদেশই বা প্রতিষ্ঠা পেত কী করে? নজরুল ইসলাম এখানে হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা রূপে হাজির হয়েছেন। এমন ব্যক্তিকে জাতীয় কবি বানালো দেশবাসীকে কিসের বাণী শোনানো হয় –সেটি কি গোপন থাকে?
নজরুল ইসলাম লিখেছেন:
“গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই.
নহে কিছু মহীয়ান
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ
অভেদ ধর্ম জাতি।”
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান” এ কথাই বা তিনি কোথা থেকে পেলেন? এখানে তিনি বেমালুম ভূলে গেছেন মহান আল্লাহর অস্তিত্বের কথা। এটি কি সৃষ্টিশীল কবিত্ব, না সনাতন পৌত্তলিক মিথ্যাচার? মানুষকে বড় করে দেখাতে গিয়ে তিনি এখানে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর অস্তিত্বই ভূলে গেলেন। ভূলে গেলেন নবীজী (সা:)’র কথা। ব্যক্তির ঈমান বা বেঈমানী তার জিহবাতে। এ জিহবার পিছনে কাজ করে তার অন্তর বা বিবেক। জিহবা বস্তুত সে বিবেকেরই প্রকাশ ঘটায়। কালেমা পাঠের মধ্য দিয়ে এ জিহবাই মহান আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়। তেমনি তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে কাফির রূপেও গণ্য হয়। প্রতিটি ব্যক্তির ন্যায় কবিকেও তাই কবিতার প্রতিটি চরণ লিখতে হয় আল্লাহতায়ালাকে প্রতিক্ষণ স্মরণের মধ্যে রেখে। তাঁকে বাদ দেয়ার অর্থ তাঁকে অস্বীকার করা। ‘অভেদ ধর্ম জাতি’র যে ধারণাটি তিনি পেশ করেছেন সেটিই বা তিনি কোত্থেকে পেলেন? এ ধারণাটি কি কুর’আন সম্মত? ইতিহাসের কোন কালেও মানুষ কি অভেদ ধর্ম জাতি ছিল? কুর’আনের ভাষায় মানুষ তো দ্বিজাতিতে বিভক্ত -একটি অনুসারী মহান আল্লাহর, অপরটি শয়তানের। নজরুল লিখেছেন,“মানুষ যে ধর্মের, যে বর্ণের, যে গোত্রের হোক, মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ।” মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ – এ ধারণাটাই বা তিনি কোত্থেকে পেলেন? কি বিস্ময়! কি গভীর অজ্ঞতা! বাংলাদেশের জাতীয় কবির মুখে এ কি জাহিলিয়াতপূর্ণ কথা? মানুষের একমাত্র পরিচয় নিছক মানুষ রূপে নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তাঁর ঈমানী সত্ত্বার। এবং সবচেয়ে বড় পরিচয়টি হলো এ পৃথিবী পৃষ্ঠে মানবই হলো মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র খলিফা। মহান আল্লাহর কাছে এটিই হলো মানবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। সে পরিচয় নিয়ে বাঁচার মধ্যেই মানব জীবনের প্রকৃত সফলতা। সে পরিচয় নিয়ে কে কতটা দায়িত্ব পালন করলো সেটিই নির্ধারণ করবে সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামের আগুনে যাবে। অথচ সে পরিচয়টি নজরুলের কবিতায় ব্যক্ত হয়নি।
এ কি উম্মাদনা কুফরির!
নজরুলের দর্শন, চেতনা ও মনের পরিচয় সবচেয়ে প্রবলতর ও স্পষ্টতর প্রকাশ ঘটেছে তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। নজরুল ভক্তদের কাছে এটিই নজরুলের শ্রেষ্ট কবিতা। নজরুলকে বুঝতে হলে তাই এ কবিতাটি বুঝতে হবে। এ কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরা যাক:
“আমি চির বিদ্রোহী –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি এক চির উন্নত শির
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
আমি মানি নাকো কোন আইন
আমি উম্মাদ!
…
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া
..
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।
…
আমি অজয় অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়
আমি মানব দানব দেবতার ভয়
জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য
আমি বিদ্রোহী ভুগু,ভগবান বুকে
একে দিই পদচিহ্ন;
আমি স্রষ্টা সুদন; শোক তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।”
এটি কি পাগলের প্রলাপ না কোন সুস্থ মানুষের কবিতা? এই কবিতায় নজরুল নিজের পরিচয়টি উম্মাদ রূপে দিয়েছেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, এরূপ কবিতা যে কোন সুস্থ মানুষের কবিতা হতে পারে না –সেটি নজরুল বুঝতেন। এখানে তাই উম্মাদ রূপে তার নিজের আত্মস্বীকৃতি। এ কবিতার ছত্রে ছত্রে আমি, আমি এবং আমি’র জয়গান। কবিতা জুড়ে নিজের তাকাব্বুরি তথা অহংকারের এক বিশাল বিস্ফোরণ। মহান আল্লাহর কাছে বান্দাহর সবচেয়ে বদ গুণটি হল তার তাকাব্বুরি তথা অহংকার। তাকাব্বুরি তথা নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবী করার অধিকার একমাত্র মহান রাব্বুল আ’লামীনের। এটি অমার্জনীয় গুনাহ। হাদীসে বলা হয়েছে: তাকাব্বুরি হলো মহান আল্লাহতায়ালার চাদর। তাকাব্বুরির দাবী করার অর্থ তাঁর চাদরে হাত দেয়া। হাদীসে আরো বলা হয়েছে, সামান্যতম তাকাব্বুরি তথা অহংকার থাকলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ঈমানাদারের বড় গুণ হলো তাঁর বিনয় বা অহংকারশূন্যতা। নজরুলের মন ও মননের সুস্পষ্ট পরিচয় মেলে তাঁর এই বিদ্রোহী কবিতায়। এ কবিতায় যেটির প্রবল প্রকাশ ঘটেছে সেটি যেমন বিদ্রোহের, তেমনি অবাধ্যতা ও অহংকারের। সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা স্রষ্টার সর্বময় সার্বভৌমত্ব ও আইনের বিরুদ্ধে। অথচ মুসলিম হওয়ার মূল কথা বিদ্রোহী হওয়া নয়। আইনের অবাধ্য হওয়াও নয়। বরং প্রতিটি কর্মে ও প্রতিটি উচ্চারনে তাঁকে অনুগত হতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের ও তাঁর শরিয়তী বিধানের। মহান আল্লাহতায়ালার পূর্ণ আনুগত্যের মাঝেই মুসলিমের মুসলিমত্ব। আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কোন বিদ্রোহ ও তাঁর আইনের বিরুদ্ধে যে কোন অবাধ্যতাই ব্যক্তিকে কাফিরে পরিণত করে। এজন্য মূর্তিপূজারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কাজী নজরুল ইসলাম কি সেটি জানতেন বা বুঝতেন না? জেনে-বুঝেও তিনি বিদ্রোহের পথটি বেছে নিয়েছেন। তাঁর বিদ্রোহী কবিতার মাঝে বিদ্রোহের সেই ঘোষণাটাই প্রবল।
জাতীয় কবিরা গুনাহ
যখন কোন কবিরা গুনাহ জাতীয় পর্যায়ে ঘোষণা দিয়ে করা হয় তখন সেটি শুধু ব্যক্তিগত গুনাহের পর্যায়ে থাকে না, সেটি তখন জাতীয় কবিরা গুনাহে পরিণত হয়। আর কোন গুনাহ –তা যত ক্ষুদ্রই হোক তা শাস্তির উর্দ্ধে নয়। তখন আযাব আসে সমগ্র জাতির উপর। বাংলাদেশীদের জীবনে এরূপ জাতীয় কবিরা গুনাহ দুটি। এক). সেটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গান “আমার সোনার বাংলা” গাওয়ার মধ্য দিয়ে। দেশকে মা বানিয়ে তার বন্দনা কোন ঈমানদার গাইতে পারে না। চন্দ্র, সূর্য ও আসমানের ন্যায় দেশের মাটিও মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। চন্দ্র, সূর্য যেমন পূজনীয় নয়, তেমনি পূজনীয় নয় দেশও। দেশকে মা বানিয়ে বন্দনা গাওয়া নিরেটি পৌত্তলিক হিন্দুত্ব। এ গানের মধ্যে রয়েছে পৌত্তলিকতার স্বীকৃতি। কোন ঈমানদার এ গান গাইলে তার ঈমান নষ্ট হতে বাধ্য। এই যুক্তিতেই বাংলার মুসলিমগণ ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের চাপিয়ে দেয়া বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরম” গানটি স্বুল-কলেজ ও সভা-সমিতিতে গাইতে অস্বীকার করে। ফলে সেটি বর্জিত হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, ব্রিটিশ আমলে হিন্দুত্ববাদীগণ যা করতে পারিনি, তা পেরেছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর। এটি একাত্তরে ভারতীয় বিজয়ের অন্যতম অর্জন। রবীন্দ্রনাথের এ পৌত্তলিক গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী দেশ শুধু ভারত একা নয়, বাংলাদেশও। মুজিবের শত শত মুর্তি গড়ে, শহীদ মিনারের নামে হাজার হাজার পূজার বেদীমূল গড়ে এবং সে মুর্তি ও বেদীমূলে নগ্নপদে ফুল দেয়ার মধ্য দিয়ে সে হিন্দুত্বেরই বিজয় কেতন উড়ানো হচ্ছে। দুই). দ্বিতীয় জাতীয় কবিরা গুনাহটি হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির আসনে বসিয়ে। নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বানানো যে কত বড় কবিরা গুনাহ -সেটি বুঝা যায় কাজী নজরুল ইসলামের নিচের কবিতাটি পাঠ করলে। এমন কবিতার সাথে কোন মুসলিম কি সজ্ঞানে একাত্ম হতে পারে? একাত্ম হলে সে কি মুসলিম থাকে? বাঁচে কি তাঁর ঈমান? সে কবিতায় কুফরির প্রকাশ যে কতটা তীব্র -সেটি বুঝার জন্য কি মুফতি বা মাওলানা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে? ইসলামের এই মৌলিক জ্ঞানটুকু যে কোন মুসলিমেরই থাকার কথা। নজরুল ইসলাম লিখেছেন:
“আমি মানব দানব দেবতার ভয়
জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য
আমি বিদ্রোহী ভুগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন”
এ চরণে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? কবিতার প্রতিটি চরন ও প্রতিটি শব্দের পিছনে একটি চেতনা সজ্ঞানে কাজ করে। কোন শব্দই মুখ থেকে নিজ শক্তিতে ও নিজ ইচ্ছাতে বের হয় না। মুখের কথার ভিত্তিতে মানুষের ফাঁসি বা শাস্তি হয়। এবং মুখের কথা কারণেই মানুষ জান্নাতের যোগ্য বিবেচিত হয়। উপরুক্ত চরণে নজরুল নিজেকে “জগদীশ্বর ঈশ্বর” দাবী করেছেন। এর অর্থ: তিনি নিজেই ঈশ্বর। ইবলিস শয়তানও এতো বড় স্পর্ধা দেখায়নি। আল্লাহতায়ালার হুকুমের অবাধ্য হলেও, মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে শয়তানের সামান্যতম সন্দেহ ছিল না। তাই সে দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করেছিল এবং ক্বিয়ামত অবধি দীর্ঘ জীবন কামনা করেছিল। শয়তানের সে দোয়া কবুলও হয়েছিল। “ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন” বলেই বা তিনি কি বুঝতে চেয়েছেন? ভগবান বলতে তিনি যদি পৌত্তলিকদের ভগবান বুঝিয়ে থাকেন তবুও কি তার বুকে পদচিহ্ন আঁকার অধিকার রাখেন? পবিত্র কুর’আনে পৌত্তলিকদের উপাস্যদের গালি দিতে নিষেধ করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা। কারণ, এতে তারাও মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে কটু কথা বলবে। তিনি নিজেকে ঈশ্বর দাবী করেন কি করে? যেমন ইচ্ছা তেমন কথা বলায় কোন কৃতিত্ব নেই। মুখ ও জিহবা থাকলে সেটি যে কেউ করতে পারে। বিবেকের সুস্থতা হলো, কথাবার্তায় সংযত ও সুশৃঙ্খল হওয়া। এতেই ব্যক্তিত্ব।
হযরত আলী (রা:) এজন্যই বলেছেন, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব হলো তার জিহবাতে। অর্থাৎ যা মুখে বলা হয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে তাতে। জিহ্বাই বলে দেয়ে কে মিথ্যাবাদী শয়তান, কে সত্যবাদী ঈমানদার এবং কে পাগল। ব্যক্তির সঠিক পরিচয়টি পেতে তাই গবেষণা লাগে না। প্রচণ্ড উম্মাদও চমক লাগানোর মত বহু কথা বলতে পারে। প্রশ্ন হলো, বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল যা কিছু বলেছেন তাতে সুর, ছন্দ ও ভাষার যতই চমৎকারিত্ব থাক, সেগুলিকে কি কোন সুস্থ চেতনার প্রতিফলন বলা যায়? নজরুলের অসংলগ্ন কথার চমকই বলে দেয় মানসিক দিক দিয়ে তিনি কতটা অসুস্থ, বিভ্রান্ত ও ঈমানশূণ্য ছিলেন। কাকে ইবাদত করতে হবে ইসলাম শুধু সে বিষয়েই নির্দেশ দেয় না, কাকে সন্মান করতে হবে সেটিও বলে দেয়। প্রশ্ন হলো, কোন ঈমানদার ব্যক্তি এরূপ অবাধ্য, অহংকারী, অসুস্থ ও আল্লাহদ্রোহী ব্যক্তিকে সন্মান দেখাতে পারে? এরূপ আল্লাহদ্রোহী ব্যক্তিকে সম্মান দেখালে কি ঈমান থাকে? এমন ভ্রষ্টতা এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে এমন বিদ্রোহীকে জাতীয় কবির সম্মান দিলে সে ভ্রষ্টতা ও বিদ্রোহকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পৌত্তলিকতাকে স্বীকৃতি দেয়ার চেয়ে কি এটি কম অপরাধ? বাংলাদেশীদের ভয়ংকর গুনাহ এখানেই।ঘরে ঘরে ও দেশজুড়ে এ গুনাহ হচ্ছে। নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির আসন দিয়ে শেখ মুজিব বস্তুত এক গুরুতর কবিরা গুনাহকে জাতীয়করণ করেছেন। বাংলাদেশে রয়েছে জাতীয় ফুল ও জাতীয় ফল। একই ভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে জাতীয় কবিরা গুনাহকেও। সেটি যেমন রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গাওয়াকে বাধ্যতামূলক করে, তেমনি নজরুল ইসলামের মত ব্যক্তিকে জাতীয় কবির আসনে বসিয়ে। শেখ মুজিবের অপরাধ অনেক। তিনি শুধু গণতন্ত্রের খুনি এবং ফ্যাসিবাদের জনকই নন, তিনি কবিরা গুনাহকে বাংলাদেশীদের জাতীয় সংস্কৃতি পরিণত করেছেন।
বিচ্ছেদ ইসলাম থেকে
মানুষ মানুষকে চেনে শুধু দেহের গুণে নয়। মনের গুণে ও চরিত্রের গুণে। অন্য জীব থেকে এখানেই মানবের পার্থক্য। মানবিক গুণেই অন্য জীব থেকে মানব শ্রেষ্ঠ। আর গুণের সে প্রকাশটি ঘটে শুধু কর্মে নয়, তার নাম ও নামকরণের পদ্ধতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা ও আচরনের মধ্য দিয়েও। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই মানুষে মানুষে পরস্পরে জানাজানি হয়, সে জানাজানির ভিত্তিতেই গড়ে উঠে মানুষের মাঝে ভাতৃত্ব ও বন্ধন। গড়ে উঠে সমাজ ও রাষ্ট্র। ইসলামে সন্তানদের নাম করণের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। তাই কে মুসলিম আর কে অমুসলিম, সেটি দেখার জন্য কারো অন্তরের গভীরে ঢুকার প্রয়োজন নেই। মানুষের সে সামর্থ্যও নেই। কিন্তু ব্যক্তি ও তার সন্তানদের নাম শুনেও তার ধর্ম, দর্শন, জীবনচেতনার একটি পরিচয় জানা যায়। নামই জানিয়ে দেয় সে কোন ধর্মের ও কোন সমাজের। নাম তাই ব্যক্তির চেতনা ও ঈমানের বিমূর্ত ঝাণ্ডা বা ব্রান্ডের কাজ করে। কিন্তু যে ব্যক্তিটি মুসলিম নাম-ধারন করতেই রাজী নন, তার কি আগ্রহ থাকে মুসলিম সমাজের অংশীদার হওয়ায়? সে কি আগ্রহী হয় ইসলামের শিক্ষা বা গুণ নিয়ে বেড়ে উঠায়? হয় কি মুসলিমের সাথে সমাজবদ্ধ? নজরুলের সমস্যা এক্ষেত্রে বিশাল। তার বিচ্ছেদটি ইসলাম ও মুসলিম সমাজ থেকে। তিনি নিজ জীবনে ও নিজ সংসারে ইসলামের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করেননি ইসলামের নাম করণের পদ্ধতিকেও। তাঁর পুত্রদের নাম ছিল: কৃষ্ণ মহম্মদ, অরিন্দম খালেদ, সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ (ডাক নাম লেলিন)। সন্তানদের এরূপ নামকরণের মধ্য দিয়ে তিনি অন্যদের জানিয়ে দিয়েছেন ইসলামের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি কতটা বিদ্রোহী।
নজরুল লিখেছেন, ‘বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলিও তুই মায়ের তরণ তল।’ নজরুল এখানে মা বলতে পৌত্তলিকদের দেবীকে বুঝিয়েছেন। দেবীর পায়ের কাছে পেশ করা জবা ফুলের মর্যাদা মহামান্বিত করতে তিনি এ চরণটি লিখেছেন। ক’জন হিন্দু লিখেছে এমন ভক্তিমূলক গান? এমন গানে বহু মুর্তি-পূজারী হিন্দুও অবাক হয়েছে। নজরুলকে তাদের নিজেদের লোক ভেবে দাদা বলে আনন্দধ্বনি দিয়েছে। এমনকি হিন্দু মহাসভার নেতা ড.শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীও নজরুলের সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন। দেবদেবীর প্রতি এরূপ ভক্তি ভরে কবি নজরুল অসংখ্য ভজন, কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন। তাঁর বাসায় থাকতেন এবং সে বাসায় মুর্তিপূজা করতেন তার শাশুড়ি গিরিবালা। নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা পক্ষাঘাত রোগে শয্যাশায়ী হলে শাশুড়ি গিরিবালাই তাঁর গৃহকত্রী হন। হিন্দু ধর্মে গিরিবালা ছিলেন অতি নিষ্ঠাবান। তিনি ঘরে মুর্তিপূজা করতেন এবং মাঝে মাঝে তীর্থযাত্রায় বেড়িয়ে পড়তেন।
আত্মসমর্পণ হিন্দু সংস্কৃতিতে
নজরুলের গৃহের পরিবেশটি কেমন ছিল সেটি প্রকাশ পায় কবি নজরুলের বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনের স্মৃতিচারণে। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন তাঁর এক সাথীকে নিয়ে রোজার মাসে কলকাতায় কবি নজরুলের বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন,“বল্লাম, আর একদিন সময় হাতে নিয়ে আসবো। আজ যাই, বিশেষ দরকার আছে।” কবি বল্লেন, “তা কিছুতেই হয় না। তা ছাড়া তুই রোজা আছিস। ইফতারের সময়ও হয়ে এসেছে। অন্ততঃ ইফতার তো করে যা।” তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। একটু পরে বাড়ির ভিতর থেকে কবির ভীষণ রাগারাগির শব্দ কানে এলো। অন্দরের দরওয়াজায় কান পেতে আমরা দু’জনে কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলাম। বুঝলাম, আমাদের নিয়েই কবি তাঁর শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করছেন। তার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, “যখন তিনি জানেন যে আমরা রোজা আছি, তখন কেন ইফতারী তৈরী করে রাখা হয় নাই?” তাঁর শাশুড়ী বলছেন, আমি কি জানি বাপু ইফতারী কাকে বলে, আর তাতে কি কি দরকার হয়।” এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং শয্যাশায়ী। নজরুলের গৃহের কত্রী তখন তার শাশুড়ী গিরিবালা। আর সে গিরিবালা মুর্তিপূজারী। রোজা কি, ইফতারী কি -সে খবর কি তার ছিল? কীরূপ সংস্কৃতির মাঝে নজরুল ও তাঁর সন্তানদের বসবাস ছিল এ হল তার নমুনা। তাঁর দুই পুত্র বিয়ে করে হিন্দু ঘরে। ছোট মেয়ে মিষ্টি কাজীও বিয়ে করে হিন্দু ঘরে।
সারা ভারতের ন্যায় বাংলাতেও সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন ধারা। একটি মুসলিমের, অপরটি হিন্দুর। এ সংস্কৃতি দুটির পরস্পরের লড়াই নিছক বাঁচার নয়, অপরটিকে প্রভাবিত করারও। হিন্দুদের লক্ষ্য, মুসলিমদের হিন্দুত্বে দীক্ষা দেয়া নয়। বরং হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব বলয়ে আনা। সেটির নমুনা হল আজকের পশ্চিম বাংলা। হিন্দু সংস্কৃতির জোয়ারে সেদেশের মুসলিমগণ যে কতটা ভাসছে তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। তিনি লিখেছেন, “বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করি পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালিত্বের বা বাঙালিবোধের একটি অন্বেষণ চলছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু বন্দোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার একটি বাঙালি স্বরূপকে উন্মোচন করতে চাচ্ছেন যে স্বরূপটা মূলত হিন্দুদের। তাদের পরিকল্পিত জীবন-চর্চায় কোন মুসলিম নেই। কিছুদিন আগে আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমি দেখেছি একটি মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিচয় চতুর্দিকে প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসীদের শতকরা ৩০ ভাগ মুসলিম, কিন্তু শতকরা একজনও বাঙালি বিত্তের মধ্যে নেই। যারা আছেন তাদের অনেকেই হিন্দু মেয়ে বিবাহ করেছেন। অনেকেই ধুতি পরেন এবং দু-হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে মুসলিম পরিচয়টি গোপন করেন। হিন্দুত্বের ওই আগ্রাসনের কথা বাংলাদেশের মুসলিমদের মনে রাখা দরকার।” (সুত্র: সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।
বাস্তবতা হল, কবি নজরুল হলেন তাঁদেরই একজন যারা সে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাছে সর্বাগ্রে আত্মসমর্পন করেছিলেন। নজরুলকে যারা জাতীয় কবির আসনে বসিয়েছেন তারা চায়, হিন্দু সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণে নজরুলকে অনুসরণ করুক। বাংলাদেশীদের মাঝে সে আত্মসমর্পণ যে কতটা বেড়েছে সেটি বুঝা যায় মুর্তি নির্মাণ, মুর্তির পদতলে ফুলদান, মঙ্গলযাত্রা, আলপনা আঁকা ইত্যাদি হিন্দুয়ানী আচার দেখে। দেশের বুদ্ধিজীবী বা সাহিত্যিকদের বড় দায়িত্ব হলো, দেশবাসীর চেতনা ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে শত্রুর হামলা থেকে রক্ষা করা। ভৌগলিক সীমান্তু রক্ষার চেয়ে সাংস্কৃতিক মানচিত্র রক্ষার কাজটি আদৌ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সত্য তো এটাই, সাংস্কৃতিক মানচিত্র যখন অরক্ষিত বা বেদখল হয় তখন ভৌগলিক মানচিত্রও বিনাযুদ্ধে শত্রুর দখলে যায়। ইসলামে মুজাহিদের কলমের কালির মর্যাদা তাই অতি উচ্চে। তারাই হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের মুজাহিদ। কিন্তু নজরুলের মত কবি-সাহিত্যিকের দ্বারা সে কাজটি হয়নি। ইসলামী চেতনা রক্ষার কাজটি না করে বরং তারা নিজেরাই হিন্দু সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। যারা নিজেরা আত্মসমর্পণ করে তাদের দিয়ে কি প্রতিরক্ষার কাজ চলে? শত্রুরা তখন সে আত্মসমর্পণকারীদের কোলে টেনে নেয়। নজরুল তাই প্রিয় ছিলেন অনেক মুসলিম বিদ্বেষীদের।
বিদ্রোহ ইসলামের বিরুদ্ধে
নজরুলের বিদ্রোহটি ছিল মূলত ইসলামের অনুশাসনের বিরুদ্ধে, হিন্দু পৌত্তলিকতা বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়। বরং তাঁর আত্মসমর্পণ ছিল পৌত্তলিকতার কাছেও। অসংখ্য ভজন, কীর্তন, শ্যামাসংগীত লিখে দেবদেবীর পদতলে নিজের আত্মসমর্পিত চেতনার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছেন। “রাজবন্দীর জবানবন্দী”তে তিনি লিখেছেন, আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। অমুর্ত সৃষ্টিকে মুর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কন্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী।” নজরুল এখানে নিজেকে ভগবানের অবতার রূপে জাহির করেছেন। প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব শব্দ, পরিভাষা এবং সেগুলির পিছনে একটি দর্শনও থাকে। শব্দ বা পরিভাষা সাহিত্যে একাকী আসে না, সাথে আনে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন, মূল্যবোধ ও ইতিহাস। তাই ভগবান, অবতার, দেবদেবী, মুর্তি, ভজন বা কীর্তনের সাথে সে ধর্ম ও দর্শন প্রকাশ পায় সেটি নিতান্তই হিন্দুর।
তবে নজরুল আল্লাহ-রাসূল, হামদ, নাতের কথা যে বলেননি তা নয়। তবে যে ভাবে বলেছেন সেটি ইসলামের রীতি নয়। আল্লাহতে বিশ্বাস ও তাঁর অনুশাসনের আনুগত্য মুসলিমের জীবনে ক্ষণিকের বিষয় নয়। সেগুলি শুধু কবিতার বিষয়ও নয়। বরং সেটি প্রতিমুহুর্ত ও প্রতিদিনের। সেটি চলে আজীবন। মুসলিমের জীবনে তাই কখনও হামদ-নাত আবার কখনো ভজন, কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত -সেটির সুযোগ নাই। একবার মুসলিম হওয়ার অর্থ আজীবনের জন্য এবং প্রতি মুহুর্তের জন্য মুসলিম হওয়া। নজরুলের জীবনে এখানেই চরম ব্যর্থতা ও অবাধ্যতা। তিনি দুই নৌকায় পা রেখেছেন। এটি তাঁর নিজ-আবিস্কৃত চরম বিভ্রান্তির নীতি, কুর’আন-সূন্নাহর নীতি নয়। ইসলাম হলো এক নৌকায় পা রাখার ধর্ম। সে নৌকাটি হতে হবে একমাত্র ইসলামের। মুসলিম হওয়ার পূর্ব-শর্তটি হলো, অন্য উপাস্য বা অন্য ধর্মের সাথে সম্পর্ক পুরাপুপি ছিন্ন করা। সে সম্পর্কটি ছিন্ন করার পরই অটুট সম্পর্ক গড়তে হয় মহান আল্লাহর সাথে। কুর’আনের ভাষায় সেটি হলো, ‘ইয়াকফুর বিত্তাগুত ওয়া ইউমিম বিল্লাহ।’ অর্থ: তাগুত তথা শয়তানের সাথে সম্পর্ক-ছেদ এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ক্ষণিকের জন্য হলেও সেটি বিদ্রোহ। যেমনটি ইবলিসের ক্ষেত্রে হয়েছিল। ইসলামে এমন বিদ্রোহী ব্যক্তিকে কাফির বলা হয়। সে বিদ্রোহটি যেমন কর্মে হতে পারে, তেমনি চিন্তা-ভাবনা, কথা-বার্তা ও সাহিত্যেও হতে পারে। নজরুল সাহিত্যে সে বিদ্রোহের ভাবটি প্রকট।
সৈনিক ব্রিটিশ বাহিনীর
নজরুল যখন সাহিত্যের মধ্য ময়দানে তখন ভারতীয় রাজনীতির প্রচণ্ড মেরুকরণ। তুমুল লড়াই চলছে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানেও। কলকাতা তখন সে লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র। এ নগরী তখন সমগ্র ভারতের রাজধানী। কলকাতাতে বসেই মাওলানা মুহাম্মদ আলী ইংরাজীতে কলম-যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন তাঁর “কমরেড” পত্রিকার মাধ্যমে। রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরীত হওয়ায় পর সেটিকে তিনি দিল্লি থেকে প্রকাশনা শুরু করেন। কলকাতা শহরে বসেই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সে যুদ্ধটি জোরে শোরে চালাচ্ছেন উর্দু ভাষাতে তাঁর “আল-হেলাল” পত্রিকার মাধ্যমে। আর মাওলানা আকরাম খাঁ শুরু করেছেন তার মাসিক মোহাম্মদী ও পরবর্তীতে দৈনিক আজাদ পত্রিকার মাধ্যমে। ভারতের রাজনীতির তখন ক্রান্তিলগ্ন। মুসলিমদের তখন ভাগ্য নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। মাওলানা মহম্মদ আলী ও তাঁর বড় ভাই মাওলানা শওকত আলী কলকাতা থেকেই শুরু করেছেন খেলাফত আন্দোলন। সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ বাংলার এবং সারা ভারতের আলেমগণ। অথচ লড়াইয়ের এ চুড়ান্ত দিনগুলিতে নজরুল ইসলামের জীবন কেটেছে চরম আদর্শিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তির মধ্যে।
১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তখন ওসমানিয়া খেলাফত টুকরো টুকরো করে সেখানে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব। হামলা শুরু হয় ইরাকে। এবং সে হামলার দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর উপর। তখন সে হামলা জোরদার করতে ব্রিটিশ বাহিনী তখন ভারত থেকে সৈন্য সংগ্রহে ব্যস্ত। হিন্দু, শিখ ও গোর্খারা তখন দলে দলে যোগ দিচ্ছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সে যুদ্ধে যোগ দেয়া যে হারাম, তা নিয়ে ভারতের কোন নিরক্ষর মুসলিমের মনেও সামান্যতম সন্দেহ ছিল না। সে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলিমগণ গড়ে তোলে খেলাফত আন্দোলন। ভারতীয় রাজনীতিতে সেটিই ছিল প্রথম গণআন্দোলন। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বহু সেক্যুলার ব্যক্তিও সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেনে। এমন কি গান্ধিও সে আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু কাজী নজরুল সেদিন ইসলামী বিধানের প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ করেনি। তিনি বরং বিদ্রোহ করে বসেন সে শরিয়তী বিধানের বিরুদ্ধে। তিনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের রাইফেল কাঁধে নিয়ে ইরাকের মুসলিম হত্যায় কাফিরদের বাহিনীতে যোগ দিতে দুই পায়ে খাড়া। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে এ হলো নজরুলের চরম গাদ্দারী। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল অবধি তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজদের সেনাদলে কাজ করেন। কিন্তু কাফির বাহিনীতে যোগ দেয়া নিয়ে তিনি কোন দিনই কোন অনুশোচনা বা দুঃখবোধ প্রকাশ করেননি। এই হলো নজরুলের বিবেক ও চেতনার মান!
এরপর সেনা বাহিনী থেকে ফিরে এসে ব্যস্ত হন শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন লেখা নিয়ে। প্রশ্ন হলো, এসব তিনি লিখলেন কোন যুক্তিতে? নিছক অর্থের জন্য? অর্থের প্রয়োজন কার না থাকে? কিন্তু নজরুলের জীবনে অর্থই যেন মূল চালিকা শক্তি হয়ে পড়ে। অর্থ-উপার্জন বাড়াতে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে খলিফার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম হত্যায় নেমেছেন, অন্যদিকে শ্যামাসঙ্গীত, ভজন ও কীর্তন লিখেছেন। লক্ষণীয় হলো, অর্থের অভাব যখন দূর হয়েছিল তখনও তিনি ইসলামী আক্বিদা বিরোধী গান লেখার অভ্যাস ছাড়েননি। গান লিখে তিনি প্রচুর অর্থ কামাই করেছেন, সে অর্থে ক্রাইসলার মটর গাড়ি কিনে সে আমলে কলকাতার শহরে বিলাসিতাও করেছেন। -াই (সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।
নজরুলের জীবনে স্বপ্ন ছিল। তাঁর জীবন ভিশন এবং মিশনও ছিল। নজরুল ভাষায় সেটি হলো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বাঁচার। এখানে ইসলামের পথে ও মুসলিম রূপে বাঁচাটির কোন উল্লেখ নাই। তার কবিতায়ও সেটি গুরুত্ব পায়নি। নজরুলের প্রচণ্ড ক্ষোভ মুসলিম আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে, কারণ তাঁরা তাঁকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছে। কিন্তু আলেমেরা তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন সে অভিযোগের জবাব তিনি দেননি। আলেমদের অভিযোগ, নজরুল তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারীক জীবনে এবং সাহিত্যে ইসলামে একনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। বরং ইসলামী অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছেন। তার জীবনে প্রতিফলন ঘটেনি ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষার।
ইসলামের উপর কিছু কবিতা-গজল লিখলেই মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্ম শেষ হয় না। তাঁকে জীবনের প্রতি ক্ষণে, প্রতি কর্মে, প্রতি কথা ও প্রতি আচরণে আল্লাহতায়ালার হুকুমের অনুগত হতে হয়। এক্ষেত্রে সামান্য অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ কাফেরে পরিণত করে। তাই মুসলিম কোন মূর্তি বা দেবতার প্রশংসায় কোন গান লেখা দূরে থাক একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। অন্তরে ঈমান থাকলে সেটির প্রতিফলন হতে হবে প্রতিটি কর্ম, কথা ও ভাবনায়। তাই সাহিত্যের অঙ্গনেও কোন মুসলিম ইসলামশূণ্য হতে পারে না। কর্মের খাতিরে কর্ম, কথার খাতিরে কথা বা সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য -এমনটি মুসলিমের সাজে না। মুসলিমকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় মহান আল্লাহর উপর ঈমান ও তাঁর হুকুমের প্রতি আনুগত্য নিয়ে। কাফির হওয়ার জন্য বার বার বিদ্রোহের প্রয়োজন পড়ে না, একটি মাত্র বিদ্রোহই যথেষ্ট। আজীবন জিহাদের ময়দানে থেকেও কোন ব্যক্তি যদি দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মাত্র একবার গান লেখে বা একবার পূজা দেয় তবে কি তার ঈমান থাকে? সেটি তো আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিছু হামদ-নাত লিখে সে বিদ্রোহের শাস্তি থেকে মুক্তি মেলে না। অথচ নজরুলের জীবনের এমন বিদ্রোহের সংখ্যা একটি নয়, অসংখ্য। যেমন তাঁর ব্যক্তি জীবনে, তেমনি সাহিত্যে। আল্লাহর বিরুদ্ধে সে প্রবল বিদ্রোহকে মুর্তমান করেছেন হিন্দুদের দেব-দেবীর প্রশংসা গেয়ে, অসংখ্য শ্যামা সঙ্গীত, ভজন ও কীর্তন লিখে। শিল্প ও সাহিত্যের নামে ইসলামের মূল আক্বিদা থেকে বিচ্যুতি কি কোন মুসলিমের শোভা পায়? নজরুল কি করে ভাবলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে এমন লাগাতর বিদ্রোহের পর আলেমগণ তাঁকে আল্লাহর ঈমানদার বান্দাহ রূপে গ্রহণ করবেন? আলেমদের মোল্লা বলে গালি দিয়ে কি তিনি নিজের বিদ্রোহকে জায়েজ করতে পারেন?
নজরুলের জীবনে আধ্যাত্মিকতা ও নামাজ-রোজার কীরূপ স্থান ছিল সেটিও দেখা যাক। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন,“ইতিমধ্যে নজরুল ইসলামের মধ্যে একটু একটু মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিল। আগেই শুনিয়াছিলাম তিনি বরদাবাবু নামক জনৈক হিন্দু যোগীর নিকট তান্ত্রিক যোগ সাধনা শুরু করিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলে কাজী সাহেব মিষ্ট হাসি হাসিতেন। ..একদিন অফিসে আসিয়া তিনি আমাকে বলিলেন: একটা জায়নামাজ ও ওযুর জন্য একটা বদনা কিনাইয়া দিন। তাই করা হইল। অফিসে দুতলার পিছন দিকে একটি ছোট কামরাকে নামাজের ঘর করা হইল। কাযী সাহেব সপ্তাহে দু’চার দিন যা আসিতেন এবং দুই-তিন ঘন্টা যা থাকিতেন তার সবটুকুই তিনি ওযু ও নামাযে কাটাইতেন। ওযু করিতে লাগিত কমছে কম আধ ঘন্টা। আর নামাযে ঘন্টা দুই। এ নামাজের কোনও ওয়াক্ত-বেওয়াক্ত ছিল না। কেরাত রুকু-সিজদা ছিল না। জায়নামাজে বসিয়া হাত উঠাইয়া মোনাজাত করিতেন এবং তারপরই মাটিতে মাথা লাগাইতেন। সিজদার মত কোমর উঁচা করিয়া নয়, কোমর উরুর সাথে ও পেট জমির সাথে মিশাইয়া। এই ভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা এক সিজদায় কাটাইয়া দিতেন। আমি যতদূর দেখিয়াছি, তাতে তিনি সিজদা শেষ করিয়া একবারই মাথা উঠাইতেন।” -(আবুল মনসুর আহমদ, আত্মকথা, পৃঃ ৩৬০)।
আরেকটা শিক্ষাপ্রদ বিষয় হলো তাদের জন্য যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নজরুলকে খাড়া করতে চান। বাংলাদেশে এমন একটি রবীন্দ্র-বিরোধী মহল চোখে পড়ার মত। এরা মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তাদের কথা, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কবি। রবীন্দ্র সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সে আগ্রাসনের মোকাবেলা নজরুলকে খাড়া করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নজরুলকে দিয়ে কি সেটি সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ একটি ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতীক। আর ধ্যান-ধারণার প্রতিরোধে শক্তিশালী ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস চাই। এজন্য কি কবি বা কবিতা জরুরি? কোন কবি যদি সে ধ্যান-ধারণার বাহক হিসাবে এগিয়ে আসেন তবে সেটি উত্তম। কিন্তু সেটি অপরিহার্য নয়। নবীজী (সা:)’র আমলে কাফিরদের দলে ইমরুল কায়েসের মত বিখ্যাত কবি ছিল। কিন্তু তার মোকাবেলায় মুসলিমগণ আরেক ইমরুল কায়েসকেও খাড়া করেননি। বরং ইমরুল কায়েসের কবিতা ও ধ্যান-ধারনাকে মোকাবেলা করেছেন ইসলামী দর্শন দিয়ে। অথচ বাংলাদেশে সেটি হয়নি। এখানে এমন একজনকে খাড়া করা হয়েছে যিনি নিজেই রবীন্দ্র-সাহিত্য ও তাঁর ধ্যান-ধারণার কাছে আত্মসমর্পিত। নজরুলের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবটি কেমন ছিল সেটি কবি নজরুলের নিজের কথাই শোনা যাক: “বিশ্ব কবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে যেমন করে ভক্ত তার ইস্টদেবকে পূজা করে। ছেলে বেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্-ধুপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে।” –(নজরুল রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২৪)।
যোদ্ধা হিন্দু সংস্কৃতির
ফলে নজরুলকে জাতীয় কবি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার অর্থ শুধু নজরুলের প্রতিষ্ঠা নয়, বরং নজরুল যে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ দর্শনের পূজারী তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। নজরুল-ভক্তদের দাবী তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশী ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের যুক্তি, কাজী নজরুল ইসলাম হামদ, নাতের পাশাপাশি ভজন, কীর্তন,শ্যামাসঙ্গীতসহ শত শত সেক্যুলার কবিতা লিখেছেন। ইসলামের পাশাপাশি হিন্দুধর্মের কথাও লিখেছেন। প্রশ্ন হলো, কোন মুসলিম যখন হিন্দু দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ভজন, কীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত লেখেন তাকে কি ইসলাম ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ বলা যায়? সেটি তো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা। এরূপ বিদ্রোহীকে কি নিরপেক্ষ বলা যায়? বাস্তবতা হলো, রবীন্দ্রনাথ যেমন ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, তেমনি নজরুলও নয়। প্রশ্ন হলো, কাজী নজরুল সমগ্র ভারত জুড়ে যে তাহজিব, যে জীবন-বোধ এবং যে সংস্কৃতির প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও বিজয় চাইতেন সেটি কি ইসলামী সংস্কৃতি? সে ইসলামী সংস্কৃতি কি নজরুলের নিজ জীবন ও নিজ ঘরেও কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? আর নিজ ঘরে বা নিজ পরিবারে তিনি যে সংস্কৃতির পরিচর্যা দিয়েছেন, ঘরের বাইরে তা থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা চাইবেন -সেটিই বা কীরূপে আশা করা যায়?
প্রকৃত সত্য হলো, রবীন্দ্রভক্তরা যে সংস্কৃতিকে ভারতে বিজয়ী করেছে, তারা বাংলাদেশেও সেটিরই বিজয় চায়। দুই দেশের মাঝের রাজনৈতিক মানচিত্রকে বিলুপ্ত না করতে পারলেও বিলুপ্ত করতে চায় সাংস্কৃতিক মানচিত্র। তাদের বিচারে রবীন্দ্রনাথের ন্যায় নজরুলও সে অভিন্ন সংস্কৃতির যোদ্ধা। নজরুল নিজেও যে কতটা মনেপ্রাণে রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্র ধ্যান-ধারণার প্রসার ও প্রতিষ্ঠা চাইতেন সেটি ফুটে উঠেছে নজরুলের নিজের রচিত কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি লিখেছেন:
“রবির শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে
সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধকারার বন্ধ ঘরে।
গগন-পথে রবি-রথের সাত সারথি হাঁকায় ঘোড়া,
মর্তে দানব মানব-পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া।”
কোন রবীন্দ্রভক্ত হিন্দুও কি রবীন্দ্রনাথের সন্মানে এমন কবিতা লিখেছে? নজরুল যে রবীন্দ্র-চেতনা ও রবীন্দ্র ধারায় মিশে গেছেন ও ভেসে গেছেন, সেটির প্রমাণ শুধু নজরুল সাহিত্য নয়। প্রমাণ মেলে নজরুলের প্রতি ভারতীয় হিন্দু এবং সে সাথে ভারত সরকারের স্বীকৃতির নমুনা দেখে। ভারত সরকার শুধু রবীন্দ্রনাথকে সম্মান দেখায়নি, সম্মান দিয়েছে নজরুলকেও। কবি নজরুলকে ১৯৬০ সালে ভারত সরকার দেয় ‘পদ্মভূষন’ পদক। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছিল জগত্তারিণী পদক। ভারত সরকার বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এমন পুরস্কার কাউকে নিছক তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য দেয় না। দেয় সাহিত্যের মূল সুর ও দর্শনটির জন্য। কোন কবির সাহিত্য ভারতের জাতীয় দর্শন ও হিন্দু আধিপত্যের বিরোধী হলে তাঁকে এরূপ পুরস্কার দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার বহু অর্থ ব্যয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্বে যুদ্ধ করেছে ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছে এ জন্য নয় যে পূর্ব সীমান্তে এক শক্তিশালী ইসলামী দেশ গড়ে উঠুক। বাংলাদেশের পৃথক ভূগোল মেনে নিতে রাজী হলেও রাজী নয় ইসলামী দর্শন ও মূল্যবোধ নিয়ে বাংলাদেশ বেড়ে উঠুক। বাংলাদেশীদের জীবন-চেতনা বা দর্শনটি কী হবে সে ক্ষেত্রে জাতির সামনে নির্দেশনা বা কম্পাস হল জাতীয় সঙ্গীত। এবং সেটি রবীন্দ্রনাথের। এ রবীন্দ্র-সঙ্গীতকে যেসব ভারতপন্থি নেতারা ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাদের মতলব একটাই। সেটি হল, এ সঙ্গীতের সুর, দর্শন ও ভাবনার সাথে বাংলাদেশীদের একাত্ম করা। বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতিও পরিচালিত হচ্ছে সে অভিন্ন লক্ষ্যে। তবে রবীন্দ্র-সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীত ও দেশে রবীন্দ্রচর্চা বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই ইসলামের বিপক্ষ শক্তির ডি-ইসলামাইজেশন প্রকল্প শেষ হয়নি। বরং সেটিকে বেগবান করার স্বার্থে সেক্যুলারিস্টগণ জাতীয় কবির আসনে বসিয়েছে প্রচণ্ড রবীন্দ্রপূজারী কাজী নজরুল ইসলামকে। নজরুলের নামের সাথে ইসলাম আছে বলে তাতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। এ নাম নিয়েই তিনি দেব-দেবীর নামে শত শত ভজন ও কীর্তন লিখেছেন এবং রবীন্দ্রনাথের মুর্তিতে পূজা দিয়েছেন। শ্মশান ঘাটে গিয়ে সাধু-সন্নাসীদের সাথে জঁপও করেছেন। তিনি নিজ ঘরে দেবদেবীর মূর্তি রেখেছেন এবং নিজ সন্তানদের হিন্দু নামের পাশাপাশি হিন্দু-সংস্কৃতিরও আবাদ করেছেন। কথা হলো, বাংলাদেশে যারা নজরুলভক্ত তারা কি সেটিই চায় যা নজরুল চেয়েছেন ও করেছেন? এজন্যই কি তাঁকে জাতীয় কবির আসনে বসানো হয়েছে? নজরুলকে সম্মান করার অর্থ তাঁর সাহিত্য-বিভ্রাট, তাঁর চেতনাগত বিচ্যুতি, ইসলামের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ ও পৌত্তলিকতার কাছে তাঁর আত্মসমর্পণকে সমর্থন করা। সেটি কি কোন মুসলিমের কাজ হতে পারে? সেটি তো ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের সাথে বেঈমানী। তাতে বিপন্ন হবে বাংলাদেশীদের আদর্শিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা। কোন মুসলিম কি সেটি মেনে নিতে পারে? ০৩/০৩/২০১১