একনায়কদের জীবনে একসময় সবচেয়ে বড় যে সমস্যা দেখা দেয়, সেটা হলো এক্সিট স্ট্র্যাটেজি বা সহজ বাংলায়—প্রয়োজন দেখা দিলে পালিয়ে যাওয়ার পথ খোলা রাখা। আর এ কারণেই বিভিন্ন সময় দেশে দেশে এদের দেখা গেছে, একদল পোষ্যের হাতে বিরোধীদের মেরেকেটে ঠান্ডা রাখার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। অন্যদিকে নিজের পরিবারের কোনো সদস্য বা একান্ত বসংবদ কারও হাতে যেন ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, তা নিশ্চিত করে নেওয়া। এমনটা করা গেলে এক্সিট স্ট্র্যাটেজি ষোলোকলায় পূর্ণ হয়ে যায় বলে এরা ধরে নেন। আর সেই পথ ধরেই লুটপাটের ঢালাও লাইসেন্স মিলে যায় বলে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একদিকে যেমন নিরাপত্তা বাহিনীগুলো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের দেখা যায়, লাগামহীন দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে নিতে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এ রকম পটভূমি নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘বৃদ্ধ দলপতির শরৎ’। উপন্যাসে দলপতির নাম উল্লেখ না থাকলেও আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না গল্পের পেছনে যে বাস্তব জীবন, কার কথা সেখানে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সেই চরিত্র হতে পারে প্যারাগুয়ের আলফ্রেডো স্ট্রয়েসনার, ডোমিনিকার রাফায়েল ত্রুখিলো, হাইতির পাপা ডক কিংবা নিকারাগুয়ার আনাস্তাসিও সামোজা। নাম এবং দেশ এদের ভিন্ন হলেও কর্মে এদের ছিল না কোনো ভিন্নতা।
বাস্তবের ছোঁয়া থাকা এ রকম কল্পকাহিনির তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে মারিও ভার্গাস ইয়োসার ‘অশান্ত সময়’। চলতি বছর ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত এই উপন্যাসে গুয়াতেমালার ট্র্যাজিক রাষ্ট্রনায়ক হাকোবো আরবেঞ্জের পার্শ্বচরিত্র হিসেবে উঠে এসেছেন মধ্য আমেরিকার ছোট্ট দেশ ডোমিনিকায় তিন দশক ধরে দাপটে শাসন করে যাওয়া একনায়ক রাফায়েল ত্রুখিলো এবং তাঁর গোয়েন্দাপ্রধান জনি আব্বাস গার্সিয়া। দুজনই উপন্যাসটিতে চিত্রিত হয়েছেন তাঁদের বাস্তব জীবনের মতোই।
ত্রুখিলো সেখানে এতটাই দাপটে যে প্রায় তিন দশক ধরে রাজত্ব তো করে গেছেন, একসময় ডোমিনিকার রাজধানীর নাম বদল করে রাখেন সিউদাদ ত্রুখিলো। বসংবদ এক অনুসারীকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়ে নিজের পুত্র রাম্ফিস ত্রুখিলোকে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান হিসেবে। তবে এরপরও শেষরক্ষা হয়নি। এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ত্রুখিলো নিহত হলে এর সবটাই উল্টে যায় এবং বসংবদ প্রেসিডেন্টই নিজেকে আসল উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করেন, ক্রুখিলোর পুত্রকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে। এর ফলে রাজধানী ফিরে পায় আগের নাম এবং ত্রুখিলো নিক্ষিপ্ত হন ইতিহাসের আবর্জনায়।
মধ্য আমেরিকা থেকে এবার মধ্য এশিয়ায় চলে আসি। সেখানকার তুলনামূলক সম্পদশালী দেশ কাজাখস্তান। মাত্র কিছুদিন আগে প্রায় অসম্ভব কিছু রদবদল সূচিত হয়েছে দেশটিতে। সেখানেও ত্রুখিলোর মতোই ক্ষমতার মসনদে পোক্ত আসন গেঁড়ে নিয়ে বসেছিলেন একসময়ের কমিউনিস্ট নূর-সুলতান নজরবায়েভ। লাতিন একনায়কদের ঐতিহ্য অনুসরণ করে নিজের আজীবন রাজত্ব করে যাওয়ার স্বপ্নই তিনি কেবল লালন করেননি, বরং প্রয়োজন হলে পালানোর একটি পথই তিনি প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন। নিজের এক বসংবদকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়ে নিজে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষদের আজীবন সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। পদটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্টের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও কার্যত সেটা ছিল প্রেসিডেন্টের ওপর ছড়ি ঘোরানোর পদ। এর বাইরে নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য তিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন দেশের সবকিছু লুটপাট করে নিজেদের মালিকানায় নিয়ে আসার সব রকম সুযোগ। আর সেই পথ ধরে গত তিন দশকে দেশের মোট সম্পদের অর্ধেকের বেশি অংশের মালিকানা চলে গেছে তাঁর তিন কন্যার হাতে এবং অবশিষ্ট অংশের বড় এক ভাগ রেখে দিয়েছেন নিজের এবং বর্ধিত পরিবারের অন্য সবার জন্য।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সময় কাজাখস্তান ছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পরিচালিত সোভিয়েতের অংশ, রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাইরে ব্যক্তির সম্পদ আহরণের সুযোগ যেখানে ছিল একান্তই সীমিত। সে রকম এক অর্থব্যবস্থা থেকে সহসা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণ হওয়া রাশিয়ার মতোই কাজাখস্থানেও খুলে যায় লুটপাটের পুঁজিবাদের অবাধে বিকশিত হওয়ার পথ, ইংরেজিতে যেটাকে বলে গ্যাংস্টার ক্যাপিটালিজম। তবে রাশিয়ার সঙ্গে শুরু থেকেই কিছুটা পার্থক্য কাজাখস্তানের ছিল। সেই পার্থক্য একদিকে যেমন হচ্ছে গ্যাংস্টার ক্যাপিটালিজমের ধরন বা প্রকৃতিতে, অন্যদিকে সেটা ছিল পালানোর পথ তৈরি করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায়।
রাশিয়ায় একসময়ের কালোবাজারি নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিয়ে রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী ব্যবসায়ী হিসেবে আবির্ভূত হলেও কাজাখস্তানে স্থানটি চলে যায় এককভাবেই নেতার পরিবারের কবজায়। অন্যদিকে রাশিয়ায় বরিস ইয়েলতসিন অল্প দিনের মধ্যে পালানোর পথ তৈরি করে নিতে প্রয়াসী হলেও কাজাখস্তানে নজরবায়েভ সেই পথে অগ্রসর হয়েছেন একেবারে শেষের দিকে। তবে উভয় দেশে এই ব্যতিক্রম সত্ত্বেও যে মস্ত বড় মিল লক্ষ করা যায়, তা হলো, নিজেদের বেছে নেওয়া উত্তরসূরিরাই শেষ পর্যন্ত এদের নিজেদের পতনের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছেন। ইয়েলতসিন নিজের পরিবারের জন্য নানা রকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিলেও নজরবায়েভের তুলনায় সেটা ছিল একেবারেই সীমিত।
নূর-সুলতান নজরবায়েভ কোনো পুত্রসন্তানের জন্ম দেননি। তিন কন্যার পিতা তিনি এবং পিতার খুলে দেওয়া লুটপাটের ময়দানে প্রায় চার দশক ধরে অবাধে বিচরণ করে তিন কন্যা কেবল দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হননি, সেই সঙ্গে তাঁদের স্বামীরাও গড়ে নিয়েছেন সম্পদের বিশাল পাহাড়।
ধন-সম্পদ অন্যদিকে যেমন নৈতিক অধঃপতনের পথে মানুষকে সহজেই ধাবিত করে, সে রকম পঙ্কিল পথেও এরা চার দশক ধরে সমানে হেঁটে গেছেন। তিন কন্যার প্রত্যেকেই একাধিক বিয়ে করেছেন, এর বাইরেও তাঁদের নানান প্রেম নিয়ে গুঞ্জন আছে।
পুত্রসন্তান না থাকায় পিতা নজরবায়েভ একসময় জ্যেষ্ঠ কন্যা দারিগা নজরবায়েভাকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের উত্তরসূরি হিসেবে, যেটা কার্যত ছিল পালানোর সহজ পথ। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাজাখ সমাজের মতো রক্ষণশীল কাঠামোয় সেই পরিকল্পনা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। তবে তিন কন্যার কেউই অবশ্য এতে অখুশি ছিলেন না। কেননা পিতার প্রভাব এদের জন্য অবাধ লুটপাটের যে সুযোগ করে দিয়েছিল, তা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে স্বাধীন কাজাখস্তানে এরা অচিরেই হয়ে ওঠেন ধনকুবের।
সোভিয়েত–পরবর্তী কাজাখস্তানের আর্থসামাজিক কাঠামো অবশ্য সেই কাজ এদের পাশাপাশি সদ্য আবির্ভূত হওয়া অন্যান্য নব্য ধনিকের জন্যও সহজ করে দিয়েছিল।রাশিয়ার মতোই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর কাজাখস্থানেও ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা ছোট আকারের ব্যবসাও ছিল অনুপস্থিত। রাশিয়ার মতোই সেখানেও সমাজতন্ত্র-পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সম্পদ লুটপাটের মধ্য দিয়ে, যে প্রক্রিয়ায় কাজাখস্তানে শুরু থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছে নূর-সুলতান পরিবার।
কাজাখস্তানের মূল সম্পদ বলতে সবটাই হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। তেল, গ্যাস এবং ইউরেনিয়াম ও অন্য কয়েকটি ধাতু বিক্রি করার ওপর দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল। উৎপাদন খাত বলতে শুরুতে তেমন কিছু ছিল না। সে রকম অবস্থায় অবশ্য প্রাকৃতিক সম্পদ সরাসরি নিজের মালিকানায় নিয়ে আসা ছিল কিছুটা সমস্যাসংকুল এবং নজরবায়েভ সেই পথে না এগিয়ে এসব সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে দিয়ে এর পরিচালনার জন্য গড়ে তোলা কোম্পানির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন নিজের তিন কন্যা ও বর্ধিত পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হাতে। এদের সম্পদের প্রাথমিক ভিত্তিও ছিল সেটা, যে পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে তিন কন্যা একসময় কেবল ব্যাংক-বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানই নয়, সেই সঙ্গে রেলযোগাযোগ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম ও এমনকি মোটরগাড়ির ব্যবসায়ও নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে কার্যত দেশটিকে নিজেদের মালিকানার সম্পদে পরিণত করে নিয়েছিলেন। তবে এক্সিট স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নেওয়ায় দেওয়া চালে ভুল হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবারের সামনে এখন আম-ছালা সবকিছু হারানোর মতো ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
কাজাখস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমরাত তোকায়েভ অবশ্য নজরবায়েভের হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে নজরবায়েভ নিজে প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দেন এবং নিজের পছন্দের প্রার্থী তোকায়েভকে সেই পদে বসান। এর ফলে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান হিসেবে আজীবন দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রেসিডেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন কাজ হবে না। এ সময়ে নিজের জন্য ‘এলবাসি’ বা দেশের নেতার অনানুষ্ঠানিক সম্বোধনও তিনি নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন এবং রাজধানী আস্তানার নাম বদল করে রাখা হয়েছিল নূর-সুলতান। সোভিয়েত আমলের সেমিপালাতিন্সক শহর স্বাধীন কাজাখস্তানে এসে রূপান্তরিত হয় আস্তানায় এবং পরে সেটাই হয়ে ওঠে নূর-সুলতান। এখন অবশ্য নতুন প্রশাসন এটাকে আবার আস্তানা নামে ফিরিয়ে নিয়েছে। শুরুতে উল্লেখ করা সিউদাদ ত্রুখিলোর কথা। নূর-সুলতান নজরবায়েভও সে পথেই হাঁটছেন এবং খুব দ্রুতই হাঁটছেন।
কাজাখস্থানের বর্তমান সংকটের সূচনা অর্থনীতির নিম্নমুখী ধারা থেকে হলেও অসন্তোষের বীজ রোপিত ছিল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর। বাহ্যিক দিক থেকে কাজাখস্তানকে চাকচিক্যময় এক দেশ মনে হলেও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেশটির অর্থনীতিকে করে তুলেছিল অনেকটাই ভঙ্গুর। ফলে সংকটের সময় মানুষের আয় সীমিত হয়ে এলে গণ–অসন্তোষ ক্রমেই দানা বেঁধে ওঠে এবং সাধারণ জনতা তাদের দুরবস্থার পেছনে যে একনায়কের পরিবার বড় ভূমিকা রেখেছে, তা সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। সহজ হিসাবে, সংকটের পেছনের কারণ হিসেবে এটাকে দেখা হলেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এতে রেখেছে।
তোকায়েভ হঠাৎ চলে আসা সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকেই কেবল বন্ধনমুক্ত করেননি, একই সঙ্গে দেশকেও বলা যায় নজরবায়েভ পরিবারের বন্ধন থেকে মুক্ত করার পথে এগিয়ে গেছেন। তবে সেই পথ তাঁর জন্য যে পুরোটাই ভবিষ্যতেও কণ্টকমুক্ত হবে, তা অবশ্য সহজে বলা যায় না। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাবেক সোভিয়েত বলয়ের সুরক্ষা জোটকে আমন্ত্রণ জানিয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে অনেকটাই কোণঠাসা করে ফেলতে তিনি সক্ষম হয়েছেন।
তবে প্রতিপক্ষ যে ভবিষ্যতে চুপচাপ বসে থাকবে, তা বলা যায় না। এদের হাতে আছে বিশাল সম্পদ এবং পেছনে আছে কাজাখস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি দেশটির কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগানোর সুযোগের অপেক্ষায় থাকা বাইরের বিশ্বের অন্য খেলোয়াড়েরা।
ফলে আগামীর দিনগুলো কাজাখস্তানের জন্য আসলেই হবে পরীক্ষার এক সময়। তা সত্ত্বেও বলা যায়, পিতার আশীর্বাদপুষ্ট তিন কন্যার শৃঙ্খল থেকে দেশকে বের করে আনা হচ্ছে বড় এক জয়। কেননা, দীর্ঘ তিন দশক ধরে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে নেওয়ার বাইরে অন্য কোনো অবদান তাঁরা আদৌ রাখেননি।
মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক