যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। ভিয়েতনামের পর বিদেশে যুদ্ধ নিয়ে এমন প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রে আর দেখা যায়নি। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে শিরোনাম হয়েছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রতিবাদ। তাঁরা ক্যাম্পাসে তাঁবু গেড়ে দাবি আদায়ের জন্য অবস্থান নিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের দাবি
শিক্ষার্থীরা গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থনের নীতি ও মদদ প্রদান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা অনতিবিলম্বে গাজায় গণহত্যা বন্ধ করা ও যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ইসরায়েলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিশু।
এ ছাড়া অসংখ্য নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিষদ ইসরায়েলকে সমর্থনকারী কোম্পানিগুলো বর্জনের দাবি জানিয়েছে এবং ইসরায়েল থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের বিষয়ে গণভোটের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাঁদের একজন, ইতিহাসের অধ্যাপক জনতার তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা করেন, ‘১৪ এপ্রিল, যেদিন ক্যাম্পাসে পুলিশ আক্রমণ চালায়, তা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক দিন হিসেবে অভিহিত হবে।’
দাতাদের হুমকি
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরু থেকেই ইহুদি বিলিয়নিয়ার ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দাতা রবার্ট ক্রাফট সাহায্য বন্ধের হুমকি দেন। তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের সর্বত্র শিক্ষার্থীদের, তাঁর ভাষায় ‘মারাত্মক ঘৃণা’ প্রসার ও ‘অ্যান্টি সেমিটিজম’ অব্যাহত থাকায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এটা মোকাবিলা করতে না পারলে তিনি সাহায্য বন্ধ করে দেবেন।
এ ছাড়া কলাম্বিয়ার স্নাতক আরেক বিলিয়নিয়ার লিওন কুপারমেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহায্য প্রদান বন্ধ করেন। অনুরূপভাবে পেনসিলভানিয়া ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহায্য প্রদান বন্ধ করেন জন হান্টস্ম্যান ও কেনেথ গ্রিফিন। বিল একম্যান নামের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক দাতা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা চান, যাতে করে তাঁরা কেউ ভবিষ্যতে চাকরি না পান।
রাজনীতিবিদদের ভূমিকা
গুটিকয় রাজনীতিবিদ ছাড়া সবাই ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের নিন্দা করেছেন। হোয়াইট হাউস শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ইহুদিবিরোধী আখ্যা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তাঁদের আন্দোলন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, কোনো দেশ বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়। মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার মাইক জনসন শিক্ষার্থীদের পুলিশ ও ন্যাশনাল গার্ডসের হুমকি দিয়েছেন ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে ব্যর্থতার জন্য কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও ছাত্রদের আন্দোলনের বিরোধিতা করে সরাসরি ক্লাসের পরিবর্তে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে ছাত্রদের দাবির মুখে আত্মসমর্পণ বলে বর্ণনা করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়া
এক সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলনে শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে শিক্ষার্থীদের তাঁবু উৎখাতের জন্য ডাকা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে, যার মধ্যে রয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ইলহান ওমরের ২১ বছর বয়সী কন্যা ইসরা হিরসি। তিনি বলছেন, গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
মোট যে আটজন ছাত্র বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁদের একজন বাংলাদেশের কন্যা মায়মুনা ইসলাম নুহা। নুহা পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে নিউরোসায়েন্সের তৃতীয় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত ছিলেন। নুহা মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে, ভয় না পেয়ে তাঁবু খাটিয়ে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাহসিকতার সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, নুহা আমার নিজের উপজেলা সন্দ্বীপের সন্তান।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংহতি প্রকাশ
গাজায় ইসরায়েলি হামলা ও গণহত্যার পর থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও এর বিপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা গ্রহণ চলে আসছিল। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলিস্তিনিদের সপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের কারণে তাদের ছাত্রী আসনা তাবাসসুম নামে ভালেডেক্টরিয়ানের সমাবর্তন বক্তৃতা বাতিল করে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদের সঙ্গে হার্ভার্ড, এমআইটি, ইয়েলসহ আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্রম যুক্ত হতে শুরু করছে ও তাদের ক্যাম্পাসে তাঁবু গেড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁদের গবেষণা কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ইসরায়েলের বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তাঁরা অবিলম্বে গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবি করছেন। ইহুদি সম্প্রদায়ের অনেক শিক্ষকও তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
রবার্ট রাইশের নিবন্ধ
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের সমর্থনে সাবেক মার্কিন শ্রমমন্ত্রী ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট রাইশ সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘গণহত্যার প্রতিবাদে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছেন, তা ইহুদিবিরোধী নয়’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন।
উল্লেখ্য, রবার্ট রাইশ নিজেও একজন ইহুদি। নিবন্ধে তিনি বলেছেন, শিক্ষার অন্যতম উপাদান হচ্ছে ভিন্নমত। শিক্ষার কাজই হচ্ছে প্ররোচিত করা। প্ররোচিত, অস্থির ও তাড়িত না হলে তরুণ মানস ও পশ্চাৎপদ ধারণায় আবদ্ধ হয়ে থাকবে। ভিন্নমত মানেই বিবাদ নয়। ভিন্নমত চিন্তার বিকাশ ও আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। ভিন্নমত, শিক্ষার্থীদের নিজেদের অবস্থান যাচাই করার ও বিষয়কে আরও গভীরভাবে অন্বেষণ করার সুযোগ দেয়।
আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি
আমাদের দেশের মতো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক দলের লেজুড় কোনো ছাত্রসংগঠন নেই। তবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সম্পর্কিত অনেক সংগঠন আছে। এমনকি ইয়াং ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান নামেও সংগঠন আছে। নির্বাচনকালে তারা নিজ নিজ দলের প্রার্থীর প্রচারে অংশ নেয়।
কিন্তু আমাদের দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম যেমন ছাত্র ভর্তি, ছাত্রাবাসের আসন বণ্টন, ক্যানটিনে চাঁদাবাজি, টেন্ডারের ভাগ নেওয়া, অস্ত্রের মহড়া, দাঙ্গা, হানাহানি, নির্যাতন করে হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো কার্যক্রমের ত্রিসীমানায়ও এসব ছাত্রসংগঠন ঘেঁষে না।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি
বুয়েটে রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুফল পাওয়া সত্ত্বেও আদালত থেকে তা আবার চালু করার নির্দেশনা এসেছে। বিস্ময়করভাবে বুয়েটের উপাচার্য রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্ররাজনীতিকে শিক্ষণীয় বলে এক উদ্ভট দাবি করেছেন। ছাত্ররা তাঁদের দাবিতে অনড় থেকে পরীক্ষা বর্জন করছেন।
আমাদের ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম, স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ সব আন্দোলনেই ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কলাম্বিয়া ও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ছাত্র আন্দোলন আমাদের অতীতের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় ছাত্ররাজনীতি ছিল ক্ষমতা, দুঃশাসন, অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে ক্ষমতার দাপট, স্বৈরাচার, অর্থনৈতিক ও নানাবিধ অনাচার থাকলেও আমাদের ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়। আমাদের দেশের বর্তমান ছাত্ররাজনীতি ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগের ও দুঃশাসনকে প্রলম্বিত করার প্রচেষ্টায় কালিমালিপ্ত, যা কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না। আমরা চাই ছাত্ররাজনীতি আগের মতো গৌরবময় ন্যায়ভিত্তিক, প্রতিবাদী অতীতে ফিরে যাক। এবং যত দিন তা না হচ্ছে, কেবল বুয়েট নয়; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা বন্ধ থাকুক।
পরিশেষে একজন শিক্ষক হিসেবে আমিও কলম্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করছি।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব