কলমানি সুদের হার ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে

 

দেশের কলমানি বাজারের সুদহার সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ওভার নাইট বা একদিনের জন্য এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ধারের সুদহার গতকাল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আর ৩২ দিন মেয়াদি সুদহার গিয়ে উঠেছে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশে, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

উচ্চসুদ ও তীব্র চাহিদা সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী কলমানি বাজারে টাকা পাওয়া যায়নি। এ কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক রেপো, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এএলএস) ও লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। কলমানি বাজারে গতকাল মোট লেনদেন ছিল ৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো ধার করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এর আগের দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা।

ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ব্যাংকগুলোয় তারল্যের সংকট তীব্র। এ কারণে কলমানি সুদহার এতটা বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণও আছে। অন্যথায় সুদহার আরো অনেক বেড়ে যেত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, কলমানি বাজারে গতকাল মোট ৯৬টি ডিলের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।

এসব লেনদেনে একদিন মেয়াদি ধারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে ১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আর ৩২ দিন মেয়াদি ধারে সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, লেনদেন হয়েছে ১০ কোটি টাকা। চারদিন মেয়াদি অর্থ লেনদেন হয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পাঁচদিন মেয়াদি ৪০১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে। ছয়দিন মেয়াদি ৩৯০ কোটি টাকা সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে লেনদেন হয়েছে।

এছাড়া সাতদিন মেয়াদি ২৮০ কোটি টাকার সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ১১ দিন মেয়াদি ৪০ কোটি টাকা সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে লেনদেন হয়েছে। ১৩ দিন মেয়াদে ১৩ কোটি টাকা লেনদেনে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ১৪ দিন মেয়াদি ধারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। এক্ষেত্রে লেনদেন হয়েছে ৭০৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ১৭ দিন মেয়াদি ধারে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং লেনদেন হয়েছে ২৩৫ কোটি টাকা। ২৮ দিন মেয়াদি ধারে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদে ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়। আর ৩১ দিন মেয়াদি ধারের ক্ষেত্রে গতকাল সর্বোচ্চ সুদহার ওঠে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশে। এক্ষেত্রে লেনদেন হয়েছে ৯০ কোটি টাকা।

বাজারে এক বছর আগের তুলনায় কলমা‌নি সু‌দের হার প্রায় দ্বিগুণ হ‌য়ে‌ছে। ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুদের ভারিত গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ বছরের জুনে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১৮ শতাংশে। গত ৩০ নভেম্বর সুদের হার আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশে। আর সর্বশেষ গতকাল কলমানির ভারিত গড় সুদহার ৯ দশমিক ১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

তারল্য সংকটের কারণে প্রতিদিনই সুদহার বাড়ছে বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিত বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে। ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহারও ১১ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছে। অন্য বিল-বন্ডের সুদহার এর চেয়েও বেশি। এ অবস্থায় কলমানির সুদহার বাড়বে এটিই স্বাভাবিক।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার প্রতিদিনই বাড়াচ্ছে। গ্রাহকরা ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় খেলাপি ঋণও বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা আরো দুর্বল হচ্ছে।’

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে এ বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার সংরক্ষণের শর্ত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এ-সংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেয়ার সময় রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্তও কমিয়ে দিয়েছে আইএমএফ। নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে এ বছর শেষে বাংলাদেশকে এখন ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে। এ শর্ত পূরণ করতে গত এক সপ্তাহজুড়ে বাজার থেকে ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকালও দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক থেকে ডলার কেনা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে নিট কত ডলার কেনা হয়েছে, সে তথ্য চূড়ান্ত করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনে নেয়ার প্রভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত এক সপ্তাহে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। গত ২০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২৭ ডিসেম্বর রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। দিন শেষে গতকাল রিজার্ভের পরিমাণ আরো বেড়েছে।

বাজার থেকে ডলার কিনে নেয়ায় দেশের ব্যাংকগুলোয় গত এক সপ্তাহে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা তারল্য যুক্ত হয়েছে। এ তারল্যের প্রভাবে নগদ টাকার সংকট অনেকটা কমে এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানিয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ তারল্য সংকট হবে বলে মনে করা হয়েছিল, সেটি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে বিপুল অংকের ডলার কিনেছে। এ কারণে বাজারে নতুন তারল্য যুক্ত হয়েছে। ডলার কেনায় রিজার্ভও সমৃদ্ধ হয়েছে।’

কলমানি বাজারের সুদহার বাড়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘কিছু ব্যাংক তারল্য নিয়ে চাপে আছে। এ কারণে কলমানি বাজারের সুদহার বেড়েছে। তবে বিদ্যমান সুদহার ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের চেয়ে এখনো কম। আশা করছি, নতুন বছরে সুদের হার কমে আসবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর নীতিতে রয়েছে।’

দেশের শরিয়াহ্ভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে ছিল। গত এক সপ্তাহে এসব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকেই প্রায় ২০ কোটি ডলার কেনা হয়েছে। ফলে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য কিছুটা বেড়েছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী অবশ্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২২-১২৫ টাকা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে। সে ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সংকট কাটাতে এ ব্যাংকগুলো নিজেদের লোকসান সত্ত্বেও কম দামে ডলার বিক্রি করেছে।’

বনিক বার্তা