Prothom Alo
জসীম উদ্দিন রাসেল
বর্তমান করব্যবস্থায় আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে কর রেয়াত এবং ন্যূনতম করব্যবস্থা একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আয়কর আইনে কর রেয়াতের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যক্তি করদাতার করের বোঝা হ্রাস করার উপায় থাকলেও অন্যায়ভাবে ন্যূনতম কর আরোপের কারণে নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কর রেয়াত এবং ন্যূনতম কর; উভয়ই নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ এবং উচ্চ আয়ের মানুষের সঙ্গে কর প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করছে। কর প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে কর প্রয়োগ করা উচিত, যাতে করে কর প্রদানের ক্ষেত্রে করদাতাদের মধ্যে কোনো অসম সুবিধা না থাকে। এ জন্য কর রেয়াত এবং ন্যূনতম কর উভয়ই বাতিল করা উচিত।
কর রেয়াত বাতিল করতে হবে কেন
আয়কর হিসাব করে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর বা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বাসকারী একজন বেসরকারি চাকরিজীবী করদাতার বছরে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন খাতে আয় হলে করদায় আসে ৫ হাজার টাকা।
যাঁদের আয় ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বা তার বেশি, তাঁরা কর রেয়াত-সুবিধা সম্পূর্ণ ভোগ করে করদায় লাঘব করতে পারেন। বিপরীতে যাঁদের আয় এই সীমার নিচে তাঁরা কর রেয়াত-সুবিধা ভোগ করতে ব্যর্থ হন। এবং এর অন্যতম কারণ হলো অন্যায্য ন্যূনতম করব্যবস্থা।
এখানে কর রেয়াত বাদ দেওয়া হলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠবে। এক. করদায় বেড়ে যাবে এবং দুই. করদাতার মধ্যে সঞ্চয়ের আগ্রহ কমে যাবে।
যেহেতু আয়ের ওপর ভিত্তি করে কর প্রদান করতে হবে, তাই আয়ের পরিমাণ যত বাড়তে থাকবে, করের পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে। এ জন্য নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতার জন্য কর ধাপ অনুযায়ী করহারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
বর্তমানে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করযোগ্য আয় অতিক্রম করার পর প্রথম ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ কর প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে এই ধাপটা বৃদ্ধি করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করা করা হলে নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতার করের পরিমাণ কিছুটা কম থাকবে। এর সঙ্গে ট্যাক্স অফসেট ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে করের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
ন্যূনতম কর বাতিল করে ট্যাক্স অফসেট চালু করুন
ন্যূনতম করের আওতা ব্যাপক। একজন সাধারণ গৃহিণী প্রতি মাসে অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেও যদি সঞ্চয়পত্র কেনেন বা ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, তাহলে সেখান থেকে যে মুনাফা প্রদান করা হয়, তা থেকে উৎসে ১০ শতাংশ কর কর্তন করা হয়। এই কর তিনি আর ফেরত পান না। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছ থেকে করের নামে টাকা কেড়ে নিচ্ছে।
তাই ন্যূনতম করব্যবস্থা বাতিল হলে একদিকে যাঁরা আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাইরে আছেন, তাঁরাও যেমন বাধ্যতামূলক আয়কর প্রদান থেকে মুক্ত হবেন, আবার তেমনি যাঁরা রিটার্ন দাখিল করেন, তাঁদের কর প্রদানের ক্ষেত্রেও আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য আসবে।
তবে কর রেয়াত-সুবিধা বাতিল হলে যাঁদের করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করবে, তাঁরা সবাই যেহেতু তাঁদের আয় অনুপাতে কর প্রদান করবেন, তাই নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতাদের জন্য ট্যাক্স অফসেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
এই ট্যাক্স অফসেট সুবিধা পাবেন দুই শ্রেণির করদাতা। এক. যাঁরা নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতা তাঁরা আয় অনুপাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ট্যাক্স অফসেট পাবেন, যা তাঁদের মোট করদায় থেকে বাদ যাবে। দুই. যাঁরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাস করবেন, তাঁরাও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ট্যাক্স অফসেট পাবেন। এই কর-সুবিধা অস্ট্রেলিয়ায় করদাতাদের জন্য রয়েছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কর প্রদানের ক্ষেত্রে সমতা আসলেও কর রেয়াত বাদ দিলে করদাতার সঞ্চয়ের কী হবে?
সর্বজনীন পেনশন তহবিল বাধ্যতামূলক করুন
বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হয়েছে। এটাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশে খুবই অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যৎ তহবিল আছে যেখানে চাকরিজীবী এবং চাকরিদাতা উভয়ে চাঁদা প্রদান করে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এই সুবিধা নেই। তাই দীর্ঘ সময় চাকরি করলেও অবসরে যাওয়ার সময় তাঁরা শূন্য হাতে বাড়ি ফেরেন।
যেসব প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যৎ তহবিল আছে, সেখানে সর্বনিম্ন ছয় মাস বা এক বছর চাকরি না করলে চাকরিদাতার অংশ চাকরিজীবী পান না। শুধু চাকরিজীবী যেটুকু চাঁদা দিয়েছেন, ওইটুকুই পান। এবং এই অংশটুকু পরিমাণে নগণ্য হওয়ায় অনেক সময় দেখা যায় খরচ হয়ে যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমানে মোট বেতনের ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুপারঅ্যানুয়েশন ফান্ডে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হয়। ১ জুলাই ২০২৫ থেকে এই হার ১২ শতাংশে উন্নীত হবে।
যখনই কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে যান, তখন তাঁকে তিনটি তথ্য প্রদান করতে হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ট্যাক্স ফাইল নম্বর (যেটা বাংলাদেশে কর শনাক্তকরণ নম্বর হিসেবে পরিচিত) এবং সুপার ফান্ডের নম্বর। একজন ব্যক্তি যেমন যেকোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, ঠিক তেমনি অসংখ্য সুপার কোম্পানি আছে, যেখানে সুপার অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।
কোনো চাকরিজীবী যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে এক দিনও কাজ করেন, তাহলে তাঁর ব্যাংকে যে বেতন দেওয়া হয়, তার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুপার অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়। এবং এই সুপার ফান্ডে যে ডলার জমা হচ্ছে, তা অবসরে যাওয়ার আগে উত্তোলন করা যায় না। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ৬৭ বছর হলো পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়স এবং এই বয়সের আগে এই ফান্ড থেকে ডলার উত্তোলন করা যায় না। চাইলে এক সুপার ফান্ড কোম্পানি থেকে জমা করা অর্থ অন্য সুপার ফান্ড কোম্পানিতে নেওয়া যাবে, কিন্তু উত্তোলন করা যাবে পেনশনের বয়স হলে।
এই ব্যবস্থার ফলে যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের দীর্ঘ সময় ধরে ডলার জমতে থাকে এবং অবসরে যাওয়ার পর তাঁরা ভালো একটা অঙ্ক পান, যা দিয়ে শেষ বয়সে চলতে পারেন।
বাংলাদেশেও যদি মোট বেতনের একটা অংশ এভাবে জমতে থাকে তাহলে অবসরে যাওয়ার পর শেষ বয়সে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়তে হবে না।
তাই কর রেয়াত না থাকলেও বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে না। বরং যাঁদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করার প্রয়োজন নেই, তাঁদেরও মোট আয়ের একটা অংশ পেনশন ফান্ডে জমতে থাকবে।
- জসীম উদ্দিন রাসেল অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
(মতামত লেখকের নিজস্ব)