- ইকতেদার আহমেদ
- ২৫ জানুয়ারি ২০২১
বিশ্বের উন্নত ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা- এ পাঁচটি জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। যেকোনো দেশে যখন একটি অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় তখন দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সে অধিকারটির নিশ্চয়তা বিধান রাষ্ট্রের আবশ্যিক কর্তব্য হিসেবে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রে আমাদের সার্কভুক্ত অপর চারটি দেশে যথা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ হতে এগিয়ে থাকলেও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এই চার দেশের মধ্যে মাথাপিছু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বিগত বছরের হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি মালদ্বীপের। দেশটির মাথাপিছুর স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় দুই হাজার ডলার। এর পরের অবস্থান যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ৩৬৯ ডলার, ভারত ২৬৭ ডলার এবং পাকিস্তান ১২৯ ডলার। বিগত বছর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৮৮ ডলার।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে এত নাজুক তা কোভিড-১৯ পরবর্তী এ দেশের মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী আমাদের দেশের সাংবিধানিক পদধারী, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিত্তশালী ব্যবসায়ী, সম্পদশালী পেশাজীবী প্রভৃতির বড় একটি অংশ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জটিলতায় দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তে বিদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতেন। তাদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশও এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং জায়গা-সম্পদ বিক্রি ও ধারকর্য করে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে পাড়ি জমানোর প্রবণতা দেখা দেয়।
আমাদের দেশের প্রতিটি উপজেলায় যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে তাতে শৈল্য চিকিৎসায় পারঙ্গম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদায়নের সংস্থান করা হয়েছে। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক চিকিৎসা প্রদানে ১০ জনের বেশি চিকিৎসকের পদায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। কার্যত দেখা যায়, বেশির ভাগ চিকিৎসকই মাসের উল্লেখযোগ্য সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুপস্থিত থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসায় নিয়োজিত। এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে জেলা সিভিল সার্জনদের অনেকেই নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি উপেক্ষা করে চলেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশাপাশি প্রতিটি জেলা শহরে ন্যূনতম ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এ সব সরকারি হাসপাতালের সব বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় লোকবল ও সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হলেও এর সুফল হতে সেবাগ্রহীতা জনমানুষ বঞ্চিত। তা ছাড়া বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে সরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় রয়েছে। এসব মহাবিদ্যালয়ের সাথে পৃথক সরকারি হাসপাতালের সংযুক্তি রয়েছে। এসব হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেয়ার লোকবল ও সরঞ্জামাদি থাকলেও কার্যত চিকিৎসাসেবার পরিধি অজানা কারণে অত্যন্ত সীমিত করে রাখা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একাধিক বিশেষায়িত হাসপাতাল পরিচালিত হয়ে আসছে। এসব হাসপাতালে দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকরা কর্মরত থাকেন। তবে সাধারণ মানুষের প্রায়ই স্বল্পতম ব্যয়ভারে এসব সরকারি হাসপাতালে তাদের কাছে হতে চিকিৎসাসেবা লাভের সুযোগ ঘটে না। এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে হলে সাধারণ মানুষকে উচ্চ ভিজিটের বিনিময়ে ব্যক্তিগতভাবে তাদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হয়।
আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বর্তমানে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেড়াজালে আবদ্ধ। প্রায়ই দেখা যায়, রোগীরা চিকিৎসকের চেম্বার থেকে প্রস্থান পরবর্তী ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সম্মুখীন হন। চিকিৎসক প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র দেখাতে অনেকটা বাধ্য করা হয়। প্রতিনিধিরা ব্যবস্থাপত্র অবলোকন পরবর্তী তাদের মোবাইলে এর চিত্র ধারণ করেন। ব্যবস্থাপত্রে তাদের প্রতিষ্ঠানের তৈরি ওষুধের নাম না থাকলে চিকিৎসককে এমনভাবে জবাবদিহি করেন; যাতে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটে। আমাদের চিকিৎসকদের উল্লেখযোগ্য অংশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে অনৈতিকভাবে প্রয়োজনাতিরিক্ত ওষুধের সমাহারে যে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন তা আজ কারো অজানা নয়।
কোভিড-১৯ পরবর্তী ২০২০ সালের প্রারম্ভে বিশ্বের প্রতিটি দেশ এবং দেশস্থ শহর একটি হতে অপরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমান, রেল, সড়ক ও নৌ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ৩-৬ মাস অতিক্রান্তের পর সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়, কলকারখানা এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যমগুলো খুলে দেয়া হলেও এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগও আগের মতো ব্যাপকতর নয়।
করোনা পরবর্তী দেখা গেল আমাদের দেশের রাজধানী শহরের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণাধীন সিএমএইচ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষায়িত ও স্বনামধন্য সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড চিকিৎসা প্রদানে যথাযথভাবে সক্ষমতাসম্পন্ন নয়। এ সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় এবং বিভিন্ন দেশ বহিরাগতদের আগমন নিষিদ্ধ করায় আমাদের দেশের যারা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণে অভ্যস্ত তাদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে ছেদ পড়ে। তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তারা আগামীতে দেশে চিকিৎসা গ্রহণ অব্যাহত রাখলে দেশের চিকিৎসাসেবার যে আমূল পরিবর্তন ঘটবে; এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের সম্পদ ও সামর্থ্য সীমিত হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে প্রতি বছর যে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয় তার যথাযথ ব্যবহার হলে স্বাস্থ্যসেবার মান অনেক উন্নীত হতো। বিগত এক যুগ ধরে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরঞ্জামাদি কেনার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এর বেশির ভাগই লোপাট হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ পদে আসীন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোতে কর্মরত প্রধানরা যেভাবে দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন; নীতি নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সীমাহীন অনিয়মে লিপ্ত হয়ে অবৈধ উপার্জনের পথ অবলম্বন করেছেন; নিজেদের আখের ঘোচানোর প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে দেশে-বিদেশে অঢেল বিত্তভৈবব ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তা দেশবাসীকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর অধীন প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল সংক্রান্ত দুর্নীতির সাথে যেসব ঠিকাদার বা সরবরাহকারী সম্পৃক্ত তাদের সবারর বিষয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যায় এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এতেই বোঝা যায় এদের ক্ষমতা ও প্রভাবের দৌরাত্ম্য।
কোভিড-১৯ মহামারী সংক্রমণের আগে ও পরে যেসব প্রবাসী দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন; পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতির পর তাদের পুনঃবিদেশ গমনের আবশ্যকতা দেখা দিলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষান্তে কোভিড নেগেটিভ সনদ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ দায়িত্বটি দেয়া হলে দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় এর ছত্রছায়ায় দুর্নীতির পরিধি বিস্তৃত করেন। এদের কেউ আইনের আওতায় বর্তমানে কারান্তরীণ হলেও শেষ অবধি তাদের সাজা নিশ্চিত করে দুর্নীতির কতটুকু প্রতিবিধান হবে তা নিয়ে অতীতের ঘটনাবলির আলোকে দেশবাসীর মধ্যে অনেকেই সন্ধিহান।
বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ মহামারীর টিকা প্রদানের ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। প্রায় সব দেশই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টিকা প্রদানের ব্যয়ভার মিটানোর ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে। প্রায় প্রতিটি দেশই সচেষ্ট স্বল্পব্যয়ে কিভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ থেকে রক্ষা করে জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে মহামারীর টিকাদান কার্যক্রমকেও কেউ কেউ অর্থ উপার্জনের অবলম্বন বিবেচনায় অর্থলিপ্সায় উন্মত্ত।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি দীর্ঘকাল ধরে সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় স্বাস্থ্য খাতকে পঙ্গুত্বের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে। কোভিড-১৯-এর কারণে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির যে উন্মোচন ঘটেছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি দেশপ্রেম, সততা ও নীতিনৈতিকতা দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে এগিয়ে আসি; তাতে আগামীতে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। আমরা হয়তো দেশেই সব ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের দ্বার উন্মোচনের পথ সুগম করতে সফল হবো।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]