এবারের বাজেট আমাদের দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে নির্বাচন, এদিকে আইএমএফের প্রস্তাবনা অনুসারে আমাদের আয়কর সংগ্রহ বাড়াতেই হবে। কর জিডিপি (মোট জাতীয় উৎপাদন) অনুপাতে বাংলাদেশ অনেক নিচের দিকের একটি দেশ। এ জন্য মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছে, আবার কী বোঝা এসে পড়ে? জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত বোঝা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে। এ দেশে যে কর দেয়, তার ওপরই দিন দিন বোঝা বাড়ে। আর অন্যরা সব সময় সুবিধাভোগী।
সাধারণ মানুষের চাওয়া এখন মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ ও জনবান্ধব একটা বাজেট। যে উচ্চ জিডিপি মধ্য-নিম্নআয়ের সুবিধা দিতে পারে না, সে জিডিপি কম থাকলেও আসলে আমাদের খুব বেশি ক্ষতি নেই, বরং করের বোঝা না বাড়িয়ে, খাত বাড়ানো, আর যারা কর ফাঁকি দেয় তাদের ধরাই বাঞ্ছনীয়।
সরকার যাতে তার আয়সীমা বাড়াতে পারে এবং জনগণের জন্যও বাড়তি বোঝা না হয়, তার জন্য কিছু প্রস্তাব রইল।
ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর-সংক্রান্ত প্রস্তাব
ক. ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর সীমা পুনর্নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি এবং নিম্নসীমা অন্তত ৫ লাখ করতে হবে। এত কম নিম্নসীমা আমাদের আশপাশের কোনো দেশে নেই।
খ. বর্তমানে প্রদত্ত হার অনুসারে কার ও নেট সম্পদ নির্দিষ্ট সীমা ছড়িয়ে গেলে সারচার্জ দেওয়া লাগে, যা ট্যাক্স আইনের নীতির পরিপন্থী। একজন ট্যাক্স দিয়েই সম্পত্তি বানিয়েছে, যেখানে সারচার্জ ডাবল ট্যাক্সেশনের অনুরূপ এবং সঞ্চয়কে নিরুৎসাহী করে।
গ. ব্যক্তির নিম্ন কর হার যদি উৎসে কর্তন করা করের থেকে কম হয়, তাহলে সেই টাকা ফেরত দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। যা আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আছে।
ঘ. আয়কর বিধির ১৯৮৪ ৩৩ জি (১) (খ) অনুসারে অফিস ইচ্ছা করলেও কোনো কর্মচারীকে অবকাশযাপনের জন্য দুই বছরে একবারের বেশি বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দিতে পারে না। এর ফলে কোম্পানি ইচ্ছা করলেও কর্মীদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে সাহায্য করতে পারে না। তাই এ ধারা বাতিল করা হোক।
ঙ. কর্মীদের চিকিৎসা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, যা বাতিল করে প্রকৃত ব্যয় করে দেওয়া উচিত। এর ফলে অনেক নিম্ন আয়ের কর্মীদের সুবিধা হবে।
চ. বর্তমান আইনের ষষ্ঠ তফসিলে প্যারা ২০ অনুসারে কর্মীদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হলে ট্যাক্স যোগ্য। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন আয় করমুক্ত। বেসরকারি-কর্মচারীদেরও তাই অনুরূপ হওয়া উচিত। এক দেশে দুই রকম আইন উচিত নয়।
জ. আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ধারা ৩০ (ই) এবং ২ (৪৫) এর মাধ্যমে বেতনের পারকুইজিট সীমা ১০ লাখ করে দেওয়া হয়েছে এবং পারকুইজিটের মধ্যে বাসাভাড়া, ছুটি অবসায়ন ভাতা, যাতায়াত ভাতা ইত্যাদি ভাতাকে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দ্বৈত করারোপ করা হয়েছে। কারণ, ব্যক্তি খাতে কর দেওয়ার পরও কোম্পানিরও কর দেওয়া লাগে, যা আয়কর নীতির পরিপন্থী। এই ধারা বাতিল করে দেওয়া উচিত।
আইনে অসামঞ্জস্য
ক. আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ধারা ৩০ (এইচ) এ রয়্যালটি, কারিগরি জ্ঞান বা অনুরূপ ব্যয়ের সীমা নেট মুনাফার ১০ %। কিন্তু বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিময় আইন এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্দেশিকাতে মোট টার্নওভারের ৬% আছে। বেশির ভাগ দেশেই এ রকম কোনো উচ্চসীমা নেই আর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমাদের প্রতিনিয়ত বাইরের অভিজ্ঞদের সাহায্য দরকার। তাই এই অসামঞ্জস্য দূর করে টার্নওভারের ৬ শতাংশ করে দেওয়া উচিত।
খ. বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন ফান্ড, প্রভিডেন্ট ফান্ডে রক্ষিত টাকা ব্যবহারের বিভিন্ন পর্যায়ে টিডিএস দিতে হয় এবং এই ফান্ডে রক্ষিত টাকার সুদের ওপরও ট্যাক্স কাটা হয়। কিন্তু শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে এই আয় আয়করমুক্ত। তাই শ্রম আইন অনুসারে, এসব ধারার সমন্বয় করা হলে কর্মীদের উপকার হয়।
উৎসে ট্যাক্স কর্তনের (টিডিএস) নিয়ম সমন্বয়
ক. আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ধারা ৮২ (সি) এবং ৫৬ (১) অনুসারে মোট প্রাপ্তির ওপর শতকরা ০.৬ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত টিডিএস কাটা হয়, যা আয়কর আইনের মূল নীতির বিপক্ষে। আয়কর কাটতে হবে মুনাফার ওপর, কিন্তু এখানে আয়ের ওপর কাটা হচ্ছে। তাই এই টিডিএস বাদ দিয়ে আইসিএবি প্রণীত ডিভিএস (ডকুমেন্টস ভ্যারিফিকেশন সিস্টেম) আয়-ব্যয় শনাক্ত করে যৌক্তিক টিডিএস কাটা উচিত।
খ. আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ধারা ৮২ সি (৬) ধারা অনুসারে এক বছরের প্রদেয় ট্যাক্স পরের বছরে সমন্বয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক কোম্পানি ব্যবসাতে লস খেতে পারে। তাই তার প্রদেয় ন্যূনতম ট্যাক্স বা টিডিএস থাকবে তা পরের বছর সমন্বয়ের সুযোগ থাকলে অনেকেই আয়কর দিতে উৎসাহী হবে। কর প্রদান সহজীকরণের টিডিএসকে ন্যূনতম কর হিসেবে বিবেচনা করার বিধান তুলে দেওয়া উচিত।
আধুনিকায়ন
১. ধারা ৫৩ এফ অনুসারে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট কাটার পর আবার সার্টিফিকেট নেওয়া হয়, যা তুলে দিয়ে ব্যাংক স্টেটমেন্টকেই সার্টিফিকেট হিসেবে গ্রহণের অনুরোধ করা হচ্ছে। অতিরিক্ত সার্টিফিকেটের জন্য অতিরিক্ত অর্থ আর সময় ব্যয় হয়, যা কমলে সবার জন্যই উপকার হয়।
২. বর্তমানে আর্থিক খাতে সংরক্ষিত তথ্যাদি নিয়ন্ত্রণের কোনো আইন নেই। কিন্তু এখন সব ব্যাংকই যেহেতু অনলাইন হয়ে গেছে এবং তা কোম্পানির ই-টিন দিয়ে যুক্ত, তা সরকার দ্বারা মনিটর করলে করদাতার আয়ে স্বচ্ছতা আসে এবং কর ফাঁকি দেওয়াও কম হয়।
৩. বাংলাদেশের ট্যাক্স, ভ্যাট এবং কাস্টমস অথরিটির সঙ্গে সমন্বয় অতীব জরুরি। না হলে সরকার তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যেতে পারবে না এবং অনেকের ওপর বাড়তি বোঝা হবে না।
৪. বাংলাদেশে একটা কোম্পানি এককালীন ৫ লাখ এবং বাৎসরিক ৩৬ লাখ টাকা নগদ লেনদেন করতে পারে। এটা আসলে যত কমিয়ে দেওয়া যায়, তা সবার জন্যই ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক ব্যবসা অপ্রতিষ্ঠানিক। তাদের যদি একটি কাঠামোর মধ্যে না নিয়ে আসা যায়, তাহলে নগদ লেনদেন কমানো সম্ভব নয়। তাই অপ্রতিষ্ঠানিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে নিয়ে আসতে হবেই, না হলে সরকারকে অনেক ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া সম্ভব। তার আগপর্যন্ত এই লিমিট আর একটু বাড়িয়ে দিলে ভালো হয়।
৫. অর্থ আইন অনুসারে কোনো সময়সীমা উল্লেখ না থাকলে মাঠপর্যায়ে যেকোনো পরিবর্তন রেট্রোস্পেকটিভলি বা গত বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হিসেবে ধরা হয়, যা বাতিল করা উচিত। কারণ, এজিএমে এসব হিসাব-নিকাশ করে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেই অনুযায়ী বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তাই সব পরিবর্তন দুরূহ। এ রকম আইন অন্য দেশে নজিরবিহীন। তাই ভবিষ্যতে যে পরিবর্তনই হোক, তা যেন পরবর্তী বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।
৬. বর্তমানে যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালে যেতে হলে একটা বড় ট্যাক্সের অংশ জমা দিতে হয়। এটা কমানো উচিত। আইনের সুবিধা পেতে বাধা প্রদান অনুচিত কাজ।
৭. সম্পত্তি নিবন্ধনে সরকারি হিসাব বাস্তবতার থেকে অনেক কম। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ফি অনেক বেশি। এদিকে সরকারের নিবন্ধন হার কম হওয়াতে অনেক টাকা কালো হয়ে যায়। তাই সরকার যদি এই হার পুনর্নির্ধারণ করে, ফি কমিয়ে দেয়, রাজস্ব আয় আরও অনেক বাড়বে।
৮. যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে কর প্রদান করে তাদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করলে অন্যরা ও উৎসাহী হতো।
৯. খাদ্য শিল্প কর অবকাশ সুবিধার বাইরে। কিন্তু এখনকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তাদের কর অবকাশ দেওয়া হলে কিছু খাদ্যপণ্যের দাম অন্তত কমত।
১০. বাংলাদেশে উৎপাদনকারী ব্যতীত অন্য কারও সরবরাহকালে ট্যাক্সের সঙ্গে বিক্রয়কালীন ট্যাক্স সমন্বয়ের সুযোগ নেই, যা পাশের দেশ ভারতে আছে। যেমন একজন ব্যবসায়ী ১০০ টাকা দিয়ে একটি পণ্য কিনেছে এবং কেনার সময় ৫ টাকা ট্যাক্স দিয়েছে। ব্যবসায়ী যখন এই পণ্য ১৫০ টাকায় বিক্রি করবে, তখন তাকে ১৫০ টাকার ওপর উৎসে কর দিতে হবে। পণ্য কেনার সময় প্রদেয় কর পণ্য বিক্রির সময়ে প্রদেয় করের সঙ্গে সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নেই। ফলে দ্বৈত কর হয়ে যায়। বাংলাদেশে উৎপাদনকারী হতে ট্রেডারের সংখ্যা বেশি এবং এই নিয়মের জন্য জিনিসপত্রের দাম বেশি পরে।
১১. ‘র’ ম্যাটেরিয়াল আমদানিকালে উচ্চ করের জন্য, পরে বিক্রয়কালে ভোক্তাপর্যায়ে দাম অনেক বেশি হয়ে যায়। ফলাফল ব্যবসাতে কাঙ্ক্ষিত বিক্রয় হয় না। সরকার ও কাঙ্ক্ষিত ট্যাক্স-ভ্যাট পেতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যাপারের সমন্বয় জরুরি।
আয়কর আইন অনেক বড় ব্যাপার। বিভিন্ন চেম্বার থেকে ইতিমধ্যেই সরকারকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সামনে আরও হবে। সেই সবের আলোকেই আমি কিছু কিছু প্রস্তাব দিয়ে গেলাম, সরকার যদি বাস্তবায়ন করে, সরকারের আয় কমবে না, বরং বাড়বেই এবং মানুষের ওপরও বাড়তি বোঝা হবে না।
- সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
মেম্বার, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। সাবেক মেম্বার, ট্রেড কমিটি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি;
ই-মেইল: subail 001 @gmail. com