কমেছে সাজার গতি, বাড়ছে আত্মসমর্পণ

কমেছে সাজার গতি, বাড়ছে আত্মসমর্পণ

অবশেষে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুরোনো মামলায় সাজার গতি কমেছে। যদিও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে পুরোনো মামলার রায়ের গতি ছিল ব্যাপক। এখন বেড়েছে সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর আদালতে আত্মসমর্পণ। রমজানের শুরু থেকে আত্মসমর্পণ করেছেন শতাধিক নেতাকর্মী। জামিন নামঞ্জুর হয়ে কারাগারে গেছেন তারা। আরও অনেকে নিচ্ছেন প্রস্তুতি। ‘উত্তাপহীন’ রাজনীতিতে সহজে আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্তি মিলতে পারে– এমন আশায় আদালতে হাজির হওয়ার এ হিড়িক। কবে নাগাদ মুক্তি মিলবে, তা কেউ বলতে পারেন না। অনেকে আশা করছেন, দ্রুত সময়ে তারা আবারও পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন, অবসান ঘটবে ফেরারি জীবনের। তবে আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে মুক্তি মিলবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে অনেকের।

বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের ডামাডোল, সারাদেশে বিরোধী নেতাকর্মী গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান; অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে থাকা পুরোনো মামলায় একের পর এক সাজা ঘোষণা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দলটির দাবি, গত বছরের জুলাই থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৮৪ মামলায় ১ হাজার ২৯৪ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত অক্টোবরের পর থেকে ৫১ মামলায় ৮৬১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঘোষিত রায়ের বেশির ভাগই ২০১৩ ও ২০১৮ সালের মামলা। ঢাকা মহানগর মুখ্য বিচারিক হাকিম, ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এবং ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতসহ অধস্তন আদালত এসব মামলার রায় ঘোষণা করেন।

জানা গেছে, দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, গ্রাম সরকারবিষয়ক সহসম্পাদক বেলাল আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি, হাবিবুর রশিদ হাবিব, আকরামুল হাসান, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিন, ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, শামীম পারভেজ, এম কফিল উদ্দিন আহম্মেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক, সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন, রংপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকু ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদসহ যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ান-ইলেভেনের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের সাজার রায় বহাল রেখেছেন আদালত।

দলটির নেতাকর্মীরা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় সাজা ঘোষণা অনেকটা বন্ধ আছে। বিগত আড়াই মাসে একটি মামলারও রায় হয়নি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরুত্তাপ থাকায় আদালতপাড়ায়ও মামলা নিয়ে আগের মতো টানাহ্যাঁচড়ার দৃশ্য নেই। নেই রাত পর্যন্ত সাক্ষ্য নেওয়ার ঘটনা। নেই পুলিশের দৌড়ঝাঁপ। অন্যদিকে, মামলার শুনানি নিয়ে বিএনপির আইনজীবীদের গলদঘর্ম অবস্থাও আর আগের মতো নেই।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যেভাবে গণহারে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে আইন ও বিচার বিভাগ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। তড়িঘড়ি করে ওই সব মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাজা দিয়ে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির যে অভিযোগ বিএনপি করেছে, তা সঠিক বলেই প্রমাণ হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এখানে পুলিশ থেকে নিম্ন আদালতের দায় বেশি। বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীন, তা এসব কার্যক্রম থেকে অনুমান করা যায়।

নিম্ন আদালতের আইনজীবী আব্দুস সালাম হিমেল বলেন, দ্বাদশ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় সাজা ঘোষণার হিড়িক পড়েছিল। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পর এবং এখনকার রাজনৈতিক পরিবেশে নেতাকর্মীরা আদালতে হাজির হয়ে ওই সব মামলায় আইনি প্রতিকার নিতে শুরু করেছেন।

অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে নারাজ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, রাজনৈতিক হয়রানির জন্য কোনো মামলা পরিচালনা করা হয় না। বিএনপির অভিযোগ ভিত্তিহীন।

জানা গেছে, সাজাপ্রাপ্ত দলের নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছেন। আরও অনেকে আছেন অপেক্ষায়। আইনি প্রস্তুতির জন্য শেষ সময়ের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিদিন আদালতপাড়ায় আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন, পরামর্শ করছেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করছেন।

বিএনপির সূত্র জানায়, মার্চের শুরু থেকে শুধু সাজাপ্রাপ্ত নয়, বিগত দিনের আন্দোলনে যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। অনেকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় নিম্ন আদালতে হাজির হয়েছেন। তাদের অনেককে আবার কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির অন্তর্গত বেশির ভাগ নেতাকর্মী রমজানের মধ্যেই আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। অনেকে ঈদ শেষে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ৫ মার্চ নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। গত ২৮ ডিসেম্বর আদালত তাঁকে ২১ মাসের কারাদণ্ড দেন। ওই মামলায় তিনি ১০ মার্চ জামিনে মুক্তিলাভ করেন। ১০ মার্চ সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া, ছয় বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ১৯ মার্চ বিএনপির কেন্দ্রীয় তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসান আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠান। ১৮ মার্চ দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল নেতা আতিকুর রহমান উজ্জল আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকেও কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। ২১ মার্চ স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান এবং দপ্তর সম্পাদক (যুগ্ম সম্পাদক পদমর্যাদা) আব্দুল্লাহ আল মামুন আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্যে রাজীবের বিরুদ্ধে চার মামলায় আট বছরের সাজা ঘোষণা হয়েছে গত বছর। মামুনের বিরুদ্ধেও একটি মামলায় দুই বছরের সাজা রয়েছে। ১৪ মার্চ ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি মোস্তফা কামাল হৃদয়, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এ খোকন ও উত্তরা থানার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন আত্মসমর্পণ করেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দুই বছরের সাজা ঘোষণা করেন আদালত।

গত ১৯ মার্চ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য, শেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেলসহ বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের আরও ২২ নেতাকর্মী শেরপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আত্মসমর্পণ করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিনাজপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান মিয়া, চিরিরবন্দর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরে আলম সিদ্দিকী নয়ন, ১৫ মার্চ ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি, সাভার উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া আরও আগে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা জামান, সদস্য জাহাঙ্গীর মোল্লা, আহসান হাবীব মোল্লা, খিলক্ষেত থানা বিএনপির আহ্বায়ক ফজলুল হক ফজলু, যুগ্ম আহ্বায়ক সৈকতুল ইসলাম সৈকত, সিএম আনোয়ার, ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রিন্সিপাল লিয়াকত আলী, দারুস সালাম থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির, উত্তরখান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফ আলম সবুজসহ আরও অনেকের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়।

যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, নির্বাহী কমিটির সদস্য হাবিবুর রশিদ হাবিব, যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হকসহ আরও অনেকে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা আইনের প্রতি সব সময় শ্রদ্ধাশীল। তাদের বিরুদ্ধে সাজানো ও নিয়ন্ত্রিত রায় ঘোষণা হলেও এখন দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা আদালতে যাবেন। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা জামিনে মুক্ত হবেন।
জহির উদ্দিন তুহিন জানান, তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করেছেন। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন। আইনি জটিলতা শেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা আবারও রাজপথ দাপিয়ে বেড়াবে।

samakal