‘কপ-২৬’ কি প্রলয় রুখতে পারবে?

– ফাইল ছবি

মিডিয়ার অভূতপূর্ব বিকাশ ও বিস্তার ঘটায় প্রতি মুহূর্তেই কত বিচিত্র-সচিত্র সব খবর যে, মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এসব তথ্য-উপাত্ত এবং সচিত্র খবর কিছু আনন্দের ও আহ্লাদিত হওয়ার মতো। আর অনেক খবরে অবাক ও বিস্মিত হতে হয়। এমনো খবর পাওয়া যায় যার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করা যায় না বা কিছুই উপলব্ধিতে আসে না। সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশ্বনামক এই গ্রহে বৈচিত্র্যের যেমন কোনো শেষ নেই, তেমনি সচিত্র সব খবরে নানা ধরনের যে সব কথা থাকে, তাও অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। সচিত্র অনেক খবর মানুষকে শোকে মুহ্যমান করে তোলে। যেমন নদীতটে হাজারো পক্ষীকুল একসাথে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করছে। সেই সাথে ছবিতে দেখেছি, খবর পড়েছি সমুদ্রের বেলাভ‚মিতে এসে জলজপ্রাণী পেঙ্গুইন অনেকে মিলে একত্র হয়ে জীবনাবসান ঘটিয়েছে। আবার একান্ত তুচ্ছ ঘটনায় একা বা যুগলবন্দী হয়ে মানুষ আত্মহত্যা করেছে। কী শোক আর বেদনা তাদের এই সিদ্ধান্তে উপনীত করল, তা বাস্তবিকই রহস্য। এমন হাজারো বিচিত্র সব ঘটনা থাকতে পারে যা মানুষের গোচরে নেই, আসলে স্রষ্টার ইচ্ছা বোঝা দুষ্কর। কিন্তু মানুষ কি তার এমন সীমাবদ্ধতার কথা ভাবে?

এখন এক জীবনাবসানের কথা উল্লেখ করব, যা গোটা মানবজাতি, সমুদয় জীবজন্তু মানবসৃষ্ট এক ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে পড়ে মুহূতেই শেষ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, এমন ঘটনাই ঘটতে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। পৃথিবীর ঊষালগ্নে মানুষকে জীবন ধারণে শত প্রতিকূলতার অকল্পনীয় সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। কিন্তু তারপর মানুষ শত বছর পেরিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু কস্মিনকালেও মানবজাতি কখনো ভাবেনি সঙ্ঘবদ্ধভাবে সৃষ্টিকুল নিয়ে তাদের ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার আজ মানুষের জীবন কত সহজ স্বাচ্ছন্দ্যময়। বেঁচে থাকার কত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মানুষ জানতে পারল- তাদের পাপের ভারে, বেঁচে থাকার সব স্বপ্নসাধ অতল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। অথচ মানুষ বরাবর দীর্ঘ জীবনের আকাক্সক্ষা পোষণ করত। ইতোমধ্যে এসব বিষয়ে বিশ্বব্যাপী ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশিত হয়েছে। নয়া দিগন্তে গত ২১ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছিল এক নিবন্ধ তার শিরোনাম ছিল- ‘চক্ষু বন্ধ রাখলেই প্রলয় থামবে না’, জাতিসঙ্ঘের একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে বিশ্ববাসীর প্রতি ছিল এক ভয়ঙ্কর বার্তা। তার আলোকেই সেই নিবন্ধটি রচনা করেছিলাম- এখনকার এ লেখা তারই ‘ফলোআপ’ রচনা। পাঠককে আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেই বার্তায় কী ছিল।
‘জাতিসঙ্ঘ সম্প্রতি মানবজাতির জন্য এক মহাবিপর্যয়ের যে বার্তা দিয়েছে তা গোটা বিশ্বের সচেতন মানুষকে ভীত হকচকিত, হতবুদ্ধি ও সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। সে বার্তার সারমর্ম হচ্ছে দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে ভ‚মিকম্পে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। এসব কারণে সৌন্দর্যমণ্ডিত আমাদের পরম প্রিয় গ্রহটি ধীরে ধীরে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছিল। স্রষ্টা বিশ্বকে যে রূপ সৌন্দর্য দিয়ে বিন্যস্ত করেছেন; বিপথগামী মানুষ স্বয়ং তাকে তছনছ করে দিচ্ছে। মানুষ তার হাতে যা অর্জন করেছে এখন এর ফল তাকে ভোগ করতে হবে। সে ফলই আজ বিশ্বকে মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

যখন জলবায়ু এমন চরম বৈরিতার মুখে, এমন সময় এসবের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বের একদল প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। তারা বলেছেন, সম্প্রতি মানুষের যত অপকর্মে বিশ্বের জলবায়ু এত বেশি পরিবর্তিত হয়েছে- এর প্রভাব মানবজাতিকে ভয়াবহ পর্যায়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণতা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে চূড়ান্ত বিপদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে মানবসভ্যতা।

শিল্পোন্নত দেশগুলোর কলকারখানা থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, সেটিই এই গ্রহের উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। এর ফলে সমুদ্রবক্ষের পানির উচ্চতা একপর্যায়ে এতটা বৃদ্ধি পাবে যে, তখন সৌন্দর্যে ভরা আমাদের পরম প্রিয় গ্রহটি ধীরে ধীরে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। একদল বিজ্ঞানী এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি রচনা করেছেন। তারা সেই প্রতিবেদনকে মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা বলে মনে করেন। বিরল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী গ্রহটিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমাতে হবে, তাতে এক দিনও বিলম্ব করা যাবে না। না হলে পৃথিবী নামক গ্রহটি তার সাত শতাধিক কোটি মানবসন্তান, হাজারো ধরনের প্রাণিকুল পাখপাখালি বন-বনানী সব জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।

বিশ্ব ১৮৫০ বছরে যে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে, সেটির দায় যাদের সবচেয়ে বেশি নিতে হবে তারা এখনো কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে স্পষ্ট রূপরেখা দেয়নি। বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিবেশবিদদের বারবার হুঁশিয়ারি সত্তে¡ও কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে দায়ী উন্নত দেশগুলো এখনো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা কার্বন নিঃসরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারসহ নানা কারণে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এ জন্য দায়ী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ক্রমানুসারে- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, ভারত, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কানাডা। এসব দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি, বন উজাড়, ভ‚মিক্ষয়, সিমেন্ট উৎপাদনসহ নানা কারণে কার্বন নিঃসরণ করছে। অথচ কার্বন নিঃসরণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ১০ দেশের মধ্যে ছয়টি দেশ অর্থাৎ, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও জাপান এখনো কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো কার্যক্রম ঘোষণা করতে পারেনি। বাকি চারটি দেশ পরিবেশ রক্ষায় যেসব অঙ্গীকার করেছে তাতে কার্বন নিঃসরণ খুব একটা কমানো যাবে না।

বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রভাব সর্বত্রই পড়েছে। গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরা, দূষণ সর্বোপরি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বে ১৪ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেছে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের জেরে যে তাপ শোষণ করে সাগরের পানি, দীর্ঘ দিন এভাবে তাপ শোষণ করতে থাকায় সাগরতলে থাকা জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সাগরে বিরান ভ‚মিতে পরিণত হচ্ছে ঝলমলে প্রবাল প্রাচীর।

পৃথিবীর এই করুণ দশার পেছনে বহু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধানত পাঁচটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেগুলোকেই বড় হুমকি বা শত্রু মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তারা এও বলেছেন, সবাই মিলে এই পাঁচ শত্রুকে ধ্বংস করতে পারলে বাঁচতে পারে পৃথিবী। চলতি সপ্তাহেই চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন ‘কপ-২৬’ এর প্রথম ধাপের বৈঠক। বিশ্বের প্রকৃতি জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস এড়ানোর জন্য নানা কৌশল ও নীতি নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকটির সামনে ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্লাটফর্ম অন বায়োডাইভার্র্সিটি অ্যান্ড ইকো-সিস্টেম সার্ভিসেস প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাঁচ প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হবে। কারণগুলো হচ্ছে- ভূমি ও সমুদ্রে বিরূপ পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, ভিন প্রজাতির আগ্রাসন। বিশ্লেষকরা বলেছেন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সফল হতে হলে বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের এই পাঁচ কারণ মোকাবেলা করতেই হবে। বন্যপ্রাণী শিকার, মাছ ধরা, গাছ কাটা থেকে শুরু করে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক যথেচ্ছ ব্যবহারে বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে।

লাগামছাড়া শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, কৃষিক্ষেত্রে যথেচ্ছ রাসায়নিক সার প্রয়োগ, বনাঞ্চলের সঙ্কোচন, যত্রতত্র দূষিত বর্জ্য নিক্ষেপ করা প্রভৃতির ফলে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। দূষিত পরিবেশ কেবল বায়ুদূষণ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ। জলবায়ু পরিবর্তন যথাযথভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব না হলে বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবে ৪২টি ছোট দেশ। কমনওয়েলথের মহাসচিব ব্যাবোনল প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ডে বলেছেন, দেশগুলোকে বাঁচাতে জাতিসঙ্ঘের আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সাক্ষাৎকারে কমনওয়েলথ মহাসচিব বলেছেন, প্রশান্ত সাগরীয় ছোট ছোট দ্বীপদেশের মানুষ অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবছে। শত শত বছর ধরে পরিচিত সব জনপদ তাদের ছাড়তে হতে পারে।

এ দিকে সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, গত দুই শত বছরে একের পর জায়গা বদল করেছে ‘কার্বন ভরকেন্দ্র’। শুরুটা হয় ব্রিটেনে; আস্তে আস্তে ঘাঁটি গাড়ে যুক্তরাষ্ট্রে। অবশেষে সরে এখন স্থায়ী হয়েছে চীনে। অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণে এই মুহূর্তে বিশ্বের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এশিয়ার দেশটি। জলবায়ু নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের বিশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ব্যাপক শিল্পায়নের কারণেই তা হয়েছে।

এ দিকে, চীনের পক্ষে এই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে- ‘তারা কার্বন নিঃসরণ যথাশিগগিরই সম্ভব কমিয়ে আনবে।’ অথচ ২০২১ সালে ধনী দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়েছে। চীনের সাথে রাশিয়ার কার্বন নিঃসরণের যাত্রা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। অতি স¤প্রতি প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ‘রাশিয়া কার্বনমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।’ এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে কি না সেটিই দেখার বিষয়।

এই ক’টি দেশ এই গ্রহকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে চলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, তাদের মধ্যে এতটুকু মনুষ্যত্ববোধ কি আজ আর বজায় নেই? সেসব দেশ প্রধানত এমন ভয়ঙ্কর অবস্থান নিতে কিভাবে সাহসী হলো? যে দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই স্রষ্টায় বিশ্বাসী। তাদের কাছে তো ঐশীগ্রন্থ এসেছে। তার শিক্ষার প্রতি কি এতটুকু সম্মান দেখানোর সব বিবেচনা নীতিনৈতিকতা তারা জলাঞ্জলি দিয়েছে? ধর্মীয় তো বটেই, তার পরও সার্বজনীন মূল্যবোধ হচ্ছে- বিশ্বের একটি নির্দোষ মানুষকে হত্যা করার অর্থ, গোটা মানবজাতির প্রতি মারাত্মক অপরাধের সমতুল্য। অথচ সে আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে গোটা মানবজাতি ও সৃষ্টিকুলকে শেষ করে দেয়ার। বিশ্বাসী মানুষের এই বিশ্বাস তো দৃঢ় হওয়ার কথা যে, এই জীবনই শেষ কথা নয়। তারপর রয়েছে অনন্ত এক জীবন। সে জীবনে সবাইকে এ জগতের সব কৃতকর্মের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের সম্মুখীন হতে হবে। স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি এই গ্রহ আর এর মানুষ ও প্রাণিকুলের প্রতি রয়েছে তার অপরিসীম দয়া, করুণা আর ভালোবাসা। এই বিশ্ব ও স্রষ্টার সব প্রিয়পাত্রদের ধ্বংস করার পরিণতি নিয়ে একবারও তারা ভাবছেন না। পৃথিবীতে বিদ্রোহী সত্তার প্রতি কী অকরুণ হয়ে ওঠে মানুষ। আর স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে তার যত্নের সৃষ্টিকে সংহার করার কারণে কী রোষ তাঁর জন্মাবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা নিয়ে একবারও ভাবেন না!

এই মহাবিপদের প্রেক্ষাপটে আগামী ১ থেকে ১২ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তার আগে বিশ্বের বিপর্যয়কর আসন্ন বিপদ সম্পর্কে যেসব সায়েন্টিফিক পেপার তথা প্রতিবেদন রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে সে সম্মেলনে সেসব প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। এখন বিশ্ববাসী সেই সম্মেলনের দিকে বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। সত্যিকার অর্থে, সেই সম্মেলন থেকে বিশ্ব বিলুপ্তি রোধের ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর কোনো কর্মসূচি ও পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয় কি না সেটি দেখার বিষয়। এ বিশ্বের যে দুই শতাধিক রাষ্ট্র রয়েছে আজকের সঙ্কট যে উষ্ণায়ন সেই ২০০ রাষ্ট্রের প্রায় কেউই এই অপরাধ তথা উষ্ণায়নের জন্য এতটুকু দায়ী নয়। তার পরও এখন অপরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে অর্থাৎ মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের।

‘কপ-২৬’ সম্পর্কে আসি। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোর পরিবেশ সম্মেলন দিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়। তারপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। এর পর প্রতি বছর নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই পরিবেশ সম্মেলন। কপ-২৬ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে। কোভিড মহামারীর কারণে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছিল। সে কপ সম্মেলনটি এখন হতে চলেছে। এ দিকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়লে ১ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার ভ‚মি পানির নিচে তলিয়ে যাবে যার মধ্যে একটা অংশ থাকবে বাংলাদেশের। সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। সে এলাকার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হবে। আসন্ন কপ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী আলোক শর্মার প্রচেষ্টা অনেকটা আশাব্যঞ্জক। কপ-২৬ সম্মেলনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তিনি। সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য কোভিডকালেও তিনি অনেকগুলো দেশ ভ্রমণ করেন। এ সময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের সাথে তিনি আলোচনা করেন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সম্মেলনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রæতি পূরণের দিক নিয়ে কতদূর অগ্রসর হওয়া গেছে, তা নিয়েও আলোচনা হবে। তবে সে আলোচনায় সবাই হতাশ হবেন, সন্দেহ নেই। কেননা, কপ-২১-এর লক্ষ্যে পৌঁছা তো দূরের কথা গোটা বিশ্বের পরিবেশ ও উষ্ণায়নের অনেক অবনতি ঘটেছে সেই সম্মেলনের পর থেকে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বহু এলাকা ডুবে যাবে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি, উষ্ণতা, জলোচ্ছ্বাস দেশের উপকূলীয় এলাকায় এখন খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের বসবাসের এই এলাকাগুলোতে। আর ওই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন হতে থাকবে। তাই উপকূলের মানুষের সুরক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এবারের সম্মেলনে তা নিয়ে জোরালো আলোচনা হবে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ভয়াবহতা ও বাস্তবতাকে সামনে রেখে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশের ন্যায্য অবস্থান গ্রহণে যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। দুর্যোগের সময় ও পরবর্তীকালে সেবা অব্যাহত রাখা, দুর্যোগে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় উপকরণের বিষয় নিশ্চিত করতে বিনিয়োগসহ যুগোপযোগী নীতিনির্ধারণে উদ্যোগ একান্ত জরুরি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দশকের শেষের দিকে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হবে। এখনকার চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা করছেন তারা। সুতরাং কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ুর ক্ষতি প্রশমন, পুনর্বাসন তহবিল নিশ্চিত করা ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বৈশ্বিক পরিবেশ বসবাস উপযোগী হিসেবে ধরে রাখার জন্য আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে শেষ হবে বলে আশা করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানুষ।

বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি কথা বলা প্রয়োজন, এই দেশ যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সে সম্পর্কে সরকারি কর্তৃপক্ষ কতটা সচেতন এবং দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্কট নিয়ে তাদের চিন্তা, পরিকল্পনা আর প্রকল্প নিয়ে তারা কী ভাবছে। তা কোনো কর্মকাণ্ড থেকেই বোঝার উপায় নেই। যদি হাত-পা ছেড়ে বসে থাকা হয়, দেশ রক্ষার চেয়ে ক্ষমতা রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় তবে এমন দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকা হয় এবং এমনটা ভাবা হয় যে, অন্যরা আমাদের রক্ষা করবে।

কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে যাচ্ছে যখন কেউ কারো দিকে ফিরে তাকানোর কোনো অবকাশ বা দায় থাকবে না। এই লেখা শেষ করতে চাই জাতিসঙ্ঘের সেই বক্তব্য দিয়ে, এই গ্রহটিকে ধ্বংস করে দেয়ার আগে এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির মৃত্যুঘণ্টা বাজানো উচিত। আমরা যদি সব শক্তি এক করতে পারি, তাহলে হয়তো জলবায়ু বিপর্যয় রোধে এগিয়ে যেতে পারব। উল্লেখ্য, কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের কারণেই উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বরফ গলছে, আবহাওয়া চরম বৈরী হয়ে উঠছে।
[email protected]