কঠোর অবস্থান থেকে যেভাবে সরে আসে আন্দোলনকারীরা

কঠোর অবস্থান থেকে যেভাবে সরে আসে আন্দোলনকারীরা

বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র আপত্তির কারণেই ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের কর্মসূচি থেকে সরে আসতে হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে। এ ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনকেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। শেষপর্যন্ত গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে মান রক্ষা করতে হয়েছে তাদের।

তবে বহুল আলোচিত এ সমাবেশ থেকে সরকারকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র প্রকাশের আলটিমেটাম দিয়ে আপাতত ‘নিরাপদ’ অবস্থানে চলে গেছেন ছাত্রনেতারা। সরকারের হস্তক্ষেপে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মঙ্গলবার ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। গত রোববার ঘোষিত এই কর্মসূচি অনুযায়ী কয়েক লাখ ছাত্র-জনতার জমায়েত ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান হিসেবে তুলে ধরে তার ‘কবর’ রচনা করার ঘোষণা দেন নেতারা। একই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করার কথাও ছিল। এরপর থেকেই এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি দেশজুড়ে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে।

সূত্রমতে, কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানানো হয়।

প্রকাশ্য সভা-সমাবেশেই বিএনপির নেতারা সংবিধান বাতিল কিংবা কবর দেওয়ার সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। গণঅভ্যুত্থানের সমর্থক কয়েকটি বাম দলের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তৃতা-বিবৃতিতেও এমন প্রতিবাদ আসে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো এ নিয়ে অনেকটাই নীরব ছিল। এসব দলের কেউ কেউ ছাত্রদের কমর্সূচির প্রতি মৌন সমর্থন দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

এই অবস্থায় কর্মসূচি ঘোষণাকারী সমন্বয়ক ও ছাত্রনেতারা তাদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন আদায়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের যোগাযোগ করেন। কিন্তু বিএনপি নেতারা তাদের নেতিবাচক জবাব দেন। গত রোববার রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেন। এরপর রাতেই সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রেস ব্রিফিং করে সাফ জানিয়ে দেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’র সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। এতে আরও হতোদ্যম হয়ে পড়লেও যে কোনো মূল্যে কর্মসূচি পালনের বিষয়ে তৎপর ছিলেন ছাত্রনেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হঠাৎ ঘোষিত কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশজুড়ে নানা সন্দেহ-অবিশ্বাস ও জল্পনাকল্পনা শুরু হয়।

এ নিয়ে টানাপোড়েনের মুখে সোমবার দিনভর ছাত্রনেতারা গণঅভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্তরে দৌড়ঝাঁপও করেন। তবে সব মহল থেকে এই মুহূর্তে সংবিধান বাতিলসহ ছাত্রনেতাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে, সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সভাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে নিজেদের ‘অনড় অবস্থান’ তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। অন্য দলও একই মনোভাব দেখালে সোমবার রাতে আরেকটি প্রেস ব্রিফিং থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র সরকারই ঘোষণা করবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ‘সেফ এক্সিট’ দিতেই সরকারের পক্ষ থেকে ওই ঘোষণা দেওয়া হয় বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য ছাত্রনেতারা পর্দার অন্তরালে সব পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যান বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে, এরই মধ্যে সারাদেশ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়া ছাত্র-জনতার মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দেয়। বেশির ভাগ জেলা-উপজেলার সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা চাইতে থাকেন। এ অবস্থায় ছাত্রনেতারা তাদের কর্মসূচি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সোমবার রাতে রাজধানীর বাংলামটরের নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। টানা তিন ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক করার পর রাত দেড়টার দিকে সংবাদ সম্মেলন থেকে ছাত্রনেতারা জানান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত করবেন তারা। তবে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সোমবার রাতের জরুরি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির নেতাদের মধ্যেই কর্মসূচি নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। এক পক্ষ মঙ্গলবারের সমাবেশ থেকেই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবিতে অনড় থাকলেও অন্যপক্ষ সরকার ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের জাতীয় ঐক্যের কথা ভেবে কর্মসূচি পালন করা ঠিক হবে না বলে মতামত জানায়। কর্মসূচি দেওয়া হবে কিনা এ বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। প্রথমে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যালয়ে বসেন, তাতে মোটামুটি সিদ্ধান্ত হয় কোনো অনুষ্ঠানই হবে না। পরে আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ বৈষম্যবিরোধী নেতারা নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে যান। তারা সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের চাপের মুখে ছাত্রনেতারা শুধু সমাবেশের কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। সেখানেই ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি ঠিক হয়।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বেশ কয়েকজন নেতা সমকালকে জানান, সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের বৈঠকে স্পষ্টত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন ছাত্রনেতারা। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে ঘোষণাপত্র না দেওয়ার জন্য যেমন চাপ ছিল, তেমনি সংগঠনের একটি পক্ষও যে কোনো মূল্যে কর্মসূচি বাস্তবায়নে চাপ সৃষ্টি করছিল। এই চাপ সামলানো নিয়েও নিজেদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বেগ পেতে হয় তাদের। দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে তাদের এই কর্মসূচি পিছিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না বলেও জানান এসব নেতা।

এদিকে বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, সোমবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের শুরুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ছাত্রনেতাদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎসহ ছাত্রনেতাদের আলোচনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।

এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, ছেলেরা অনেক অবেগপ্রবণ। সবকিছু মিলে তারুণ্যের একটা আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। আমরা মনে করি, তারা তাদের আবেগ থেকেই বলেছে। এটাকে (বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি) এ মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। ভবিষ্যতে যদি কখনও সুযোগ আসে, সময় আসে, তখন জাতির চিন্তা করে দেখা উচিত বলে মনে করি।

samakal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here