কক্সবাজারের মেগা প্রকল্পে হেলালের মেগা লুট

কক্সবাজারের মেগা প্রকল্পে হেলালের মেগা লুট

কক্সবাজারে ৩ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি মেগা প্রকল্পের জন্য প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণের নামে হাজার কোটি টাকা নয়ছয়সহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বিগত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আমলা হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে তিন প্রকল্প থেকে ৮০ কোটি টাকা লোপাট, জালিয়াতি করে রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট প্রদান, ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার করা, পিবিআইর প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে।

হেলালের বাড়ি কক্সবাজারে। সেখান থেকে জাতীয় নির্বাচন করারও প্রস্তুতি নেন তিনি। তাই সাবেক এই সচিব স্থানীয় ডিসি, এডিসি, এসপি ও মেয়রের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতির হাট বসিয়েছিলেন কক্সবাজার সদরের ঈদগাহ এলাকায়। দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন সেই সময় তাঁর ৬২০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে এই দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছিলেন। তবু হেলালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন সরকার। উল্টো হেলালুদ্দীন ও তাঁর চক্রের সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে চাকরিচ্যুত করে শরীফ উদ্দিনকে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার আসামি হয়ে এখন তিনি রিমান্ডে রয়েছেন। ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন সেই সময়কার স্থানীয় সরকারের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। ওই দিন প্রায় ৮ কোটি টাকার চেক সাকিট হাউসে বসে তাঁর সিন্ডিকেটে থাকা পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানকে প্রদান করেন তিনি। ওই ৮ কোটি টাকার একটি অংশ মেয়রের কাছ থেকে তাঁর স্ত্রীর নামে ঘুষ নেন বলে অভিযোগ পান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। তাঁর নির্দেশে দুদক কর্তৃক নো ডেবিটকৃত ৮ কোটি টাকা কক্সবাজার শাখার ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে দুদকের চিঠি ছাড়াই প্রদান করেন তিনি।

হেলালের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে এল এ শাখায় ফাইল লিপিবদ্ধ করত দালাল চক্র। সাবেক এই সিনিয়র সচিবের লিখিত সুপারিশে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ভুয়া এনআইডি কার্ড সৃজন করে টাকা উত্তোলনের একটি অভিযোগ দুদক কক্সবাজার কার্যালয় তদন্ত করলেও তাঁর চাপে উল্টো রিপোর্ট দেওয়া হয়। এ ছাড়া হেলালের ভাইয়েরা রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। ৫৫ হাজার ৩১০ জন অবৈধ ভোটার হওয়ার ঘটনায় নাম আসে তাদের।

এ মামলায় নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন। তারা সবাই আসামি হওয়ায় শরীফের ওপর চটে যান তৎকালীন এই ইসি সচিব। এটির প্রমাণ না রাখতে বিভিআরএস নিবন্ধনকৃত ল্যাপটপ ধ্বংস না করে কিংবা সফটওয়্যার আনইনস্টল না করেই হেলালের ইশারায় ২০১৮ সালে অবৈধভাবে নিলামে তোলা হয়। এসব ল্যাপটপের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার করা হয়েছিল।
দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বলেন, আমাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য হেলালুদ্দীন আহমদ দু’বার সশরীরে ঢাকা দুদক অফিসে যান। তৎকালীন কমিশনার মোজাম্মেল হককে প্রভাবিত করে আমাকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অপসারণ করা হয়। কক্সবাজারের মেগা প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা ভাগাভাগি হওয়ার গোমর ফাঁস করে দেওয়ায় আমার ওপর রুষ্ট হন। দুদককে দিয়ে তাই আমাকে শায়েস্তা করেন। আশা করছি, উচ্চ আদালতে এবার ন্যায়বিচার পেয়ে চাকরি ফিরে পাব। কারাগারে থাকায় এ ব্যাপারে হেলালুদ্দীনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত বুধবার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

মিলেমিশে দুর্নীতি করতেন হেলাল 
ক্ষমতার দাপটে ধামাচাপা পড়েছে কক্সবাজারে ৮০ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত। এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে এর সঙ্গে যুক্ত হোতারা। তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগই রাঘববোয়াল। এদের মধ্যে পৌর মেয়রসহ রাজনীতিবিদ রয়েছেন সাতজন, চেয়ারম্যান দু’জন, জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ২০ জন, পুলিশ সুপারসহ পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা চারজন, সার্ভেয়ার রয়েছেন ২৩ জন, কানুনগো সাতজন, তহশিলদার ছয়জন, সাব-রেজিস্ট্রার দু’জন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছয়জন ও ব্যাংকের ম্যানেজার রয়েছেন তিনজন। প্রভাবশালী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছিলেন চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন।

২৯ কোটি টাকার দুর্নীতিতে যাদের নাম
এসপিএম প্রকল্পে ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্ত হিসেবে এখানে প্রভাবশালী যাদের নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা হলেন– সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম সরোয়ার কামাল, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, সাবেক সার্ভেয়ার সাঈদ হোসাইন, সাবেক সার্ভেয়ার কবির আহমদ, সাবেক কানুনগো আবদুল খালেক, সাবেক অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম, নুর মোহাম্মদ, দিল মোহাম্মদ, ছৈয়দ আহাম্মদ, মোহাম্মদ আবদুস শুক্কুর, আবদুল মজিদ, মো. রিদুয়ান, নুরুন্নাহার, সার্ভেয়ার ওয়াসিম খান, সার্ভেয়ার ফরিদ উদ্দিন, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রেজাউল করিম, কানুনগো মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ কুতুবী, সাবেক সার্ভেয়ার আসাদুজ্জামান, সাবেক সার্ভেয়ার আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ।

৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতিতে যারা
কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে অভিযুক্ত করা হয় সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এইচ এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ নূর হোসেন, নাজিম উদ্দিন, কক্সবাজারের তৎকালীন পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, সার্ভেয়ার ফরিদ উদ্দিন, সাবেক কানুনগো বাচ্চু মনি চাকমা, সাবেক ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাশেদুল ইসলাম, কানুনগো বসন্ত কুমার চাকমা প্রমুখ।

পিবিআই প্রকল্প ঘিরে ১৫ কোটি টাকার দুর্নীতি
ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে পিবিআই প্রকল্প ঘিরেও হয়েছে দুর্নীতি। ১৫ কোটি টাকার এ দুর্নীতিতে যাদের নাম এসেছে দুদকের প্রতিবেদনে তারা হলেন– সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক এম সাকের আহমেদ, সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এইচ এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. শহিদুল হক, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ-আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা দেবতোষ চক্রবর্তী, সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার মাজেদা বেগম, সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।

নামে-বেনামে সম্পদ
কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ করেছেন হেলালুদ্দীন আহমদ। চট্টগ্রামস্থ হিলভিউ আবাসিক এলাকায় ১ নম্বর রোডে ৫ কাঠা জায়গার ওপর সাত তলা বাড়ি রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া উত্তর খুলশীতে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। কক্সবাজারে সরকারি আবাসনে সম্পত্তি রয়েছে। কক্সবাজারের ঈদগাঁতে তাঁর জায়গা রয়েছে। কম দামে কেনা সে জায়গা অধিগ্রহণ করিয়ে অনেক টাকার মালিক হন তিনি। স্থানীয়রা এটার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে তখন মানববন্ধনও করেছে।

অনিয়ম করেছেন চাকরিতেও
চাকরি করার সময়ও নীতিনৈতিকতার ধার ধারেননি হেলালুদ্দীন। অবসরে যাওয়ার আগের দিনেও বিদেশে প্রশিক্ষণে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের শেষ কর্মদিবস ছিল ২০২২ সালের ২২ মে। সেদিন তিনি চলে যান অবসরোত্তর ছুটিতে। অথচ এর ঠিক আগের দিন নেদারল্যান্ডস ও স্পেনে শিক্ষা সফর শেষে দেশে ফেরেন তিনি। একজন আমলার অবসরের আগ মুহূর্তে যাওয়া এ শিক্ষা সফর সরকারের কী কাজে আসবে, তা নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, হেলালুদ্দীন আহমদের এ সফর অনৈতিক ছিল। তাঁর তো শিক্ষা সফরের দরকার নেই। এটা নতুন কর্মকর্তাদের জন্য প্রয়োজন, যাতে তারা সেই শিক্ষা নিয়ে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারেন।

যা বললেন বিশিষ্টজন
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এক আমলা ছিলেন হেলালুদ্দীন। তাঁর দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আশা করছি, এখন সেই সব অভিযোগেরও তদন্ত হবে।
শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, মন্ত্রণালয়ে যারা বড় দায়িত্ব পালন করেন, তাদের কাছে অনেক প্রলোভন আসে। এগুলোর লোভ সবাই ত্যাগ করতে পারে না। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন করা উচিত। নীতিনৈতিকতার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। এখন দেখা যাচ্ছে বড় আমলারা নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এজন্য সখ্য গড়ে তুলছেন। অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করছেন। এগুলো পরিহার করা উচিত। হেলালুদ্দীনের পরিণতি থেকে অন্যদেরও শিক্ষা নেওয়া উচিত।

samakal