স্টাফ রিপোর্টার
৯ মার্চ ২০২৫, রবিবার
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক জন এফ. ড্যানিলোভিচ বলেছেন, বাংলাদেশে এক-এগারোর সময় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ভূমিকায় বিরাট ভুল ছিল। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে মনোযোগ দেয়নি। শনিবার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বিশেষ আলোচনা সভায় তিনি এই কথা বলেন। ‘মাইলাম ও জন-এর সঙ্গে সংলাপ’- শীর্ষক অনুষ্ঠানে গণ-আন্দোলনের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের বর্তমান গতিশীলতা নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান সঞ্চালনা করেন। আলোচক হিসেবে ছিলেন- সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলাম এবং সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ. ড্যানিলোভিচ। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন বিদেশি মিশনের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, আন্তর্জাতিক, উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সমাজের সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্র নেন।
গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরে ড্যানিলোভিচ বলেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি ধারাবাহিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো- শাসক দলের জবাবদিহিতার অভাব। গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে হলে একটি শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক অপরিহার্য। স্বৈরাচারী শাসন কখনোই গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তথ্যযুদ্ধের সম্মুখীন এবং মার্কিন সরকার মিডিয়াভিত্তিক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য মোকাবিলার জন্য কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন তহবিল সম্পর্কে দেয়া বিবৃতিও বিভ্রান্তিকর, যা মূলত কিছু ব্যক্তি দ্বারা প্রচারিত, যারা দুই দেশের সম্পর্ক অস্থিতিশীল করতে চায়। সেন্টমার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কিত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য নিছক মিথ্যা প্রচারণা, যা কিছু গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়াচ্ছে। সাবেক সরকার বিদেশি দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, যাতে তারা নিজেদের দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করতে পারে।
ড্যানিলোভিচ আরও বলেন, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। ‘স্বৈরাচারী শাসন কখনোই মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে নয়। তিনি ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কিছু ভুলের কথা স্বীকার করেন। বলেন, আমি প্রথম স্বীকার করছি ২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিরাট ভুল করেছিল। তবে রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস কিংবা আমার সহকর্মীরা এক-এগারো ঘটাননি। আমি মনে করি না, কোনো গোপন ‘কফি গ্রুপ’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাংলাদেশের জনগণকে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। ’৯০ সালে গণতন্ত্রের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেছিল। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে হলে মৌলিক সংস্কার দরকার। তখন জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারদের মতকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণ কী চায়, তাকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। আমরা নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু আমরা সেনাবাহিনীর কথাই বেশি শুনেছি। সম্ভবত সে কারণেই গণতন্ত্রের উত্তরণ নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি।
জন ড্যানিলোভিচ বলেন, আমাদের দ্বিতীয় ভুলটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র দেশ হিসেবে এবং ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস হিসেবে আমরাও নির্বাচনের সময়সীমার ওপরই বেশি জোর দিয়েছিলাম। নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের দীর্ঘ সময়ের রায় ছাড়া কোনো সরকার পরিচালিত হতে পারে না। আর নির্বাচিত সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত। ওই সময় মৌলিক কিছু সংস্কার সাধনের প্রয়োজন ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের এজেন্ডাও এগিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু একটা সময়ে এসে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নির্বাচনের আয়োজন করে দায়িত্ব হস্তান্তরই তাদের প্রধান অগ্রাধিকার। এরপরেই তখনকার সরকার রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে তাদের সব ধরনের প্রভাব হারিয়ে ফেলল। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়াটা হয়েছিল গোপনে। তাই আমাদের জানা সম্ভব ছিল না সাবেক প্রধানমন্ত্রী কোন শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আপসরফা করেছিলেন। আমরা এর কোনো পক্ষ ছিলাম না। তখন আমাদের ধারণা হয়েছিল যে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছিল এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবেন।
এই কূটনীতিক বলেন, ইতিহাস ভুল প্রমাণ করল। আমাদের যেটা বলা হয়েছিল তার ভিত্তিতে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। আমরা দেখলাম ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অধোগতি ঘটতে থাকল, যার চূড়ান্ত রূপ দেখলাম ২০২৪ সালের নির্বাচনে।
রাষ্ট্রদূত মাইলাম বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমেরিকান জনগণকে সচেতন করার জন্য তার সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা একটি ছোট সংগঠন গঠন করি এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমেরিকান জনগণকে সচেতন করার জন্য কাজ করি। গত পাঁচ বছরে আমরা অর্থায়নের ব্যবস্থা করেছি এবং এই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ তার সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে আসতে পেরে আমি আনন্দিত, বিশেষ করে গত দশ বছরে আমি বাংলাদেশ সফর করতে পারিনি, ভিসার জন্যে।
মাইলাম বলেন, নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা ছিল তার জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। আমি যে তথ্য আমার সরকারের কাছে পৌঁছে দেবো, তা সঠিকভাবে সংগ্রহ করাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ। সেই সময় সরকার আমাকে তাদের পক্ষ নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল।
সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান সুশাসন উন্নয়নকে উৎসাহিত করে এমন উদ্যোগগুলোর গুরুত্বপূর্র্ণ বলে ব্যক্ত করেন এবং উল্লেখ করেন যে, এই ধরনের আলোচনা বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক রূপান্তরকে পরিচালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে সমর্থন ও একটি টেকসই এবং জবাবদিহিমূলক শাসন কাঠামো নিশ্চিত করতে ধারাবাহিক সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। আলোচনায় উভয় বক্তাই গণতন্ত্রে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা বলেন, মিডিয়ার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না, এবং গণতান্ত্রিক আলোচনাকে শক্তিশালী করতে নাগরিক সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা উচিত।