তিন দশক আগে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ওভেন পোশাকের হিস্যা ছিল ৮২ শতাংশ, আর বাকিটা নিট পোশাকের। সময়ের ব্যবধানে নিটের হিস্যা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। ২০০৭ সাল থেকে পরের পাঁচ বছর পোশাক রপ্তানিতে ওভেনের চেয়ে নিট পোশাকের হিস্যা সামান্য বেশি ছিল। তারপর আবার রাজত্বটা চলে যায় ওভেন পোশাকের কাছে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। টানা চার বছর ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে নিট পোশাক। প্রতি বছর ওভেন ও নিট পোশাক রপ্তানির ব্যবধানও বাড়ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত বছর মোট ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ওভেন পোশাকের হিস্যা ৪৪ শতাংশ, আর নিট পোশাকের অংশ ৫৬ শতাংশ। শুধু তা–ই নয়, গত বছর ওভেন পোশাকের রপ্তানি কমেছে দশমিক ৮১ শতাংশ। অন্যদিকে নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ।
নিট পোশাকের মধ্যে রয়েছে টি-শার্ট, পোলো, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস ইত্যাদি। আর ওভেন পোশাকের মধ্যে আছে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম জিনস ইত্যাদি।
পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, ফ্যাশন প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হয়। করোনা মহামারির মধ্যে সেই পরিবর্তনটা দ্রুত হয়েছে। ক্যাজুয়াল পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। উন্নত বিশ্বে এখন টি-শার্ট পরে অনেকে অফিস করেন। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। সে জন্য ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবেই বিশ্বব্যাপী নিট পোশাকের চাহিদা বেড়ে চলেছে।
উদ্যোক্তারা আরও বলেন, একসময় তৈরি পোশাক উৎপাদন ও জাহাজীকরণের জন্য ৯০-১২০ দিন লিড টাইম দিত বিদেশি ক্রেতারা। এখন ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে অনেক ক্রয়াদেশের লিড টাইম থাকে মাত্র ৩০-৬০ দিন। নিট পোশাক উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সুতা ও কাপড়ের সরবরাহকারী দেশ থাকায় কম লিড টাইমে ক্রয়াদেশ নিতে পারে কারখানাগুলো। ফলে নিট পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে। আর দেশীয় সুতা ও কাপড় ব্যবহার করায় ওভেনের তুলনায় নিট পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বেশি হয়। ফলে সামগ্রিক পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের মূল্য সংযোজন বাড়ছে।
ইপিবির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানায়, ১৯৯৫ সালে নিট পোশাকের রপ্তানি ছিল ৫১ কোটি মার্কিন ডলার। ২৯ বছরের ব্যবধানে সেই রপ্তানি ৫২ গুণ বেড়েছে। গত বছর ২ হাজার ৬৫৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ১৯৮ কোটি ডলার। গত বছর পর্যন্ত ওভেন পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ১০ গুণ। রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৩ কোটি ডলারে, যা ২০২২ সালের তুলনায় দশমিক ৮১ শতাংশ কম।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফাস্ট ফ্যাশনে ঝুঁকেছে। তারা কম সময়ে পণ্য চায়। এতে তাদের ব্যবসায়িক ঝুঁকি কমে। অধিকাংশ নিট কাপড় আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়। ফলে দুই মাসের কম সময়ে নিট পোশাক দরকার হলে ক্রেতারা বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ দিতে পারে। যদিও ওভেন পোশাকে আমরা সেটি পারছি না। চীন থেকে কাপড় আমদানি করতেই গড়ে ২৫ দিন লেগে যায়।’
ফজলুল হক বলেন, পোশাক রপ্তানিতে নিটের হিস্যা বেড়ে যাওয়াটা ইতিবাচক। এতে আমাদের মূল্য সংযোজন বেড়েছে। তুলা থেকে সুতা ও কাপড় এবং তারপর পোশাক উৎপাদন হবে—এভাবেই বাংলাদেশে নিট পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছে। আর নিট পোশাকের সংযোগশিল্প খুবই শক্তিশালী।’ তিনি আরও বলেন, ওভেন পোশাকের সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগ করা দরকার। তাহলে ওভেন পোশাকেও ভালো করবে বাংলাদেশ।
তৈরি পোশাক খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১৬২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন হয় ৭১ শতাংশ। তিন বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৮১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তখন মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ছিল ৬৫ শতাংশ। তার মানে সময়ের ব্যবধানে তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে মূল্য সংযোজন বাড়ছে।
বাংলাদেশের নিট পোশাকের বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত বছর নিট পোশাক রপ্তানির ৫৫ শতাংশের গন্তব্য ছিল ইইউ। এ ছাড়া নিট পোশাক রপ্তানির ১১ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে, ১২ শতাংশ যুক্তরাজ্য এবং ১৯ শতাংশ নতুন বাজারগুলোতে হয়। অন্যদিকে গত বছর ওভেন পোশাকের ৪১ শতাংশ ইইউতে, ২৫ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে, ১০ শতাংশ যুক্তরাজ্যে এবং ১৯ শতাংশ নতুন বাজারে রপ্তানি হয়।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে নিট পোশাকের ব্যবহার বাড়ছে। সে কারণে চাহিদা বাড়ছে। ফলে আমাদের নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে আমরা নিটের পাশাপাশি ওভেন ও সব বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে কাজ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ডেনিমে মূল্য সংযোজন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে। তাতে নিটের পাশাপাশি ওভেন পোশাক রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’
Prothom alo