ওপারে গোলাগুলি, এপারে উৎকণ্ঠায় স্বজন

ওপারে গোলাগুলি, এপারে  উৎকণ্ঠায় স্বজনছবি: ইরাবতী

কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৫-তে ২০১৭ সাল থেকে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন আবুল বাছের। জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন তিনি। সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ আশ্রয় নেন বাংলাদেশে। তবে এখনও তাঁর অনেক আত্মীয়স্বজন মিয়ানমারে অবস্থান করছেন।

রাখাইন রাজ্যের বুচিডং এলাকায় বাছেরের জন্ম। মিয়ানমারে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান সংঘাত সম্প্রতি রাখাইনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কয়েক দিন ধরে ওই রাজ্যের একাধিক গ্রামে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে জান্তা সেনারা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছ থেকে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিতে অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এতে অনেক রোহিঙ্গার হতাহতের খবর আসছে।

ওপারের গোলাগুলির শব্দে এপারে ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎকণ্ঠা। তবে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় অনেকের পক্ষে রাখাইনে তাদের স্বজনের সর্বশেষ অবস্থা জানা সম্ভব হচ্ছে না।

বাছের জানান, জান্তা সেনারা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। অনেকে মারা গেছেন। কেউ কেউ আহত হয়েছেন। দিনে ভয়ে কেউ বাড়ি থাকার সাহস করছেন না। পাহাড়ে লুকিয়ে থাকছেন। সুবিধাজনক সময়ে বাড়ি গিয়ে সামান্য খাবার-কাপড় নিয়ে আবার পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, একসময় অবৈধ সিম ব্যবহার করে তাদের কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতেন। এখন সিম ব্যবহার করা একেবারে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অন্য দেশের সিম ধরা পড়লে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হচ্ছে।

কক্সবাজার ও টেকনাফের আরও কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে বসবাস করা স্বজনরা উদ্বিগ্ন।

গতকাল শনিবারও বান্দরবানের তুমব্রু ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্তের মিয়ানমার অংশে থেমে থেমে ভারী গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। তবে এ দেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।

স্থানীয়রা জানান, টেকনাফ সীমান্তের অপর পাশে মিয়ানমারে চলছে মর্টারশেল ও ভারী অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়ায় একটি এসএমজির গুলি এসে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা সানজিদা বেগম  বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টা থেকে মিয়ানমারে মর্টারশেল ও ভারী গুলির শব্দে কান ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভয় ও আতঙ্কে নিরাপদে সরে এসেছি। হঠাৎ দেখি, ভারী একটি গুলি আমার জামাতার ঘরে টিনের দরজা ছিদ্র হয়ে ঢুকে পড়েছে। পরে বিজিবির সদস্যরা খবর পেয়ে এসে গুলিটি নিয়ে যায়।’ স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মো. সোলেমান বলেন, ‘মিয়ানমারে গোলাগুলির শব্দে ঘরে থাকতে পারছি না। এক সপ্তাহ ধরে সীমান্তের ওপারে মর্টারশেল ও গুলির শব্দে আমরা অনিরাপদ বোধ করছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে সব সময় ভয়ের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু বলেন, ‘টেকনাফের হোয়াইক্যং, তুলাতুলি ও কানজরপাড়া সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমার অংশে গোলাগুলি চলে। ভয়ে আমরা বাড়িঘরে থাকতে পারছি না। কাজে যেতেও ভয় পাচ্ছি।’

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর তুমব্রু সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমারে ভারী গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারীরা ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছে। গুলি ছোড়ার শব্দ শোনার পর জনসাধারণের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সীমান্তের খুব কাছাকাছি বসবাসকারী লোকজনকে আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে মর্টারশেলের মতো বিকট গোলাগুলির বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি।’

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ চলছে। বিজিবি সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে, যাতে নতুন করে কোনো অনুপ্রবেশ না ঘটে।’

সতর্ক বাংলাদেশ
রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল রাজধানীর ইস্কাটনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।

রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমান্তরক্ষীরা অনেক আগে থেকেই সেখানে সতর্ক রয়েছে। কিছুদিন পরপরই সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আছে। আমরা সব সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়েছি। তারা আমাদের সঙ্গে আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হলে তারা তাদের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।’

রাখাইনের রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে কিনা– জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদের তখন স্থান দিয়েছিলাম। আমাদের নানা সমস্যা। আমাদের দেশ জনবহুল, রোহিঙ্গাদের জন্য আমরা ভারাক্রান্ত। প্রতিবছর ৩৫ হাজার নতুন রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করে।’

samakal