- ইমরান খান
- ২১ মার্চ ২০২২, ১৭:৩৫
পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে ইসলামাবাদে ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন আয়োজন পাকিস্তানের সাথে মুসলিম সংহতির একটি অসাধারণ প্রদর্শন। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তঃসরকারি সংস্থা এবং এটি ইসলামী বিশ্বের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরকে প্রতিনিধিত্ব করে।
বছরের পর বছর ধরে, সংগঠনটি সক্রিয়ভাবে ইসলামী বিশ্বের অভিন্ন স্বার্থ ও উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, সমঝোতা, সংলাপ, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সমঝোতার বিস্তার ঘটিয়েছে এবং শান্তি, ন্যায়বিচার এবং পারস্পরিক সম্মানের মহৎ ইসলামিক মূল্যবোধকে উত্সাহিত করার চেষ্টা করেছে।
ইসলামাবাদের সভাটি বিশ্ব ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো বারবার একতরফা শক্তির ব্যবহার, নয়া ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ এবং দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, কোভিড-১৯ মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রযুক্তি বিপ্লবের প্রভাবে ক্রমবর্ধমানভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ইসলামী দেশগুলোকে অবশ্যই সাবধানে এই ‘নতুন বাস্তবতার’ প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে তাদের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত স্বার্থ হাসিল করতে নতুন এই বিশ্বব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে হবে।
সেই লক্ষ্যে, তাদেরকে অবশ্যই নিজেদের আদর্শ সমুন্নত রাখা, বড় শক্তির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানো, আন্তঃ-ইসলামী বিরোধ মীমাংসা এবং বিদেশী হস্তক্ষেপ রোধ করার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রসার ও সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ন্যায়বিচারের পাশাপাশি শান্তির দূত হিসেবে, ওআইসিকে অবশ্যই ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশী দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির ন্যায়সঙ্গত কারণগুলোকে সমর্থন করতে হবে। যদিও এই লক্ষ্যগুলো অলীক, আমি নিশ্চিত যে ইতিহাস সব সময় ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলেছে। জম্মু ও কাশ্মিরের পরিচয় কেড়ে নিয়ে, এর জনসংখ্যা পরিবর্তন করে এবং জনগণকে নির্মমভাবে দমন করে, জম্মু ও কাশ্মিরের উপর চূড়ান্ত ভার চাপিয়ে দেয়ার ভারতের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রাসঙ্গিক রেজুলেশন এবং কাশ্মিরি জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মির বিরোধের চুড়ান্ত মীমাংসার উপর নির্ভরশীল। আমরা ভারতসহ সব প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই। জনসংখ্যাগত পরিবর্তনসহ অধিকৃত কাশ্মীরে তার একতরফা পদক্ষেপগুলো বাতিল করে এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করে, নয়া দিল্লির উচিত পাকিস্তান ও কাশ্মিরীদের সাথে একটি আন্তরিক এবং ফলাফল-ভিত্তিক আলোচনার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা।
৪০ বছর পর, আফগানিস্তান এবং এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধারের একটি বাস্তব সুযোগ রয়েছে। আফগানিস্তানে মানবিক সঙ্কট এবং অর্থনৈতিক পতন এড়াতে আমাদের অবশ্যই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে এবং মানবাধিকার, বিশেষ করে নারীর অধিকার, বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করতে এবং দেশটি থেকে সন্ত্রাসবাদের হুমকি দূর করার জন্য কার্যকর কৌশল তৈরি করতে আফগান কর্তৃপক্ষের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতে হবে।
আমাদেরকে অবশ্যই মুসলিম বিশ্ব যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার সমাধান নিজেদের খুঁজে বের করতে হবে। সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইয়েমেনের সংঘাতগুলো সংশ্লিষ্ট ইসলামিক দেশগুলোর সাথে সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে এবং এই সংঘাতগুলোতে অমুসলিমদের হস্তক্ষেপ বাদ দিতে হবে।
পাকিস্তান সবসময় ইসলামের একটি দুর্গ, এবং বিশ্বের মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থের রক্ষাকর্তা হিসেবে থাকবে।
মুসলিম দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বা অ-মুসলিম দেশ বা সংস্থার সাথে বিরোধের ঘটনা ঘটলে সংলাপ এবং আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব সমাধান করার জন্য ওআইসিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
মুসলিম বিশ্ব সম্পূর্ণরূপে মানুষ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। আমাদেরকে পরস্পরের পরিপূরক এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিজেদের মধ্যে ভাল সমন্বয় করতে হবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যুগ্ম ইসলামিক পদক্ষেপ অনেক বেশি রাজনৈতিক সহাবস্থান এবং সংহতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
কোভিড-১৯ মহামারী এবং জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলির সাথে একত্না হয়েছে। এগুলো আন্তঃ-ওআইসি সমন্বয়ের দিকে অগ্রাধিকার দিতে নতুন উপাদান সরবরাহ করেছে। ইসলামিক দেশগুলিকে অবশ্যই অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির সাথে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে এবং মহামারী হতে পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ জোগান দিতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে ঋণ হতে পরিত্রাণ ও পুনর্গঠন, ০.৭ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তার লক্ষ্য পূরণ করা, নতুন বিশেষ ড্রয়িং অধিকারের আওতায় অব্যবহৃত ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা, বহু-পক্ষীয় উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর বৃহত্তর ঋণ প্রদান করা, অবকাঠামোতে বৃহত্তর সরকারি এবং বেসরকারি খাত হতে বিনিয়োগ করা এবং জলবায়ু ফাইন্যান্সে প্রতি বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচের প্রতিশ্রুতি দেয়া।
আমাদের পূর্ব-পশ্চিম, সকল দেশ এবং দলের সাধে অর্থনৈতিক সহযোগিতা উন্নীত করা উচিত। সেই সাথে, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং অন্য ওআইসি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পূরকতার সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সহযোগিতার জন্য একটি বিশেষ বিশেষজ্ঞ টাস্ক ফোর্স গঠন করা যেতে পারে।
সর্বশেষে, আমাদের বিশ্বাস, ইসলামকে বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে হবে ও মুসলিমের সুরক্ষা প্রদানের জন্য কাজ করতে হবে। ইসলাম, আমাদের পবিত্র গ্রন্থ বা আমাদের মহানবী (সা.)-এর মানহানি বা অবমাননার বিরুদ্ধে আমাদের কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
ইসলামোফোবিয়ার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হল ভারতকে একচেটিয়াভাবে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর করার জন্য সরকারীভাবে অনুমোদিত প্রচারণা চালানো। ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যার আশঙ্কা রয়েছে।ওআইসি দেশগুলির পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রস্তাবিত প্রস্তাবে, ১৫ মার্চকে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিকে উন্নীত করার জন্য আমরা সেতু বন্ধন চালিয়ে যাব, সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার প্রচার করব। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রসার করতে বিশ্বব্যাপী সংলাপকে এগিয়ে নেব।
পাকিস্তান সর্বদা ইসলামের দুর্গ এবং সারা বিশ্বের মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে থাকবে। রিয়াসাত-ই-মদীনায় যেভাবে চর্চিত হয়েছে, সেভাবে আমাদের নবী (সা.)-এর অনুশাসন মেনে পাকিস্তানকে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে রূপান্তর করার মাধ্যমে আমি আমাদের প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন পূরণ করার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী