আন্তন ওলেইনিক
ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ তীব্র হয়েছে। কিন্তু সামরিক দিক দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত পুতিন ইউক্রেনীয়দের শাসন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পুতিন ইউক্রেনের মানুষকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করতে পারবেন না—এটি বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে। বিজয়ী হলেও তিনি যা চান, তা অর্জন করতে সক্ষম হবেন না। এর কারণ, শেষ পর্যন্ত জয়ী হওয়ার জন্য তাঁকে বিজিত দেশটিকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শাসন করতে হবে।একটি দেশ কতটা ভালোভাবে শাসিত হয়, তা তার সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে।
প্রয়াত আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারি একস্টাইন একবার যুক্তি দিয়েছিলেন, যখন সরকারগুলোর কর্তৃত্বের ধরনের সঙ্গে শাসিত সমাজের কর্তৃত্বের ধরনের মিল হয়, তখন সরকারগুলো ভালো করতে থাকে। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব সংগঠন, এমনকি একটি পরিবারেও গণতান্ত্রিক অনুশাসনের কিছু উপাদান থাকে।
স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ঠিক তার উল্টোটা ঘটে। সেখানে সামাজিক সংগঠনের সব স্তরে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। রাশিয়ায় ‘জাতির পিতা’একটি জনপ্রিয় ধারণা। সেখানে জাতির পিতা একটি পরিবারের পিতার মতোই কাজ করবেন বলে আশা করা হয়ে থাকে।
প্রয়াত ডাচ সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গির্ট হফস্টেডের প্রস্তাবিত ক্ষমতার দূরত্বের ধারণা শীর্ষক একটি সূচক আছে। ক্ষমতা বণ্টনে অসমতা একটি সমাজ কতটা মেনে নেয়, তা এই সূচক দিয়ে পরিমাপ করা যায়। একটি জাতির মধ্যে ক্ষমতার দূরত্বের সূচকের মান যত বড় হবে, তাদের মধ্যে তত বেশি বৈষম্য মেনে নেওয়ার প্রবণতা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
ইউক্রেনে পুতিনের সম্ভাব্য শাসন সমস্যাযুক্ত। কারণ, ইউক্রেনীয়রা যে ক্ষমতার মডেল মেনে নিতে প্রস্তুত, তার সঙ্গে পুতিনের শাসনের মডেলের মিল নেই। ইউক্রেনের সংস্কৃতিতে স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে সন্দেহ করা এবং প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা গভীরভাবে প্রোথিত।
২০১৫-২০১৬ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে ইউক্রেনীয় এবং রুশ নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতার অসমতা মেনে নেওয়ার প্রবণতায় ভিন্নতা আছে।ক্ষমতার দূরত্বের সূচকে রাশিয়ার অবস্থান ১১০.৭। সেখানে ইউক্রেনে ক্ষমতার দূরত্ব সূচকের মান ১০০.৯। শিক্ষিত ও সচ্ছল ইউক্রেনীয়দের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনে অসমতা মেনে না নেওয়ার ঝোঁক বেশি।
এ কারণেই ইউক্রেনে পুতিনের সম্ভাব্য শাসন সমস্যাযুক্ত। কারণ, ইউক্রেনীয়রা যে ক্ষমতার মডেল মেনে নিতে প্রস্তুত, তার সঙ্গে পুতিনের শাসনের মডেলের মিল নেই। ইউক্রেনের সংস্কৃতিতে স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে সন্দেহ করা এবং প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা গভীরভাবে প্রোথিত।
ইউক্রেনের সবচেয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মাইখাইলো হ্রুশেভস্কি পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের কোসাকদের (পূর্ব ইউরোপের গণতন্ত্রপন্থী অর্থোডক্স খ্রিষ্টান সম্প্রদায়) আধুনিক ইউক্রেনের পূর্বসূরি বলে মনে করেন। তাতারদের হামলা ঠেকাতে পোল্যান্ড ও রাশিয়ার সরকারগুলো কোসাক মিলিশিয়াদের ভাড়া করত। পোলিশ, তাতার এবং রুশসহ যেকোনো শাসকদের সমস্যা সৃষ্টিকারী হিসেবে এই কোসাকদের খ্যাতি ছিল।
হ্রুশেভস্কি কোসাকদের ‘কারও কোনো কর্তৃত্ব না মানা’ গোষ্ঠী বলে বর্ণনা করেছেন। এমনকি পোল্যান্ডের লোকেরা, যারা নাকি কোসাকদের মতোই ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণের ধারণাকে অপছন্দ করত, তারাও কোসাকদের ‘শাসন না মানা’ সম্প্রদায় বলত।
কোসাক সামরিক নেতারা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আসতেন এবং সেই নেতৃত্ব সহজেই প্রতিস্থাপনযোগ্য ছিল। কোনো সামরিক পরাজয় হলে কোসাকরা একত্র হয়ে আলোচনার মাধ্যমে আগের নেতাকে বাদ দিয়ে নতুন নেতা নির্বাচন করত। তাদের মধ্যে কেউই স্থায়ীভাবে ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। সেই কোসাক ঐতিহ্য এখনো ইউক্রেনের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের রুশ হানাদারদের বিরুদ্ধে যে ভয়ংকর প্রতিরোধ দেখাচ্ছে, তা সেটাকেই ইঙ্গিত করছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগে ইউক্রেনীয় জাতীয় সংস্কৃতিকে দমন করা হয়েছিল এবং রাশিয়ার দ্বারা তারা অপমানিত হয়েছিল।
২০১৩-১৪ সালে ইউক্রেনে পুতিনের পুতুল সরকারকে উৎখাত করার বিক্ষোভের সময় কোসাক সংস্কৃতির উপাদানগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা কোসাক সামরিক ক্যাম্পের সাংগঠনিক কায়দায় কিয়েভের কেন্দ্রে তাদের তাঁবু–শিবির বসিয়েছিল।
পুতিনের আজকের এই সর্বাত্মক যুদ্ধেও খুব কমই তার ব্যতিক্রম হবে। এটি সম্ভবত পুতিনের অপ্রত্যাশিত একটি ফলাফলের দিকে নিয়ে যাবে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের প্রত্যাখ্যান আরও জোরালো হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● আন্তন ওলেইনিক মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউফাউন্ডল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক