রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের (এস আলম) বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির আয়কর বিভাগ সাইফুল আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। ঢাকার কর অঞ্চল-১৫ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত চিঠি সব ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও ডাক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। এর পাশাপাশি এস আলমের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি এস আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ক্রেডিট কার্ডের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৯২টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখায় যদি তাঁদের নামে কোনো হিসাব থাকে, সে ব্যাপারে তথ্য জানাতে হবে এনবিআরকে।
এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংক দখল করে লুট, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে। গণ–আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ ও তাঁদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাওয়া অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। এস আলমের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংকসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি গ্রুপটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও দেশ ছেড়েছেন।
ব্যাংক হিসাব তলব
কর অঞ্চল-১৫ সূত্রে জানা গেছে, সাইফুল আলম, তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন, মা চেমন আরা বেগম ও ভাই আবদুল্লাহ হাসানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের মা–বাবা, স্ত্রী, ছেলে–মেয়ে বা বোনের যৌথ নামে অথবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্যও তলব করা হয়েছে। ফলে কার্যত এস আলমসহ তাঁর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সব ব্যাংক হিসাবের তথ্যই চেয়ে পাঠিয়েছে এনবিআর। আলোচিত–সমালোচিত এই ব্যবসায়ীর সব ভাইয়ের ব্যাংক হিসাবও তলবের তালিকায় পড়েছে।
তবে তলবের তালিকার বাইরে রয়েছেন সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদ, তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ও ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী।
এস আলম নামেই বেশি পরিচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর পক্ষে এসব ব্যক্তিই মূলত সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অপরাধ করেন।
এস আলম ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে গত এক দশকে ব্যাংক দখল, অর্থ পাচারসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব কাজে তিনি শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ পর্যায় ও রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ব্যাপক সুবিধা পেতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আয়কর বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের তথ্য তখনই চাওয়া হয়, যখন কর ফাঁকির বিষয়ে সন্দেহ করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, এস আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কর নথির সঙ্গে বাস্তব সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত আয়কর নথি রয়েছে বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ)। সেখান থেকেও তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থাকা আর্থিক হিসাবের যাবতীয় তথ্য চাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এলটিইউ থেকেও এস আলমের ব্যক্তিগত কর ফাঁকির বিষয়টি তদন্ত করা হবে।
ছয় ব্যাংক ফাঁকা করে ফেলেছে গ্রুপটি
২০১৭ সালের আগে এস আলম গ্রুপ ছিল সাধারণ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মতো। ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করতেন সাইফুল আলম। শুধু ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এরপর তিনি ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যান, তবে হয়ে ওঠেন পরাক্রমশালী।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ইসলামী ব্যাংকের দখল নেয় গ্রুপটি। এখন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম। ব্যাংকটির ঋণের এক-তৃতীয়াংশ বা ৫০ হাজার কোটি টাকাই এই গ্রুপের কাছে। ওই বছরের অক্টোবরে অনেকটা একই কায়দায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় গ্রুপটি। এখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদ। ব্যাংকটি থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে গ্রুপটি।
এর ঠিক আগে আগে, ২০১৬ সালে গ্রুপটি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এস আলম গ্রুপের কাছে, ফলে ব্যাংক দুটির বেশির ভাগ ঋণ এই গ্রুপের কাছে আটকে রয়েছে। ব্যাংক ছয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না, ফলে জরিমানা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে সহায়তা দিয়েছেন। এখন এসব সুবিধা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে।
২০১৭ সালের পর রাজধানীর গুলশান, বসুন্ধরা, ধানমন্ডিসহ একাধিক এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি কিনেছে গ্রুপটি। আবার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের নানা এলাকায় জমি কিনেছে। পাশাপাশি দেশের বাইরে একাধিক তারকা হোটেলের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে এস আলমের বিরুদ্ধে।
ভ্যাট ফাঁকি ৩৫০০ কোটি টাকা
এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। এই দুটি প্রতিষ্ঠান হলো চট্টগ্রামের এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড।
ভ্যাট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে পরের তিন বছর নিজেদের বিক্রির তথ্য গোপন করে প্রতিষ্ঠান দুটি। নিজেদের রিটার্নে কম বিক্রি দেখিয়ে তারা ভ্যাট ফাঁকি দেয়। আবার ভোজ্যতেল উৎপাদনের উপকরণ কেনায়ও ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১ হাজার ৯১১ কোটি টাকা এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।
তদন্ত শুরু ইসলামী ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকে
এদিকে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এস আলমের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংকটির চট্টগ্রামের তিনটি শাখা থেকে এই ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫৪ কোটি টাকা, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা ও সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহীর কয়েকটি শাখা থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি আগেই অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সেই অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে যায়। দুদক সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চার দফায় ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু তখন বাংলাদেশ ব্যাংক দুদককে কোনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি। তাই অনুসন্ধান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নির্দেশের কারণে ইসলামী ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে দুদককে তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাটি। তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আবার ইসলামী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ তুলে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ইয়াসির আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ১২ আগস্ট তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এদিকে সাবেক সরকারের আরেক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে পদ্মা ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুটপাটের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। সাবেক ফারমার্স (বর্তমানে পদ্মা) ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এর পরই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকটির নাম পাল্টে রাখা হয় পদ্মা বাংক। গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ ছেড়েছেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
দুদক সূত্র বলছে, পুলিশ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সহায়তায় পদ্মা ব্যাংক দখল করেছিলেন নাফিজ সরাফাত। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শেয়ারবাজার থেকে ৮০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
দুদকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন, আর্থিক খাতে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের নানা অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
prothom alo