এসআই নিয়োগে রাজনৈতিক কৌশল ও যত অনিয়ম

এসআই নিয়োগে রাজনৈতিক কৌশল ও যত অনিয়ম

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালে। এর আগে পুলিশে হাজার দেড়েক উপপরিদর্শক (এসআই) নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১২ সালের শুরুতে। নতুন এই এসআইদের ভোটের আগেই মাঠে নামাতে আশ্রয় নেওয়া হয় নানা অনিয়মের। দুই বছরের প্রশিক্ষণ কমিয়ে করা হয় এক বছর। লিখিত পরীক্ষা শেষে মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) নেওয়ার আগেই করা হয় পুলিশ ভেরিফিকেশন। কোটার বরাদ্দ ভেঙে প্রাধান্য পায় গোপালগঞ্জ জেলা। নিয়োগের তালিকা চূড়ান্ত হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রভাবশালী পুলিশদের একটি সিন্ডিকেটের হাত ধরে।

অনিয়মের সেই শুরু। এর পর থেকে টানা এক যুগ ধরে এসআই নিয়োগে চলতে থাকে এসব অনিময়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এভাবে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ১০ হাজার এসআই।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলেছে, বিগত সময়ে এসআই নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণের মাধ্যমে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়, গুম, হত্যা, নির্যাতন, দমনপীড়নে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য দলীয় লোকজনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১২ সালে ৩৩তম ক্যাডেট এসআই নিয়োগ দেওয়া হয়। ৩২তম ক্যাডেট এসআই নিয়োগ পর্যন্ত দুই বছরের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং এরপর দুই বছর শিক্ষানবিশকাল ছিল। কিন্তু ৩৩তম ব্যাচে নিয়োগের আগে ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ শাখা-২-এর এক প্রজ্ঞাপনে বনিয়াদি প্রশিক্ষণ কমিয়ে ১ বছর ও শিক্ষানবিশকালও করে ১ বছর। পুলিশ অ্যাক্ট, ১৮৬১-এর সেকশন-২-এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পুলিশ রেগুলেশনস, বেঙ্গল (পিআরবি), ১৯৪৩-এর রেগুলেশনস ৭৯১-এর সংশোধনের পর সরকার এই কাটছাঁট করে। শিক্ষানবিশকালে এসআইরা মাঠে অভিযান, গ্রেপ্তার ও মামলার তদন্ত করতে পারেন না। প্রশিক্ষণ ও শিক্ষানবিশকাল কমিয়ে অর্ধেক করায় ৩৩তম ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্তরা সহজে দশম সংসদ নির্বাচনে মাঠে থাকার সুযোগ পান।

সূত্র জানায়, ৩৩তম ব্যাচে অন্তত ১ হাজার ৪৫০ জন ক্যাডেট এসআই বনিয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষানবিশ এসআই পদে নিয়োগ পান ১ হাজার ৩৫০ জন।

৩৩তম ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন বর্তমানে রাজশাহী রেঞ্জে কর্মরত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষানবিশকাল কমানোর ফলে তাঁদের সঙ্গে ২০১২ সালে নিয়োগপ্রাপ্তরা দ্রুত মাঠের কাজে অংশ নিতে পেরেছিলেন।

এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচনে পুলিশকে ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের সময় কমানো হলে সন্দেহ করা যেতেই পারে। তবে প্রশিক্ষণের সময় কমিয়ে দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার কাজটি সঠিক নয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, এসআই নিয়োগে প্রাথমিক বাছাই করে এবং লিখিত পরীক্ষা নেয় পুলিশের রেঞ্জ কার্যালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় দল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার (ভাইভা) নেয়। ওই সাক্ষাৎকারের পর নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। পিআরবির ৭৪১ ও ৭৪২ প্রবিধান অনুযায়ী, এসআই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ও চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে উত্তীর্ণরা শিক্ষানবিশ এসআই হিসেবে প্রাথমিক নিয়োগ পান।

২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আটটি (৩৩তম থেকে ৪০তম) ব্যাচে অন্তত ১০ হাজার এসআই নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে ৩৬তম থেকে ৪০তম ব্যাচে এসআই নিয়োগের নথি পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, ২০১৬ সালে ৩৬তম ব্যাচে ১ হাজার ৩৭৮, ২০১৭ সালে ৩৭তম ব্যাচে ১ হাজার ৮০৯, ২০১৯ সালে ৩৮তম ব্যাচে ১ হাজার ২৩১, ২০২২ সালে ৩৯তম ব্যাচে ৭৬১ এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৪০তম ব্যাচে ৮০৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পাঁচবারে নিয়োগ পেয়েছেন মোট ৫ হাজার ৯৮৩ এসআই। এর আগে ৩৫তম ব্যাচে নিয়োগ পান ১ হাজার ২২১ জন। এই পাঁচটি ব্যাচে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আছেন ৬৬৫ জন। তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে জনশ্রুতি আছে।

অভিযোগ উঠেছে, এসব ব্যাচের নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার পর উত্তীর্ণদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগেই পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়, যাতে সাক্ষাৎকারের আগেই প্রার্থীর এবং তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ বিগত সময়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হতো না।

এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, সাক্ষাৎকারের আগে সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন হওয়া উচিত নয়। কারণ, সাক্ষাৎকারের আগে জানা যায় না কাকে নেওয়া হবে। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বেশি নিয়োগপ্রাপ্ত গোপালগঞ্জসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের
অভিযোগ রয়েছে, এসআই পদে ওই আট ব্যাচের নিয়োগে জেলা কোটা মানা হয়নি। কোটা লঙ্ঘন করে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর জেলার প্রার্থীদের। অন্য জেলার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবারের সদস্যদের।

২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির আগপর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী—এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। ৩৬তম থেকে ৪০তম ব্যাচের নিয়োগ পর্যালোচনায় দেখা যায়, জেলা কোটা অনুযায়ী গোপালগঞ্জের শতকরা শূন্য দশমিক ৮১ জন প্রার্থী নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও পেয়েছেন ৩ দশমিক ৮৮ জন; যা সংখ্যায় ২৩২ জন। ফরিদপুরের শতকরা ১ দশমিক ৩৩ জন নিয়োগের সুযোগ থাকলেও দেওয়া হয়েছে ১৮৭ জন। শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ কোটার সুযোগ থাকা মাদারীপুরের নিয়োগ পেয়েছেন ১৩৩ জন। গোপালগঞ্জের আশপাশের জেলার প্রার্থীরাও বেশি নিয়োগ পেয়েছেন। বিগত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার বাড়ি গোপালগঞ্জে।

অভিযোগ রয়েছে, গোপালগঞ্জে বাড়ি—এমন কোনো কোনো প্রার্থী অন্য জেলার কোটায় চাকরি পেতে জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। এই অভিযোগও তদন্ত করছে পুলিশ সদর দপ্তর।

সুপারিশের পর নিয়োগ না পাওয়ার নজিরও আছে। এমন ৬৫ জন সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়ার দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন। তাঁদের দাবি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করায় কিংবা পরিবারের কেউ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁদের চাকরি দেওয়া হয়নি।

সূত্র বলেছে, এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপিদের সুপারিশও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তো আছেই। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে পুলিশ সদর দপ্তরের দু-তিনজন ডিআইজির যোগসাজশে একটি চক্র নিয়োগের তালিকা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করত বলে জানা গেছে।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতির এ নিয়োগ পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে রূপান্তর করেছে। এ জন্য পুলিশ পেশাদারত্ব হারিয়ে দেউলিয়াত্ব হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই ধ্বংস করা হয়েছে।

Ajker Patrika