কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা এফএসআরইউ নির্মাণের খসড়া চুক্তি অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। টার্মিনালটি নির্মাণের কাজ পেয়েছে সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি লিমিটেড (এসওএসসিএল)। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গতকাল অনুষ্ঠিত সভায় অনুমোদিত খসড়া চুক্তি অনুযায়ী, টার্মিনাল চালুর পর থেকে ১৫ বছর মেয়াদে দৈনিক ৩ লাখ ডলার (চুক্তিতে উল্লিখিত বিনিময় হার অনুযায়ী ৩ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ) রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ পাবে সামিট।
সামিট গ্রুপসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চুক্তি অনুযায়ী এলএনজি টার্মিনাল থেকে তাদের আয় হবে ডলারে। তবে এটি রক্ষণাবেক্ষণ, বিভ্রাট ও মেরামতের জন্য ড্রাই ডকিং করা হলে যে কয়দিন বন্ধ থাকবে, সে কয়দিনের জন্য কোনো চার্জ পাওয়া যাবে না।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতিটি এলএনজি টার্মিনাল বছরে গড়ে পাঁচদিন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এর বাইরেও প্রতি পাঁচ বছরে একবার দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই মাসের জন্য আলাদা করে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হয়। সে অনুযায়ী, কোনো বিপত্তি না ঘটলে ১৫ বছরে টার্মিনালটি বন্ধ রাখতে হতে পারে সর্বোচ্চ ২৪০ দিন (আট মাসের সমান)। সেক্ষেত্রে ১৫ বছরে টার্মিনালটি চালু থাকবে অন্তত ৫ হাজার ২৩৫ দিন। দৈনিক ৩ লাখ ডলার হিসাবে (কর ও মূসক বাদে) এ সময় রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ বাবদ সামিটের আয় হবে অন্তত ১৫৭ কোটি ৫ লাখ ডলার। চুক্তি অনুমোদনের সময়ে এতে উল্লিখিত বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা) ১৫ বছরে টার্মিনালটি থেকে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ বাবদ সামিটের আয় দাঁড়াবে অন্তত ১৭ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকায়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সামিটকে এ অর্থ ডলারে পরিশোধ করবে সরকার। সেক্ষেত্রে মুদ্রাটির বিনিময় হার বাড়লে এ বাবদ সরকারের ব্যয় হবে আরো অনেক বেশি।
টার্মিনালটি নির্মাণসংক্রান্ত এসওএসসিএলের প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে নীতিগত অনুমোদন পায় গত ১৪ জুন। অনুমোদনের পর সামিটের অনুকূলে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) ইস্যু করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসওএসসিএল এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) মধ্যে টার্মিনালটি নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তির শর্ত নির্ধারণে আলোচনা চলে। দুই পক্ষ খসড়া চুক্তির বিষয়ে একমত হওয়ার পর গতকাল তা অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় উত্থাপন করা হয়। সভাশেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান এসওএসসিএল ও পেট্রোবাংলার মধ্যে টার্মিনাল ব্যবহার ও বাস্তবায়ন নিয়ে স্বাক্ষরিত হতে যাওয়া চুক্তির খসড়া অনুমোদনের বিষয়টি জানান।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে গত সপ্তাহে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পেট্রোবাংলার সঙ্গে এলএনজি সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে সামিট গ্রুপের আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান গ্রুপটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এ বিষয়ে চুক্তি সই সম্পন্ন হবে বলে তখন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তিনি।
ওই সময় মুহাম্মদ আজিজ খান রয়টার্সকে বলেন, ‘বছরে ১৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ নিয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। ২০২৬ সাল থেকে ১৫ বছর এলএনজি সরবরাহের জন্য এ চুক্তি করা হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ক্রমাগত কমার কারণে বাংলাদেশের প্রচুর এলএনজি প্রয়োজন। অত্যন্ত কঠিন সময়েও বাংলাদেশের জিডিপি ৫ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য এলএনজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৬-২৭ সাল থেকে বাংলাদেশ বছরে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টন এবং ২০৩০ সালে কমপক্ষে ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টন এলএনজি আমদানি করবে। এলএনজি আমদানির জন্য সামিট একটি এলএনজি ক্যারিয়ার সংগ্রহে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যেটিকে ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটে (এফএসআরইউ) রূপান্তর করা হবে। এটি হবে বাংলাদেশে সামিটের দ্বিতীয় এফএসআরইউ। চালু হবে ২০২৬ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে।’
সামিট গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণের কাজ পাওয়া এসওএসসিএলের শতভাগ মালিকানা রয়েছে সামিট করপোরেশনের কাছে। আর সামিট করপোরেশনের শতভাগ মালিকানায় রয়েছে সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার হচ্ছে জাপানের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জেরা। টার্মিনাল নির্মাণের ব্যয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এক্ষেত্রে অনুমিত ব্যয়ের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলারের মতো। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ইকুইটি এবং ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ঋণ থেকে আসবে। ইকুইটির পুরোটাই সামিট অর্থায়ন করবে। তবে কোন উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে সেটি এখনো নির্ধারিত হয়নি। ২০২৬ সালের মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ করতে চায় সামিট। এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার সঙ্গে টার্মিনাল ব্যবহার ও বাস্তবায়ন বিষয়ে চুক্তি সইয়ের পর প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হবে এবং এটি নির্মাণে সময় লাগবে দুই বছর।
এলএনজি টার্মিনালের বিষয়ে জানতে চাইলে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় তৃতীয় এলএনজি টার্মিনাল মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে আরো অবদান রাখতে চাই। যেহেতু আমাদের নিজেদের গ্যাস কমে যাচ্ছে, সেহেতু আমাদের আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভর করতে হবে। সামিট তার সব প্রকল্পে দক্ষতা ও ব্যয় সাশ্রয়ী করার প্রচেষ্টা করে। টার্মিনালটি সবচেয়ে কম খরচে পেট্রোবাংলাকে এলএনজি স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন সুবিধা দেবে। এফএসআরইউটির স্টোরেজ সক্ষমতা ১ লাখ ৭০ হাজার ঘনমিটার এবং দৈনিক রিগ্যাসিফিকেশন সক্ষমতা ৬০ কোটি ঘনফুট।
বর্তমানে দেশে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। দুটি টার্মিনালই কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত। এর মধ্যে একটির মালিকানায় রয়েছে এক্সিলারেট এনার্জি। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণের জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করে এক্সিলারেট। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। ১৫ বছর মেয়াদি টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। তবে এক্সিলারেট এনার্জি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে এ টার্মিনাল চুক্তির মেয়াদ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের শেষদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এলএনজি টার্মিনালের মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। এক্সিলারেট এনার্জির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১১ কোটি ৫২ লাখ ৪১ হাজার ডলার আয় করেছে। এর আগের দুই বছরে অর্থাৎ ২০২১ ও ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে যথাক্রমে ২৭ কোটি ৪০ লাখ ১৭ হাজার ও ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৪ হাজার ডলার।
আরেকটির টার্মিনালের মালিকানায় রয়েছে সামিট। টার্মিনালটি নির্মাণে পেট্রোবাংলার সঙ্গে সামিটের চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। এ টার্মিনালের মেয়াদ রয়েছে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।
এর বাইরে সরকারের পরিকল্পনাধীন মাতারবাড়ী অনশোর এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় জেরা ও সুমিতমো করপোরেশনের সঙ্গে সামিটও রয়েছে।
বনিক বার্তা