এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেনের বর্ণনায় উঠে এল দুর্বিষহ জিম্মিদশার ৩৩ দিন

এমভি আবদুল্লাহর মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ

৩৩ দিন জিম্মি করে রাখার পর গত শনিবার দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জিম্মিদশার শুরু থেকে মুক্তি পর্যন্ত সবকিছুই ঘটে জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদের চোখের সামনে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে থাকা জাহাজটি থেকে গতকাল মঙ্গলবার হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে দুর্বিষহ এই জিম্মিদশার বর্ণনা দিয়েছেন ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।

যেভাবে হানা দেয় জলদস্যুরা

১২ মার্চের সকাল। ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ নীল সাগরে (ভারত মহাসাগর) ছুটে চলছিল। কেবিনে অফিসের কাজ সেরে সকাল সাড়ে ৯টায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টা) ব্রিজে (জাহাজ পরিচালনা করা হয় যে কক্ষ থেকে) মাস্টারের চেয়ারে গিয়ে বসি। জাহাজের তৃতীয় কর্মকর্তা তখন দায়িত্বে। তাঁকে বলি, ‘সব ঠিকঠাক আছে? চোর নাই তো?’

সোমালিয়ার জলদস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করেছিল গত ১২ মার্চ
সোমালিয়ার জলদস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করেছিল গত ১২ মার্চছবি: সংগৃহীত

মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লা বোঝাই করে সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগর হয়ে যাচ্ছি আমরা। একটু পরই তৃতীয় কর্মকর্তা জানালেন, ‘স্যার, জাহাজের ডান পাশে অনেক দূরে একটি ফিশিং বোট দেখা যাচ্ছে।’

ফিশিং বোটটি দৃশ্যমান হওয়ার পর জাহাজটি বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিই, যাতে ব্যবধান বেড়ে যায়। নৌযানটি আমরা পর্যবেক্ষণ শুরু করি। হঠাৎ করে দেখি, নৌযানটি থেকে একটি স্পিডবোট সাগরে ভাসানো হয়েছে। তখনই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, জলদস্যুরা আসছে।

স্পিডবোট দ্রুতগতিতে আমাদের দিকে আসতে থাকে। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে কয়লা বোঝাই থাকায় আমাদের গতি ছিল কম। ঘণ্টায় সাড়ে ১০ নটিক্যাল মাইল।

স্পিডবোটটি কাছাকাছি চলে আসার পর একবার ঢেউ সৃষ্টি করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। উচ্চচাপে পানি ছিটানো হয়। আবার ডানে-বাঁয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে স্পিডবোটটির গতি কমানোর চেষ্টা শুরু করি।

সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর এই ছবি গত ১৫ মার্চ প্রকাশ করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনী
সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর এই ছবি গত ১৫ মার্চ প্রকাশ করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনীছবি: ভারতীয় নৌবাহিনীর এক্স পোস্ট থেকে নেওয়া

একই সময়ে জরুরি বার্তার বাটনে চাপ দিই। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগ করি। তবে সেখানে কেউ ফোন ধরেননি। সে সময় ভিএইচএফে (বেতার) যোগাযোগ করে কাছাকাছি কোনো যুদ্ধজাহাজ পাইনি। কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি।

জলদস্যুরা উঠে যাবে জেনে আমাদের শেষ চেষ্টা ছিল জাহাজের সিটাডেলে (সুরক্ষিত কক্ষ) আশ্রয় নেওয়া। মোট ২৩ জন নাবিকের মধ্যে ২০ জনকে সিটাডেলে যাওয়ার নির্দেশ দিই।

সিটাডেলে যাওয়ার আগে বেশ কিছু কাজ করতে হয়। ইঞ্জিন বন্ধ করার জন্য চতুর্থ প্রকৌশলী ইঞ্জিনকক্ষের দিকে দৌড়ে যেতে থাকেন। দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে এবং আমি ব্রিজের নিচের ডেকে থেকে সিটাডেলে যাওয়ার শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছি।

তবে চারজন জলদস্যু অস্বাভাবিক দ্রুততায় ব্রিজে উঠে প্রথমে দ্বিতীয় কর্মকর্তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ‘মাস্টার মাস্টার’ বলে আমাকে খুঁজতে থাকে।

দ্বিতীয় কর্মকর্তা ভয় পেয়ে যান। প্রাণহানির শঙ্কায় আমি দ্রুত সেখানে চলে এসে হাত তুলি। তখনই জলদস্যুরা ‘অল ক্রু’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এরপরই আমি সব নাবিককে ব্রিজে চলে আসার নির্দেশ দিই।

জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটি যুদ্ধজাহাজ
জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটি যুদ্ধজাহাজছবি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন নৌবাহিনীর  অপারেশন আটলান্টার এক্স পোস্ট থেকে

শুরুতে ভয় পেয়ে যান নাবিকেরা। সেখানকার সময় সকাল ১০টা ৬ মিনিট থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে যায়।

নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জলদস্যুরা জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করার কথা বলে। সে অনুযায়ী ইঞ্জিন বন্ধ করার পর মাছ ধরার নৌযানটি আমাদের জাহাজের সঙ্গে বাঁধা হয়। ওই নৌযানে একজন পাকিস্তানি এবং বাকিরা ছিলেন ইরানের জেলে।

জাহাজ থেকে নৌযানটিতে তেল দেওয়ার নির্দেশ দেয় জলদস্যুরা। তেল দেওয়ার পরই জলদস্যুরা নৌযানটি ছেড়ে দেয়। নৌযানে থাকা সব জলদস্যু জাহাজে ওঠে।

মোট ১২ জন সশস্ত্র জলদস্যু আমাদের জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আনন্দে তারা ফাঁকা গুলি ছোড়ে। আমাদের কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেয় তারা। তবে ল্যাপটপ ও কয়েকটি মুঠোফোন আমরা লুকিয়ে রেখেছিলাম।

জিম্মিদশা শুরু

মাছ ধরার নৌযানটি চলে যাওয়ার পর এমভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন চালু করি। সোমালিয়ার উপকূলের দিকে যাওয়ার নির্দেশনা দেয় জলদস্যুরা। সে সময় একজন জলদস্যু একটি নম্বরে যোগাযোগ করতে বলে। কল দেওয়ার পর ‘আহমেদ’ পরিচয় দিয়ে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘হাউ আর ইউ ক্যাপ্টেন? এভরিথিং ইজ ওকে?’ এরপরই জাহাজটি কীভাবে কোথায় নিতে হবে, তার পথনির্দেশনা দিয়ে দেয় জলদস্যুনেতা। সে অনুযায়ী জাহাজ চলতে থাকে।

রোজার দ্বিতীয় দিন তখন। ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে চিফ কুককে ইফতারি তৈরি করার জন্য ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করি জলদস্যুদের। ছোলা দিয়ে কোনোভাবে ইফতার সেরে নিই আমরা সবাই।

দ্বিতীয় দিন ইফতারের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপারেশন আটলান্টার একটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর পিছু নেয়। যুদ্ধজাহাজ থেকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ভিএইচএফে জলদস্যুদের নির্দেশনা দেওয়া হয়, ‘তোমরা জাহাজ ছেড়ে যাও। না হলে অভিযান চালানো হবে।’

এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নাবিকেরা
এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নাবিকেরাছবি: সংগৃহীত

নির্দেশনায় কোনো কাজ না হওয়ায় যুদ্ধজাহাজ থেকে একটি হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ানো হয়। হেলিকপ্টারটি এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে ঘুরতে থাকে। একপর্যায়ে এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে পানিতে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হয়।

জলদস্যুরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে রাখে। যুদ্ধজাহাজ যাতে দ্রুত চলে যায়, তা বলার জন্য আমাকে জলদস্যুরা ভয় দেখায়। প্রাণহানির আশঙ্কায় আমি ভিএইচএফে জানাই, ‘আমরা অস্ত্রের মুখে আছি। তোমরা দূরে চলে যাও। নাবিকদের নিরাপত্তার জন্য হলেও তোমরা একটু দূরে সরে যাও।’ প্রায় আধা ঘণ্টা পর যুদ্ধজাহাজ দূরে চলে যায়।

দুই দিন ছয় ঘণ্টার মাথায় এমভি আবদুল্লাহকে সোমালিয়া উপকূলের কাছে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। সোমালিয়ার উপকূলের কাছাকাছি যাওয়ার পর ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি চলে আসে।

ভারতীয় যুদ্ধজাহাজে একজন বাংলায় কথা বলতে পারতেন। জলদস্যুদের অস্ত্রের মুখে তাঁকেও চলে যেতে বলি।

যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় দুই দফা নোঙর তুলে তৃতীয় দফায় সোমালিয়া উপকূলের জেফলের দিকে এমভি আবদুল্লাহকে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। উপকূল থেকে দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল তখন জাহাজটি।

নীল সাগরে এগিয়ে চলছে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহ

জিম্মিদশার দিনগুলো

সোমালিয়ার উপকূলে যাওয়ার আগে ১২ জন জলদস্যু আমাদের জিম্মি করে রেখেছিল। জেফল উপকূলে দ্বিতীয়বার নোঙর করার সময় আরও ১০ জন জলদস্যু অস্ত্র নিয়ে আসে।

শেষবার যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন আরও ১৩ জন জলদস্যু জাহাজে যোগ দেয়। সব মিলিয়ে ৩৫ জন জলদস্যু জাহাজে ওঠে।

যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় জলদস্যুরা জাহাজে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। রকেট লঞ্চার, মেশিনগান, এম-সিক্সটিনসহ নানা রকমের অস্ত্র। অস্ত্রের বহর দেখে মনে হয়েছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি।

শুরুর দিকে ব্রিজ কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতাম আমরা। একটি প্রসাধনকক্ষ ব্যবহার করতাম সবাই। জলদস্যুরা সার্বক্ষণিক অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিত।

আমি দেখলাম, জলদস্যুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করে উপায় নেই। ভালো ব্যবহার করে তাদের বুঝিয়ে আমরা কেবিনে থাকার সুযোগ পেলাম। কত দিনে মুক্তি পাব, তা জানি না। তাই খাবারদাবার রেশনিং করতে হবে। সে অনুযায়ী রেশনিং শুরু করি।

এমভি আবদুল্লাহর মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ
এমভি আবদুল্লাহর মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদছবি: সংগৃহীত

আমরা ১৬ জানুয়ারি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পথে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর হয়ে মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা বোঝাই করেছিলাম।

চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রায় ১৪ লাখ টাকার বাজারসদাইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জাহাজটির মালিকপক্ষ এসআর শিপিং (কেএসআরএম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান)। জাহাজে তিন মাসের খাবার ছিল। মাছ, মাংস থেকে শুরু করে শুকনো খাবার—সবই ছিল।

মাপুতো বন্দর থেকে জুস, দুধ, সবজি, ফল ও পানি নিয়েছিলাম। জাহাজে খাবার থাকলেও কত দিন জিম্মি থাকতে হয়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কিছুটা ভয় ছিল—খাবার যদি শেষ হয়ে যায়! কারণ, আগে জিম্মি হওয়া জাহান মণি জাহাজের ১০০ দিন লেগেছিল মুক্ত হতে।

জলদস্যুরা জাহাজে দুম্বা নিয়ে আসত। গরম পানিতে সেদ্ধ করে লবণ ও কিছু মসলা মিশিয়ে তারা তা খেত। এগুলো আমাদের জন্য খাওয়ার অযোগ্য ছিল। একপর্যায়ে তারা নিজেদের রান্না করার জন্য লোক নিয়ে আসে জাহাজে। আমরা ইফতারের সময় লেবুসহ নানা ধরনের শরবত পান করতাম। সাহ্‌রিতে ভাতের পাশাপাশি দুধ থাকত।

জাহাজে পানি শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়ব—এমন আশঙ্কায় শুধু খাবার পানি সরবরাহ ঠিক রাখতাম আমরা। বাথরুমে সাগরের পানি ব্যবহার শুরুর অনুরোধ করি জলদস্যুদের। এতে জাহাজে থাকা পানির ওপর চাপ কমে। সপ্তাহে দুই দিন গোসল করে পানি রেশনিং করতে থাকি আমরা।

গণমাধ্যমে ছবি দেখে জলদস্যুদের হুমকি

ঈদুল ফিতরের দিন আমরা জলদস্যুদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে নামাজ আদায় করি। জাহাজের পণ্য রাখার খোলের ওপর নামাজ আদায় শেষে ছবি তোলার জন্য জলদস্যুদের কাছে অনুরোধ করি।

জলদস্যুদের মধ্যে যে ব্যক্তি (আহমেদ) ইংরেজি জানত, সে ক্যামেরা দিয়ে আমাদের ছবি তুলে দেয়। পরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছবি প্রকাশ হলে তা জেনে যায় জলদস্যুরা।

গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দেখে জলদস্যুরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। তাদের সন্দেহ হয়, নিশ্চয়ই নাবিকদের কাছে মুঠোফোন আছে। আহমেদ বলতে থাকে, ‘তোরা এই ছবি পাঠিয়েছিস?’ পরে আমরা বলি, ‘মুঠোফোন নয়, ল্যাপটপ দিয়ে ছবি পাঠানো হয়েছে।’ পরে ল্যাপটপ কেড়ে নেয় জলদস্যুরা।

এমভি আবদুল্লাহর মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদের সঙ্গে ইইউ নৌবাহিনীর এক সদস্য

জলদস্যুরা যেদিন ভিডিও করল

মুক্তি পাওয়ার দুই দিন আগে হঠাৎ আহমেদ এসে সবাইকে ডেকে নিয়ে দাঁড়াতে বলে। সে আমাদের ভিডিও করতে শুরু করে। তার কথা অনুযায়ী, আমি নাবিকদের নাম জিজ্ঞাসা করে পরিচয় করে দিই। শুনেছি, এই ভিডিও তারা কেএসআরএম গ্রুপের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা যে সুস্থ আছি, তা দেখতে চেয়েছে কেএসআরএম গ্রুপ। আমাদের মনে তখন আশার সঞ্চার হয়।

মুক্তির ক্ষণ

দুই দিন পর আবার ডাক পড়ল সব নাবিকের। আমাদের সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে জলদস্যুরা। রোদের দিকে সামনে তাকানো যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখি, ছোট আকারের একটি উড়োজাহাজ আসছে। অদূরে দুটি যুদ্ধজাহাজ। আমরা ভয় পেয়ে যাই। কারণ, তখন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ৬৫ জন জলদস্যু। তাদের কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে।

উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমাদের আবার ব্রিজে নিয়ে মাথা নিচু করে বসিয়ে রাখে জলদস্যুরা। এ সময় কী হয়েছে, আমরা কিছু দেখিনি।

একপর্যায়ে জলদস্যুদের কথায় এমভি আবদুল্লাহর নোঙর তুলে পেছনের দিকে সরিয়ে নিতে থাকি। এর আগে চারটি স্পিডবোটে করে বেশ কিছুসংখ্যক জলদস্যু তীরের দিকে চলে যায়। জাহাজ পেছনের দিকে সরিয়ে নেওয়া হতে থাকে। একপর্যায়ে দেখতে পাই, রাতে তীর থেকে জাহাজের দিকে আলো ফেলে ইশারা দেওয়া হচ্ছে।

জলদস্যুরা জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। ইঞ্জিন বন্ধ করার পর জলদস্যুরা বলে, ‘ক্যাপ্টেন, কাম।’ এ সময় পাঁচটি স্পিডবোটে করে সব জলদস্যু অস্ত্রসহ জাহাজ থেকে নেমে যায়। সোমালিয়ার সময় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা ৮ মিনিটে অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল প্রথম প্রহরে জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়।

সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর বাড়তি নিরাপত্তায় এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে এভাবে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে
সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর বাড়তি নিরাপত্তায় এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে এভাবে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছেছবি: সংগৃহীত

আরও পড়ুন

মুক্তিপণ নিয়ে তীরে ওঠার পর আট জলদস্যু গ্রেপ্তার

মুক্তির আনন্দ

জলদস্যুরা নেমে যাওয়ার পর জাহাজটি ঘুরিয়ে সোমালিয়া উপকূল ত্যাগ করতে থাকি। নাবিকদের মনে তখন নতুন জীবন পাওয়ার স্বাদ। সবাই বাড়িতে স্বজনদের কাছে মুক্তির খবর জানাতে থাকেন।

রাতের বেলায় জাহাজ চলছে। দুই পাশে তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ। সকাল হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুদ্ধজাহাজ থেকে নৌবাহিনীর সদস্যরা আমাদের জাহাজে ওঠেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। নাবিকেরা মনের আনন্দে ছবি তুলতে থাকেন।

আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীতে থাকা চিকিৎসকেরা আমাদের সব নাবিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একজন নারী চিকিৎসক আমাকে বলেন, ‘সব নাবিক সুস্থ আছেন।’

এমভি আবদুল্লাহ এখন দুবাইমুখী
এমভি আবদুল্লাহ এখন দুবাইমুখীছবি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন নৌবাহিনীর  অপারেশন আটলান্টার এক্স পোস্ট থেকে

এত দ্রুত ছাড়া পাব কল্পনা করিনি

জলদস্যুদের হাত থেকে এত দ্রুত ছাড়া পাব, তা কখনো কল্পনা করিনি। কারণ, সোমালিয়ার উপকূল থেকে জিম্মি জাহাজের এক মাসের মধ্যে মুক্তি পাওয়ার ঘটনার নজির খুব একটা নেই।

জিম্মি করার পর অনেক দেশের মালিকপক্ষ জাহাজ পরিত্যক্ত করে চলে গেছে—এমন উদাহরণও আছে। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম, কেএসআরএম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শাহজাহান ও তাঁর সন্তানেরা যেভাবেই হোক, নাবিকদের জীবন রক্ষা করবেন।

জিম্মিদশার পর থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর সার্বক্ষণিক আমাদের জাহাজের অবস্থানের ওপর নজর রেখেছে। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সব সময় আমাদের পাশেই ছিল। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমাদের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী যেভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন, তা আমাদের জন্য বড় পাওয়া।

জাহাজ এখন যেখানে

গতকাল মঙ্গলবার রাতেও জাহাজটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। দুবাইমুখী জাহাজটির পাশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। আজ বুধবার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করা সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে ২২ এপ্রিল দুপুরের মধ্যে জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছাতে পারে বলে জানান ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।

prothom alo