এবারও নির্ধারিত দরে চামড়া বিক্রি হলো না

এবারও নির্ধারিত দরে চামড়া বিক্রি হলো না

কোরবানি হওয়া গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতিটি গতবারের তুলনায় ঢাকায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। তারপরও এবার নির্ধারিত দরের চেয়ে ২৭৫-৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে ছাগলের চামড়া কিনতে অনীহা দেখিয়েছেন আড়তদারেরা। একেকটি ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ টাকায়।

চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদুল আজহায় এক কোটির বেশি পশু কোরবানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঈদের দিন কাঁচা চামড়া আসার হারও সন্তোষজনক। এবার লবণের দাম কিছুটা কমলেও শ্রমিকের মজুরি ও গাড়িভাড়া বেড়েছে। কিছু চামড়া নষ্টও থাকে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে কিছুটা কমে কাঁচা চামড়া কিনতে হয়। অন্যদিকে গত কয়েক বছরের মতো এবারও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চামড়া বিক্রি করে ন্যায্য দাম পাননি তাঁরা।

৩ জুন চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানি পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। সেখানে গতকাল সোমবার বিকেলে বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বড় ও মাঝারি আকারের চামড়া ৭০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। হাজারীবাগ এলাকায়ও একই দরে চামড়া বিক্রি হতে দেখা যায়।

পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন, ‘চলতি বছর চামড়ার সরবরাহ ভালো। আমরা পোস্তার ব্যবসায়ীরা ১ লাখ ৬০ হাজার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছিলাম। আশা করছি, সেই পরিমাণ চামড়া কিনতে পারব।’

নির্ধারিত দরের চেয়ে কম দামে চামড়া কেনা হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে আফতাব খান বলেন, এমন সুযোগ নেই। কারণ, বাজারে আড়তদার, ব্যাপারী, ট্যানারি মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনছেন। অর্থাৎ প্রতিযোগিতা বেশি। ফলে একজন কম দাম বললে আরেকজনের কাছে যাওয়ার সুযোগ আছে। আর কাঁচা চামড়ার অন্তত ১০ শতাংশ নষ্ট হয়। কেনার সময় এটি সমন্বয় করা হয়।

ঢাকায় চামড়ার কেনাবেচা

রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে দুপুরের পর পোস্তায় কাঁচা চামড়া আসতে শুরু করে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিনিধিরা ট্রাক, ভ্যান ও রিকশায় করে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসেন। আড়তদারেরা সেই চামড়া দরদাম করে কিনছেন। কেনার পর আড়তে সেই চামড়ায় লবণ লাগাচ্ছেন শ্রমিকেরা।

সড়কের ওপর চেয়ার পেতে মো. তানজিদ নামে এক তরুণ চামড়া কিনছিলেন। বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত ৩০টি গরুর চামড়া কিনতে পেরেছেন। তানজিদ বলেন, বড় গরুর চামড়া প্রতিটি ৮০০-৯০০ টাকা, মাঝারি ৬০০-৭০০ টাকা এবং ছোট গরুর চামড়া ২০০-৩০০ টাকায় কিনছেন।

আড়তের সামনে বসে চামড়া কিনছিলেন শাহদাম অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক শাহদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। একেকটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ৩০০ টাকার বেশি খরচ পড়ে।

ঢাকার বাইরে দাম কমই

চট্টগ্রামে বড় আকারের কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায়। মাঝারি ও ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম ছিল ৪০০-৬০০ টাকা। অন্যদিকে রাজশাহীতে বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায়। তবে খাসির চামড়া ব্যবসায়ীরা কিনছেনই না। কেউ কেউ গরুর চামড়ার সঙ্গে টাকা ছাড়াই দিয়ে যাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ চার লাখ পর্যন্ত চামড়া সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, চামড়ার সংকট নেই। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। লবণ ছাড়া প্রতিটি চামড়া ৫০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

ছাগলের চামড়ায় আগ্রহ নেই

চলতি বছর খাসি ও বকরির দাম বাড়ানো হয়েছে। গত বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত খাসির চামড়ার দাম ছিল ১৮-২০ টাকা। এবার সেটি বাড়িয়ে ২০-২৫ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে বকরির চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি বেড়েছে ৬ টাকা। তবে বাস্তবে খাসি ও বকরির চামড়ার দাম এবার বাড়েনি।

পুরান ঢাকার পোস্তায় দিলীপ ঋষি নামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কয়েকটি খাসির চামড়া কিনে মাংস ছাড়াচ্ছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি চামড়া ১০ টাকা করে কিনেছেন।

চামড়ার দাম বাড়াতে করণীয়

রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্পকে দূষণমুক্ত পরিকল্পিত শিল্পনগরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। ২১ বছরেও এই চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় পাশের ধলেশ্বরী নদী দূষণের শিকার হচ্ছে।

চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়া বড় ক্রেতা বর্তমানে চীনারা। তারা কম দায় দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক মো. আবু ইউসুফ বলেন, দূষণ রোধ ও চামড়ার বাজার বৃদ্ধি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। এ জন্য সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here