এরই মধ্যে দেখেছি, বিএনপির নেতৃবৃন্দ আটক, কর্মীদের বড় অংশ আটক হয়েছেন এবং আরও মানুষ আটক হবেন। মনে রাখা দরকার, এটা যে কেবল বাংলাদেশের মানুষই দেখতে পাচ্ছে তা নয়। যেহেতু বাংলাদেশের ওপর বিশ্বের বহু মানুষের আগ্রহ ও নজর আছে, তারা যে শুধু সরকারি ভাষ্যই নেবে তা নয়। এটা ২০১৪ বা ২০১৮ সাল নয়। কেউ যদি ভাবেন এভাবে দমন-পীড়নের নীতি অনুসরণ করে আবারও বিতর্কিত কায়দায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যাবে, তবে তারা ভুল করবেন। মনে রাখা দরকার, নির্বাচনই শেষ কথা নয়। এখন থেকে তিন মাসের মধ্যে বিভিন্ন রকম পরিস্থিতি তৈরি করা হবে, যার ওপর সকলেই নজর রাখবে।
তাছাড়া নির্বাচন আগামীকালই অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। নির্বাচনের আরও তিন মাস বাকি। এই তিন মাসে সরকারের আচরণেই বোঝা যাবে তারা কতটা নিজেদের শক্তিশালী অনুভব করতে পারে। রাজপথের আধিপত্য এক জিনিস আর সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া আরেক জিনিস।
আমার ধারণা, আন্তর্জাতিকভাবেও যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা সরকারের জন্য এক ধরনের নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আমরা দেখেছি হামলা হয়েছে এবং একজন সাংবাদিক নিহতও হয়েছেন। সরকারের তরফে নাগরিকদের যে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, এসব ঘটনা তার অনুপস্থিতিই প্রমাণ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যেমন, ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয় লক্ষ্য করার মতো।
বিরোধী দলের জন্য প্রশ্ন হলো, তারা কীভাবে সমর্থক এবং নাগরিকদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে। সহিংসতার জন্য যেভাবে তাদের দায়ী করা হচ্ছে, তাদের জন্য তা খণ্ডন করা একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ আগের তুলনায় কম। ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে যেসব ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল না, সেসবেও তাদের দায়ী করা হয়েছিল। এবারে তেমনটা বিশ্বাস করানো কঠিন। কর্মীদের ওপর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটাও একটা দিক। বিরোধী দলের কাজ হলো, তাদের জনসংশ্লিষ্টতা বাড়ানো। সেটা তাদের রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে তারা কীভাবে জনসম্পৃক্ততা বাড়াবে তা তাদেরই ভেবে বের করতে হবে।
এখন যে পরিস্থিতি তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সরকার নির্বাচন পর্যন্ত দেশটাকে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চাইবে। কিন্তু এভাবে একটা যেনতেন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে না।
পল্টনের ঘটনায় সাময়িকভাবে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ চায় না সহিংসতার মধ্য দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধান আসুক। সেজন্য সহিংস পথের সমাধান তারা যে গ্রহণ করবে তা নয়। দেশের বাইরেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির প্রশ্নে সরকারি প্রচারণাই একমাত্র বিষয় নয়। বিভিন্নভাবেই তথ্যের সরবরাহ আছে এবং লোকজন সবই বুঝতে পারে। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল মনে করে এভাবেই তারা সমাধান করতে পারবে– আমার তা মনে হয় না।
সহিংসতা কীভাবে শুরু হয়েছে তার পরিষ্কার ব্যাখ্যা ও বিহিত আমরা এখনই হয়তো পাব না। তবে ২৮ তারিখ থেকে কে কেমন আচরণ করছে এবং প্রকৃতপক্ষে আর কোনো সমঝোতার সুযোগ আছে কিনা– এখন সেটাই বরং খতিয়ে দেখা হবে।
শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বলছিল যেসব দেশ, তারা এই মুহূর্তে একেবারে নীরব হয়ে যাবে তা নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য আমলে নিয়ে তারাও জানত যে, সহিংসতা অনিবার্য। তারা নিশ্চয় বুদ্বুদের ভেতর বাস করে না। কিন্তু সহিংসতা কখন করবে, কে শুরু করবে, কোন পর্যায়ে গিয়ে হবে এবং বিরোধীরা কী করবে– সেসব নিয়ে তাদের কাছে একরকম ধারণা ছিল বলেই অনুমান করি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে তারা ভূমিকা রাখবে। কখনও কখনও দুটি সংঘাতমান শক্তিকে আরও সংঘাতে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয়। আবারও বলা দরকার, এটা ২০১৪ বা ২০১৮ সাল নয়। তা যদি হতো এ সময়ে এত প্রত্যক্ষ আন্তর্জাতিক তৎপরতা আমরা দেখতাম না।
বিভিন্ন রকম দমন-পীড়ন সত্ত্বেও সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য সরকার চাইলে এখনও সময় আছে। আমি সেই সম্ভাবনা কম দেখি কিন্তু সে পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়নি।
অন্যদিকে, বিরোধী দলকে মানুষের কাছেই যেতে হবে। আন্তর্জাতিক সমাজের কাছেও তাদের বোঝাতে হবে, কী পরিস্থিতিতে তারা হরতাল-অবরোধে যাচ্ছে। সরকারকেও বোঝাতে হবে কেন তারা দমনের পথ বেছে নিল।
এদিকে বহুদিন পর বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে। হরতাল আহ্বানের পরে কার্যত রাজপথে বিরোধী দলের তেমন উপস্থিতি ছিল না। এর পরও বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা প্রশ্ন জাগায়। যেখানে বিরোধী দলের মিছিল-সমাবেশ নেই, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারছে– সেটা মানুষেরও বুঝতে পারার কথা। বাংলাদেশের মানুষ গতকালের ঘটনায় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা সরকারের অনুকূলে নয়। এটা আমি, আপনি এবং অন্য যারা বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করে; তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে। সরকারের তরফে যেভাবে বিএনপিসহ সব বিরোধীদের সহিংস হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা রাজনীতির জায়গা থেকে বিশ্বের কাছে আমাদের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।
এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে জারি আছে। এ ধরনের শাসনের কাছে হঠাৎ করে শুভবুদ্ধির আশা করা ভুল হবে। এর পরও নিজেদের এবং দেশের স্বার্থে তাদের কর্মপন্থা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কারণ, জনসমাজ এবং দেশের বাইরের কূটনীতিকরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। দুই বছর ধরে পর্যবেক্ষণ ও আলাপ-আলোচনা-সফরের পর, বিশেষ করে রাজনীতিতে সহিংসতা দেখার পর বাইরের শক্তিগুলো তিন পা পিছিয়ে যাবে– সেটা ভাবার পক্ষে যুক্তি নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং অন্যান্য দুর্বলতা বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশ মিয়ানমার বা কম্বোডিয়া নয়। এই দেশ দুটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে রয়েছে চীন। কম্বোডিয়া বা মিয়ানমার চাপ ও নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করেছে। কারণ, সেখানে চাপ সেভাবে কাজ করেনি। পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সম্পর্ক অতটা নির্ভরশীলতার ছিল না। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যে সম্পর্ক ও বাণিজ্য– সেখানে কেবল একটি-দুটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর বাজি ধরে বসে থাকলে দেশের অর্থনীতি এবং অন্যসব জায়গায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে।
শেষ কথা, বাংলাদেশের ভাগ্য বাংলাদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, দেশের মানুষকে সেই ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হবে কি হবে না?