এটাই এখন বাংলাদেশের গণমানুষের লড়াই। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই সরাসরি দিল্লীর ‘হিন্দুত্ববাদী’ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

ফরহাদ মজহার   1 January 2022

সমাজ ও ইতিহাস সচেতন হতে চাওয়া এবং হতে পারা কঠিন। যারা আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিকে নানান ভাবে প্রভাবিত এবং দিক নির্ণয়ের দিশা জোগাবে, তাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে নিজেদের সচেতন ও সজ্ঞান করে তোলা। নিজেরা সচেতন হলে সেই চেতনা অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হবে। সেটা দ্রুত সম্ভব যখন আমরা মাঠের লড়াইয়ে থাকি এবং সুনির্দিষ্ট লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে শক্তিশালী জ্ঞানচর্চার ধারা গড়ে তুলি। আমার মনে হয় বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটি অংশ এ ব্যাপারে আগের চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহী।

তরুণদের কাছ থেকে ভালবাসা পেতে ভাল লাগে। তখন ভাবি কিছুটা ভাল কাজ হয়তো করেছি। আজ বাংলাদেশ্ ছাত্র অধিকার পরিষদের পত্রিকা ‘মুক্তি’  প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয়  সংখ্যা হাতে নিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের তরুণ নেতাকর্মীরা এলেন। অভিনন্দন।

সম্প্রতিকালে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটেছে। আমার ধারণা বাংলাদেশে আগামি দিনের রাজনীতির সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য ঘটনা দুটো মাইল ফলকের কাজ করবে।

প্রথমটি হচ্ছে আবরার হত্যার প্রতিবাদে তরুণদের ‘আট স্তম্ভ’ গড়ে তোলা। যথারীতি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পাহারাদার পুলিশ তা ভেঙে দিয়েছে। সেটা বাহ্যিক, কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অন্তরে তা পৌঁছে যাবে ইনশাল্লাহ।

কেন?

কারন সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছে, এটাই এখন বাংলাদেশের গণমানুষের লড়াই। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই সরাসরি দিল্লীর ‘হিন্দুত্ববাদী’ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কারন বাংলাদেশের বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা দিল্লীর প্রত্যক্ষ মদদে ও সমর্থনেই টিকে রয়েছে।

কিন্তু হিন্দুত্ববাদ এবং দিল্লির আগ্রাসন বিরোধী লড়াই কোন ভাবেই ‘হিন্দু’ কিম্বা কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র জাতি সত্তার বিরুদ্ধে নয়। একদমই নয়। ভারতের জনগনের বিরুদ্ধেও নয়। বরং বাংলাদেশে দিল্লির আগ্রাসন বিরোধী লড়াই ভারতের হিন্দুত্ববাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে অভিন্ন। এ লড়াই সুনির্দিষ্ট ভাবে উপমহাদেশে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার লড়াই। ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তোলার ওপর এই লড়াইয়ে বিজয় নির্ভরশীল।

এই প্রথম উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদ বিরোধী লড়াই কেন্দ্র করে  কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে উপমহাদেশে জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যবোধ গড়ে তোলার চেতনা বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে।  ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উপমহাদেশ ব্যাপী জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে ক্ষেত্র তৈরির শর্ত তৈরি হতে চলেছে।

এই লড়াইয়ের অব্যবহিত ক্ষেত্র দক্ষিণ এশিয়া হলেও এ লড়াই একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক। কারণ ‘হিন্দুত্ববাদ’ মোটেও হিন্দুর ব্যাপার না, কিম্বা  স্রেফ উপমহাদেশীয় ফেনোমেনাও নয়। হিন্দুত্ববাদ একান্তই আধুনিক জাতিবাদের চরম একটি রূপ মাত্র।  হিন্দুত্ববাদ একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক এবং সেকুলার। হিন্দুত্ববাদ নিজেকে  সাম্প্রায়িক বলে না, বরং নিজেদের সেকুলার দাবি করে। জাতিবাদ বলে না। হিন্দুত্ববাদ আসলেই একটি সেকুলার বর্গ। এর সঙ্গে যুক্ত ইহুদিবাদ (Zionism), মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং আন্তর্জাতিক পুঁজি।

এই লড়াইয়ের মর্ম স্পষ্ট হবার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের জনগণ বুঝবে একালে প্রাচীন ওয়েস্টফিলিয়ান সার্বভৌমত্বের ধারণা বিতর্কিত, এর উপযোগিতা নির্ণয় তর্কাধীন। অতএব আমাদের নতুন ভাবে গণ-সার্বভৌম ক্ষমতা বা ‘গণশক্তি’র ধারণাকে ভৌগলিক ও ভূরাজনৈতিক ধারণা হিশাবে নির্মাণ করতে হবে। প্রতিটি উপমহাদেশের বিভিন্ন স্বাধীনচেতা জনগোষ্ঠির মধ্যে কিভাবে নতুন ভাবে আমরা রাজনৈতিক ঐক্য নির্মাণ করতে পারি সেই সকল দিক নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

পৃথিবী বদলে গিয়েছে, আমাদেরকেও বদলাতে হবে। আগামি দিনের রাজনীতিতে মফস্বলী সংকীর্ণ চিন্তার কোন স্থান নাই। যদি বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের টিকে থাকতে হয়, তাহলে আমাদেরকেও বৈশ্বিক হতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতির দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরুদ্ধে মোদিবিরোধী লড়াই। ‘মোদিবিরোধী’ আন্দোলনের একটি ঘটনাক্রম ‘মুক্তি’ পত্রিকায় রয়েছে। আরও বিস্তারিত থাকলে আরও ভালো থাকত।

মোদি বিরোধী লড়াইয়ের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে মাঠের লড়াইয়ে ধর্ম এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার বাইনারি ভেঙে গিয়েছে। বাঙালি জাতিবাদিরা দিল্লির সমর্থনে এদেশে ইসলামবিদ্বেষী ও ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি যেভাবে জারি রেখে আসছিল, তার অবসানের চিহ্নগুলো ফুটে উঠছে। আগামি দিনের লড়াই সুস্পষ্ট ভাবে ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই হিশাবে গড়ে উঠবে।

‘মুক্তি’র প্রথম সংখ্যায় ‘দিল্লির আগ্রাসন বিরোধী রাজনীতি এবং ‘আটস্তম্ভ’  নিয়ে লেখাটিতে আমি আরো কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করেছি।পড়লে খুশি হব।