এম সিরাজুল ইসলাম :
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ‘উটপাখির’ মতো ধারণা নিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। উটপাখি যেমন বালির নিচে মাথা লুকিয়ে রাখে ঠিক তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার আইনের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। এর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে জানতে কোনো ক্রিস্টাল বলের প্রয়োজন নেই, প্রবাদই যথেষ্ট। পরিহাসের বিষয় হলো প্রবাদের উটপাখি পরিণতি সম্পর্কে অবগত ছিল না। হাবিবুল আউয়ালও তাই। তিনি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে একাধিকবার বলেছেন যে, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ নেই।
দুর্ভাগ্যবশত তার দুই পূর্বসূরির সামনে যে সুযোগ ছিল হাবিবুল আউয়ালের সেই সুযোগ নেই। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পশ্চিমে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এই শক্তিগুলো এবং জাতিসংঘ, ভারতের সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার কারণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে ক্ষমতা লাভ থেকে বিরত রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল।
নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিবেশে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাবিবুল আউয়াল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক এজেন্ডা হিসেবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে সামনে রাখছে। এগুলো তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ভিত্তি যার সঙ্গে এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩৬টি দেশ বা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেককে একীভূত করার চেষ্টা চলছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বাইডেন প্রশাসন এই অঞ্চলে চীনা সম্প্রসারণ রোধ করতে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল তৈরি করছে।
বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পরিচালনার মূল উপাদান হিসেবে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে অনুসরণ করেছে। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কার্যভার গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশে এত উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল কখনো পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো এতটা জড়িত ছিলেন না। পিটার হাস্ জড়িয়ে পড়েছেন। রাষ্ট্রদূত হাসের আগ্রহ ও উদ্যোগকে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাগত জানায়নি। পরিবর্তে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসকে বাধা দেয়ার এবং ওয়াশিংটনে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই প্রচেষ্টাগুলো খুব খারাপভাবে ব্যর্থ হয় এবং ক্ষুব্ধ করে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি মার্কিন আগ্রহ আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল, তারা জানতো এই ধরনের একটি নির্বাচন তাদের কাছে নেমেসিসের মতো, কারণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কাছে তারা অনায়াসেই পরাজিত হবে।
মার্কিন দূতাবাস সতর্কতার সঙ্গে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েকদিন আগে তারা শেষ প্রচেষ্টা করে। অচলাবস্থা নিরসনের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু’র পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্ আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকে একটি যৌথ চিঠিতে তিন দলকে নিঃশর্ত সংলাপে বসার আহ্বান জানায়। যদিও তা অমীমাংসিত থেকে যায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জাতীয় পার্টি ইতিবাচক সাড়া দিলেও আওয়ামী লীগ নীরব ছিল। সংলাপ বিবেচনা না করেই সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হওয়ার পর রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে তার কার্যালয়ে প্রতিক্রিয়ার জন্য ডেকেছিলেন। ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে’ বলে মার্কিন উদ্যোগকে নাকচ করে দেন সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সরকার এইভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন উদ্যোগকে ঠেকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর এত বেশি নির্ভরশীল কোনো দেশ ওয়াশিংটনের সঙ্গে এই শাসনব্যবস্থার মতো নৈমিত্তিক আচরণ করেছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। এই ভাবে শাসকদল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মাথায় না রেখে নিজের পায়ে নিজে গুলি করেছে, কারণ অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তার মতপার্থক্য নিরসনের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার প্রত্যাশী একটি দেশের সঙ্গে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির এটি একটি অযৌক্তিক অসম দ্বন্দ্ব। এই ধরনের অসম সংঘাতের পরিণতি আলোচনার বিষয়ও হওয়া উচিত নয়।
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাংলাদেশকে এমন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছেন যা তার পূর্বসূরিরা করেননি। গত ১৪ বছরে জনগণ ‘ভোট’ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের অর্থনৈতিক ভাগ্য তীব্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৭১ সালে জনগণ যে অধিকারের জন্য লড়াই করেছিল তারা এখন সেই একই অধিকারের জন্য লড়াই করতে বদ্ধপরিকর। বিগত দুটি নির্বাচনে শাসকদল বলে এসেছে যে, তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, অগ্নিসংযোগকারী, সন্ত্রাসবাদী, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে, কিন্তু সে কথাগুলো এখন বাসি হয়ে গেছে। বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমে তথ্যের সহজলভ্যতার কারণে বিরোধীদের বিরুদ্ধে তোলা এই অভিযোগ এখন মূল্যহীন। সত্য এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধ।
নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকরা। তাদের অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে এবং তারা এখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে একটি শাসন পরিবর্তনকে সমর্থন করে। সেই সঙ্গে প্রধান বিদেশি শক্তির সঙ্গে তাদের ১৫ বছরের দুঃস্বপ্নের অবসানের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি । তাই এটা ভাবা ভুল হবে যে, এই লোকেরা আওয়ামী লীগকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ফিরে আসতে দেবে, সেটি ঘটার সম্ভাবনাও কম। কারণ ক্ষমতায় আসার পর থেকে শাসক ও তার ক্যাডাররা বিরোধীদের তাদের ঘরে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
এদিকে, শাসক এবং বাংলাদেশের বিদেশি স্টেকহোল্ডারদের জন্য চিন্তার আরেকটি বিষয় রয়েছে। চীন এখন চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপজ্জনক অচলাবস্থার অবসান হোক। একটি অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচনের জন্য চীনের অবস্থান নাটকীয়, কিন্তু বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে সমর্থন করার জন্য নয়াদিল্লিতে ভারত-মার্কিন ২+২ বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিতে ভারতের অস্বীকৃতির কারণে এটি ঘটেছে। নয়াদিল্লিতে এই আলোচনার ফলাফল বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বিরোধী শিবিরে হতাশার জন্ম দেয়। যদিও, এবার ভারতও ২০১৪ সালের মতো আওয়ামী লীগকে সরাসরি সমর্থন করে তার হৃদয়কে খুশি করেনি। এর আগে সুজাতা সিং-এর উদ্যোগের কথা এখনো সকল বাংলাদেশির মনে তাজা। ভারত সম্ভবত বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন যেকোনো উপায়ে ঘটবে এবং তাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিতে চায়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পক্ষ না নেয়ার জন্য উদ্বিগ্ন ছিল। তারা অপেক্ষা করেছিল যে, আওয়ামী লীগ একটি নিঃশর্ত সংলাপের জন্য হয়তো সাড়া দেবে। কিন্তু সেটি ব্যর্থ হলেও আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি বিশ্বাস করে যে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিম এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে শাসনের পরিবর্তন আসবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে নিজের বোর্ডে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় চীন সেখান থেকে সুযোগ খুঁজছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের জন্য একটি মার্কিন-ভারত চুক্তি উভয়ের স্বার্থে হতো যদি এই অঞ্চলে চীনকে ঠেকানো তাদের মূল উদ্দেশ্য হতো।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত
মানব জমিন