জিয়া শাহীন ও নূরে আলম জিকু, বরিশাল থেকে
৬ নভেম্বর ২০২২, রবিবার
ছবি: জীবন আহমেদ
এ এক নতুন দৃশ্যপট। তিন ঘণ্টার সমাবেশ। তিন দিন আগে থেকেই নেতাকর্মীদের অবস্থান। চাল, চুলা সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটি সমাবেশের অংশ হওয়ার মরিয়া চেষ্টা। বাসের সঙ্গে তিন চাকার যানও বন্ধ। বন্ধ লঞ্চ, স্পিড বোটসহ সব নৌযান। সড়ক পথের অন্য বিকল্প যানের ওপর কড়া নজর। এত কিছুর পরও গতকাল বরিশালে এক নয়া নজির তৈরি করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে নানা কৌশলে বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করে ঘরে ফিরেছেন তারা। এই সমাবেশ থেকে নয়া এক বার্তাও পৌঁছে গেছে দেশের রাজনীতিতে।
নয়া এক ট্রাম্প কার্ড হাজির হয়েছে রাজনীতির ময়দানে। বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যান সাক্ষী হয়েছে নতুন ধরনের এক রাজনৈতিক কর্মসূচির।
আদতে দৃশ্যপট হওয়ার কথা ছিল এমন। বেলা দুইটায় শুরু হওয়া সমাবেশ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ৫টার মধ্যে। এই সমাবেশে অংশ নিতে হয়তো ওই দিন সকালে বিভিন্ন জেলা থেকে রওনা দিতেন নেতাকর্মীরা। দুপুরে এসে সমাবেশে যোগ দিয়ে বিকালে ফিরে যেতেন যার যার এলাকায়।
কিন্তু বিএনপি’র তিন ঘণ্টার এই সমাবেশ তিন দিনে রূপ নেয় শুধুমাত্র ‘সরকারি’ বাধার কারণে। এই বাধার কারণে মরিয়া মনোভাব তৈরি হয় নেতাকর্মীদের মাঝে। যে করেই হোক সমাবেশে অংশ নেবেন এমন ইচ্ছা নিয়ে দুই বা তিন দিন আগেই ঘর ছাড়েন তারা। হেঁটে, ছোট নৌকা বা ভ্যানে করে তারা ছুটে আসেন জেলা থেকে বিভাগীয় শহরে। অবস্থান নেন বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। সেখানে দুই রাতও কাটিয়েছেন অনেকে। রান্নাবান্না হয়েছে উদ্যানে। রান্নার উপকরণও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন নেতাকর্মীরা। চুলা, লাকড়ি আনতেও ভুল করেননি। কেউ কেউ দুই দিনের জন্য শুকনা খাবার এবং পানি সঙ্গে নিয়ে হাজির হন।
শনিবার দুপুরে সমাবেশ। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ভেসে উঠে বরিশালবাসীর সামনে। দলে দলে আসা লোকজন ঠাঁই নেন খোলা মাঠে। মাথার উপরে সামিয়ানা টানিয়ে কেউ কেউ রাত যাপন করেছেন মাঠেই। কেউ হোটেলে, কেউ লঞ্চঘাটে রাত কাটান। সমাবেশের আগের দিন শুক্রবার থেকেই কার্যত বরিশাল নগরী বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলে চলে যায়। সমাবেশ ঘিরে বন্ধ রাখা হয় অনেক দোকানপাট। শহরের অভ্যন্তরে চলাচল করে এমন ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বৃহস্পতিবার থেকে। তাই দলে দলে বিএনপি নেতাকর্মীরা নগরজুড়ে ছুটে বেড়ান পায়ে হেঁটে। শনিবার ভোর থেকে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে ঢল নামে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের। একের এর এক আসতে থাকে মিছিল। দুপুরে সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও সকালেই পূর্ণ হয়ে যায় উদ্যান। নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সড়কে।
বিরোধী দলের সমাবেশে বিঘ্ন ঘটাতে পরিবহন বন্ধ করে দেয়ার খেলা একেবারে নতুন নয়। এর আগেও এমনটি হয়েছে। কিন্তু বরিশালের সমাবেশ ঘিরে এই বাধা ছিল সর্বমুখী। এই সমাবেশে আসতে সীমাহীন বাধা পেরুতে হয়েছে নেতাকর্মীদের।
আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়ায় সমাবেশে অংশ নিতে তাদের বেছে নিতে হয়েছে নানা কৌশল। ভোলা, পটুয়াখালীসহ আশপাশের জেলা থেকে নদী পথে ছোট ছোট নৌকায় করে অনেকে সমাবেশে হাজির হন। ভেঙে ভেঙে হেঁটে, রিকশা, ভ্যানে করে কেউ কেউ বরিশাল পর্যন্ত আসেন। এমন কী নদী সাঁতরেও সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে মানুষকে। দুই দিন আগেই সমাবেশ মাঠে অবস্থান নেয়া নেতাকর্মীরা বলছিলেন, সরকার বাধা দেবে এটি পুরনো কৌশল। এই কৌশলকে পরাজিত করে সমাবেশ সফল করতে তারা বিকল্প পরিকল্পনা নেন। এক দিন নয়, দুই দিন আগেই সমাবেশে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বরিশালে এসে খাবার পাওয়া যাবে না। পানি পাওয়া যাবে না এমনটিও ধরে নিয়েছিলেন তারা। তাই ভ্যানে করে চাল, ডাল, তেল, চুলা, লাকড়িও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তাই তাদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। দুই দিন দুই রাত সমাবেশ মাঠে কাটিয়ে শনিবার নেতাদের বক্তব্য শোনে ফিরে গেছেন নিজ নিজ এলাকায়। মানবজমিনের পক্ষ থেকে মাঠে অবস্থান করা অনেকের কাছে প্রশ্ন ছিল খাবার-দাবারের আয়োজন হলো কীভাবে। নেতাকর্মীরা বলছিলেন নিজেরা চাঁদা তুলে এই আয়োজন করেছেন। অবশ্য স্থানীয় অনেক নেতাকেও কর্মীদের খাবার দাবারের তদারকি করতে দেখা গেছে।
বিএনপি’র সমাবেশ বানচাল করতে সর্বমুখী চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। বরং দ্বিগুণ মনোবল নিয়ে ছুঠে আসেন নেতাকর্মীরা। বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে বরিশালে পা রাখার পর তাদের অনেকের মধ্যে ছিল রাজ্য জয়ে আনন্দ। রাজনীতির পুরনো কৌশল বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবলের কাছে হার মেনেছে বরিশালে। বড় সমাবেশ করে চাঙ্গা নেতাকর্মীরা। বরিশালের এই সমাবেশ ঘিরে নানা শঙ্কা ছিল আগে থেকেই। বরিশালের একজন নেতা চাইলে সমাবেশ সাফা হয়ে যাবে- এমন কথাও বলা হচ্ছিল আগে থেকেই। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন সমাবেশ ঘিরে সংঘাত হতে পারে। কিন্তু ওই অর্থে তেমন কিছু ঘটেনি। ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের গাড়িবহরে হামলা হয়েছে ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে। আরও কিছু জায়গায় হামলার অভিযোগ করা হয়েছে। এর বাইরে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে সমাবেশ।
বিএনপি’র বিভাগীয় এই গণসমাবেশ ঘিরে সাধারণ মানুষের কষ্ট আর দুর্ভোগের মাত্রা ছিল সীমাহীন। দুই দিন বিভাগীয় শহর কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জেলার মানুষের তীব্র ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অতিরিক্ত পেরেশানিতে থাকতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও। অনেক অযৌক্তিক ধাঁচের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে কর্মহীন সময় কেটেছে কয়েক হাজার পরিবহন শ্রমিকের।
বেশি বাধা, বড় সমাগম: প্রায় এক যুগ পর বরিশালে বিভাগীয় সমাবেশ করেছে বিএনপি। এই সমাবেশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার কমতি ছিল না। সমাবেশকে সামনে রেখে এক সপ্তাহ আগে গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা আসে। ঘোষণা আসে লঞ্চ চলাচল বন্ধেরও। কেমন হবে বরিশালে বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশ। এমন প্রশ্ন ছিল মানুষের মুখে মুখে। ছিল নানা আশঙ্কা। নেতাকর্মীরাও ছিলেন আতঙ্কে। গত কয়েকদিনে বরিশাল নগরীর পরিস্থিতি ছিল থমথমে। অবশেষে নির্ধারিত সমাবেশ করেছে বিএনপি। হাজার হাজার মানুষ সেই সমাবেশে সমবেত হয়েছেন। কানায় কানায় পূর্ণ ছিল সমাবেশস্থল বঙ্গবন্ধু উদ্যান। নগরীর অলিগলিও ছিল নেতাকর্মীদের দখলে। মাঠে জায়গা না পেয়ে সড়কে, ফুটপাথে, লঞ্চ টার্মিনালে, নদীর ধারে, বাসাবাড়ির ছাদে বসে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শুনছেন সমাবেশের উদ্দেশ্যে আসা মানুষ। স্লোগান স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো বরিশাল নগরী। বিএনপি’র নেতারা ও স্থানীয়রা বলছেন, শনিবার অনুষ্ঠিত বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইতিপূর্বে বরিশালের ইতিহাসে এত বড় সমাগম দেখেনি বরিশালবাসী। সমাবেশ ঘিরে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও তার পার্শ্ববতী এলাকা। এমনকি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সামনে বসেও মাইকে বক্তব্য শুনছেন তারা। বিএনপি’র নেতাকর্মীরা বলছেন-চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের চেয়ে বেশি বাধা পড়েছে বরিশাল সমাবেশে। এজন্যই মানুষ ফুঁসে উঠেছেন। সরকারদলীয় লোকজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা বাধা উপেক্ষা করে তারা বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। পথে বাধা, হামলা ও ধর্মঘট না দিলে এত বড় সমাগম হতো না। সমাবেশে বাধা না আসলে শনিবার একদিনই সমাবেশ হতো। এখন সমাবেশ ৩ দিন হয়েছে।
সমাবেশের উদ্দেশ্যে ট্রলারে ট্রলারে মানুষের ঢল: গণপরিবহন ও বাস বন্ধ থাকায় বিকল্প উপায়ে নদী পথে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার মানুষ। সমাবেশের ১/২ দিন আগে আসলেও অনেকেই সমাবেশের দিন সকালে ট্রলারে করে বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। গতকাল ভোর থেকেই সারি সারি ট্রলার কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে এস ভিড়ে। মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও সুগন্ধাসহ অসংখ্য নদী ও খাল পেরিয়ে বরিশালে আসেন তারা। এর মধ্যে ভোলা জেলার মনপুরা, চরফ্যাশন, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, ভোলা সদর, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখান থেকে কয়েক হাজার ট্রলার আসে কীর্তনখোলায়। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী, কাজিরহাট, হিজলা, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, বরগুনার, পাথরঘাটা, আমতলী, তালতলী, বামনা, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, ইন্দুরকানি (জিয়ানগর), কাউখালী, স্বরূপকাঠি, ভা-ারিয়া, মঠবাড়িয়া ও নেছারাবাদ; ঝালকাঠি জেলার সদর, রাজাপুর, কাঠালিয়া ও আমুয়া; পটুয়াখালীর সদর, বাউফল, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দুমকি ও কলাপাড়ার নেতাকর্মীরা মাছ ধরার হাজারো ট্রলার নিয়ে বরিশালে আসেন। সকাল থেকে বরিশাল নগরীর পলাশপুর থেকে ৩০ গোডাউন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজারের অধিক ট্রলার কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে ঘাট করে রাখা হয়। সেখান থেকে কেউ প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে সমাবেশস্থলে মিছিল নিয়ে আসেন তারা। কেউ কেউ ট্রলারে অবস্থান করেন। একই ভাবে সমাবেশে যোগ দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রলার ও বালুবাহী জাহাজ-বাল্কহেড শুক্রবার মধ্যরাতেও নগরীতে প্রবেশ করেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের।
বরিশালের কাজীর হাট থানার বিদ্যানন্দনপুর ইউনিয়ন থেকে ট্রলারযোগে সমাবেশে এসেছেন রিমন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা হুমকি দিয়েছে, যাতে সমাবেশে না আসি। আওয়ামী লীগের নেতারা যেকোনো মূল্যে আমাদের বাধা দেবে, আসতে দেবে না- এ জন্য ভোর ৪টায় রওনা দিয়েছি। একই ইউনিয়ন থেকে ৭টি ট্রলারে মোট আড়াইশ’ নেতাকর্মী সমাবেশে এসেছে বলে জানান তিনি। মেহেন্দীগঞ্জ থেকে আসা যুবদলের কর্মী মো. উজ্জল বলেন, আমাদের অনেক হুমকি দেয়া হয়েছে, কিন্তু এসব বাধা হুমকি উপেক্ষা করে বিএনপি’র সমাবেশে এসেছি।
কীর্তনখোলা নদীতে রাত্রি যাপন: এদিকে গণপরিবহন ও যাত্রীবাহী লঞ্চ বন্ধ থাকায় নির্ধারিত দিনের আগেই বরিশালে বিএনপি’র সমাবেশস্থলে আসেন বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ। নদীপথে আসা বেশির ভাগ নেতাকর্মী কীর্তনখোলা নদীতে রাত যাপন করেন। লঞ্চেই সেরেছেন তাদের খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম-বিশ্রাম। গতকাল সকালে নগরীর বন্দর ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-ভোলা রুটের ‘এমভি ভোলা’ নামের বিশালাকৃতির লঞ্চে বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মী অবস্থান করেন। আবুল কালাম নামের একজন বলেন, বরিশালে আসার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ জন্য ভোলা জেলার বিএনপি’র সভাপতি গোলাম নবী আলমগীরের লঞ্চ আমরা রিজার্ভ করে এসেছি। প্রায় ৪ হাজার নেতাকর্মী এই লঞ্চে ঠাসাঠাসি করে এসেছে।
কয়েকজন বলেন, লঞ্চ থেকে সমাবেশস্থল খুব কাছে। আগে চলে আসায় আমরা লঞ্চেই রাতযাপন করছি। সমাবেশ শুরু হলে মাঠে আসি। যত কষ্টই হোক, আওয়ামী সরকারকে না হটানো পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন থামবে না। চরফ্যাশন উপজেলা বিএনপি’র নেতা কাজী মনজুর হোসেন জানান, তিন দিন আগে থেকেই চরফ্যাশন উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বরিশালে এসে পৌঁছেছেন।
বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে অংশে নিতে আসা নেতাকর্মীরা সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। গতকাল সব চেয়ে বেশি হামলা হয়েছে বরিশালের গৌরনদীতে। এদিন সকালে বিএনপি নেতা ইশরাকের গাড়িবহরে হামলা করে সরকারদলীয় বাহিনী। এর কিছুক্ষণ পর গৌরনদীর একই স্থানে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহ-সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুলের গাড়িবহর ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেত্রী সেলিনা সুলতানা নিশিতাকে বহনকারী গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
গৌরনদী প্রতিনিধি এম আলম জানান, সমাবেশের দিন বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দফায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। গৌরনদীর মাহিলাড়া বাজারের কাছে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে। এতে গাড়িবহরে থাকা বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিএনপি’র নেতারা জানান, ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু ও ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুলের গাড়িতে ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য জাহিদুল ইসলাম রনি। এ হামলা ও বাধার সময় ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজুসহ নেতারা তাদের পেশাগত পরিচয়পত্র দেখানোর পরও দুর্বৃত্তরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তাদের মারতে উদ্যত হন। এক পর্যায়ে তারা গাড়িবহর ঘুরিয়ে দেন। এ ছাড়া শামীম রাব্বি সঞ্চয়ের বহনকারী গাড়িতেও হামলা করে দুর্বৃত্তরা। ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেত্রী সেলিনা সুলতানা নিশিতা, রওনক জাহান শাহীন, কোহিনুর ফারজানা আরজুর বহনকারী গাড়িতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও লোহার রড দিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় গাড়িতে থাকা তিন জনই আহত হন। পাশাপাশি অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করেন হামলাকারীরা। পরে ঢাকার দিকে ফিরে যান তারা।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় পটুয়াখালী থেকে বরিশালে বিএনপি’র গণসমাবেশে আসার পথে সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান খানের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা আরও ৫ জন আহত হয়েছেন। জেলার গাবুয়া এলাকা অতিক্রমকালে এ হামলার ঘটনা ঘটে। জেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শিপলু খান বলেন, রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড ও সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করছে সরকার। শুক্রবার সন্ধ্যার পরে শাহজাহান খান বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে বরিশাল যাওয়ার পথে পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কের গাবুয়া এলাকায় অতিক্রমকালে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না–ফখরুল: সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, রাজনীতিকে ধ্বংস করেছে। আজকে ১৪ বছর ধরে এদেশের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের চরিত্রের মধ্যে দু’টি জিনিস আছে; একটা হচ্ছে চুরি, আরেকটা সন্ত্রাস। সন্ত্রাস করবে আর চুরি করবে। তারা ২০১৪ সালে ভোট চুরি করেছে, ২০১৮ সালে ভোট চুরি করেছে। এখন আবার ভোট চুরির নতুন নির্বাচন দিয়ে কোনো রকমে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের কথা পরিষ্কার- শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।
ফখরুল বলেন, এই বরিশালের যত উন্নয়ন হয়েছে সবই হয়েছে বিএনপি আমলে। বেগম খালেদা জিয়া বরিশালবাসীকে বিভাগ দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছেন। অথচ এই সরকার দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। বাজারে যাওয়া যাচ্ছে না। সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর থেকে আমরা মুক্তি চাই। জাতি মুক্তি চায়। জাতিকে মুক্ত করতে হবে এই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। আওয়ামী লীগের আমলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় আর বিএনপি’র আমলে দেশে শুধু উন্নয়ন হয়। তবে বিএনপি’র চলমান আন্দোলন জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষার জন্য।
মহাসচিব বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকার খুব ঢাকঢোল পিটিয়েছে। এমন ঢাকঢোল পিটিয়েছে, যেন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। সেই বিদ্যুৎ আর নেই। আজকে সকালে আমি যে হোটেলে ছিলাম সেখানে কমপক্ষে ১০ বার বিদ্যুৎ গেল আর এল। এর আগে ৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় ছিল, বিদ্যুৎ গেলে সবাই বলতো এই হাসিনা গেল, বিদ্যুৎ আসলে বলতো এই হাসিনা এল। আজকেও একই অবস্থা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখন আর কোনো বিবাদ নয়, ঝগড়াঝাটি নয়, জাতির প্রয়োজনে সকলে ঐক্যবদ্ধ হই। এই আন্দোলন শুধু বিএনপি’র নয়, এই আন্দোলন খালেদা জিয়ার নয়, এই আন্দোলন শুধু তারেক রহমানের জন্য নয়, এই আন্দোলন সমস্ত জাতির, এই আন্দোলন আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, এটা পরিষ্কার কথা। আপনাকে (শেখ হাসিনা) পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে এবং সেই কমিশনের অধীনে ভোটের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, আমরা মুক্তি চাই, এদেশের মানুষ আর কোনো কথা শুনতে চায় না। ফয়সালা হবে রাজপথে। এই রাজপথে ফায়সালা করে আমরা বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনবো। যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আজকে নতুন করে আবার সেই বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য বলেছে আমাদের নেতা তারেক রহমান।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বলেছিলেন ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন, দেননি। বলেছেন ১০ টাকা সের চাল খাওয়াবে, তাও দেয়নি; তাহলে আপনাদেরকে নতুন কী দিয়েছে, দুর্ভিক্ষ। তাছাড়া কী দিয়েছে হামলা-মামলা। এতদিন তারা ঢোল পিটাইলেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। খালি উন্নয়ন, উন্নয়ন, উন্নয়ন, এই উন্নয়ন ছাড়া কিছুই দেখছে না বাংলাদেশে। এই উন্নয়নে ৪০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুকের সভাপতিত্বে সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, সরকার পথে পথে বাধা দিয়েছে। এত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে জনসমাবেশকে জনসমুদ্রে রূপ দিয়েছেন এই দেশের জনগণ। এটাই প্রমাণ করে বিএনপি’র প্রতি দেশের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কতোটা। এই সরকারকে বিদায় জানাতে হবে ভোটের মাধ্যমে। না হলে দেশের আর কিছু বাকি থাকবে না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি’র সমাবেশের জন্য গাড়ি, লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছে এই সরকার। তারপরেও নেতাকর্মীরা যেভাবে বরিশাল সমাবেশে উপস্থিত হয়েছে, এতে তারা বিপ্লব ঘটিয়েছে। গাড়ি ও লঞ্চ ব্যতীত বরিশালের মানুষ যে সমাবেশ সফল করতে পারে এটা প্রমাণ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের শত শত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, আগামী দিনে আমরা শত শত জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছি। মানুষ খেতে পারছে না, বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে বাস করছে, গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারছে না, মানুষের ভোটাধিকার নেই, দেশে আইনের শাসন নেই, বাকস্বাধীনতা নেই, ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চলছে।
গণসামবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, এডভোকেট জয়নুল আবেদিন, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ার, হাবিবুন নবী খান সোহেল, বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন প্রমুখ বক্তব্য দেন।