এক ক্যাপ্টেনের আর্তনাদ

আরেকটি খোলা চিঠি: পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর
ক্যাপ্টেন পদবীর একজন কর্মকর্তা। লিখাটি যেভাবে হাতে এসেছে ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করা হলো, কোন রকমের সংশোধন বা পরিমার্জন ছাড়াই।
আমার প্রিয় সহকর্মী- সিনিয়র, জুনিয়র ও কোর্সমেটগণ,
আজ এই মুহুর্তে দেশ যেই জায়গায় দাঁড়িয়েছে, আপনারা কি শুনতে পাচ্ছেন জনগনের কান্না?
কিভাবে মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো! কিভাবে লাশ গুম করা হলো – সব কিছুই কিন্তু ওই আসমানে লিপিবদ্ধ হচ্ছে। পারবেন সেদিন মহান আল্লাহ’র সামনে দাঁড়াতে? আজ আমাদেরকে অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে বলা হচ্ছে আমার দেশের মানুষের বিরুদ্ধেই কিনা গুলি করতে! অথচ সেই মানুষের টাকায় কেনা হয় এই অস্ত্র আর গোলাবারুদ এবং হয় আপনার আমার বেতন। কোন অধিকার বলে আমরা এমন করছি! ছিহ ছিহ!!!
আমরা সশস্ত্র বাহিনীর অফিসাররা পাসিং আউটের সময় শপথ নিয়েছি সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র নামে এই দেশ, জাতিকে রক্ষা করার জন্য; সেই আমরাই কিনা নিজেদের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। ভুলে যাবেন না সেই সব জাতির কথা যাদের আল্লাহ ধ্বংস করেছিলেন তাদের সীমালংঘনের কারনে।
আমার ধারনা আমাদের উর্ধতন কমান্ড চ্যানেলের কারোর সন্তানই এই দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়েনা- পড়লে তারা তাদের সন্তানদের প্রতি এই অবিচার দেখে হয় তাঁরা পদত্যাগ করতেন নয়তো আত্মহত্যা করতেন।
আমার নিজের ছোটবোনটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রবল ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে তাদের উপর আঘাত করতে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতিবিদ ও কিছু টোকাই। নাহ, আমার কলিজার টুকরা বোনটিকেও রেহায় দেয় নি। স্ট্যাম্প দিয়ে কোমরে সজোড়ে আঘাত করে। যেই বোনকে আমি কোনো দিন একটা গালি পর্যন্ত দেই নি, একটা আপেল কিনলেও যাকে আমি অর্ধেকটা দিয়েছি, বেতনের এক তৃতিয়াংশ যার হাত খরচের জন্য দিয়ে দেই- তাকেই কিনা আঘাত করেছে জানোয়ারেরা!
জানেন সায়ের ভাই, আমি এরপর থেকে আজ অব্দি ঠিকভাবে ঘুমাইনি।
বারবার চোখে ভেসে আসছে সেই বাঘের বাচ্চা আবু সাইদের কথা। ছেলেটি বেঁচে থাকলে তার বুকে আমি নিজের হাতে আমার বুকে থাকা প্যারা কমান্ডো ব্রেভেটটি পড়িয়ে দিতাম। কারন নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো পরশ পাথর নেই।
মনে পড়ে যায় “পানি লাগবে, পানি” বলে ডাকতে থাকা মুগ্ধর কথা, মনে পড়ে যায় পুলিশের গাড়ির উপর থেকে ফেলে দেওয়া সেই নিথর দেহটিকে। চোখে ভেসে ওঠে হাজারো মায়ের কান্না, ভায়ের রক্ত, বোনের ইজ্জতহানি, পিতার বুক ভাংগা কান্নার কথা।
আমি আর ইদানিং ঠিক থাকতে পারছি না। চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার।
আমরা না মানুষ ছিলাম! আমরা না ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা- দেশের তরে’ মূলমন্ত্রে বলীয়ান হয়েছিলাম!
মহান আল্লাহ সেই মানুষগুলোকে জান্নাত দান করুন, যারা বিগত কিছুদিনের যুলুমের শিকার হয়ে শাহাদাত বরন করেছেন। আমীন।
শেষে সবার প্রতি একান্তই অনুরোধ, জনগনের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হোন- মনে রাখবেন দুনিয়াতে কেউ যুলুম করে টিকে থাকতে পারেনি।
ইতি,
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক হতভাগ্য ক্যাপ্টেন যে নিজের বোনকে বাঁচাতে পারেনি জালিমের অত্যাচার হতে।
উৎস :  সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরের ফেসবুক পেজ