বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পররাষ্ট্রনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার আলোকে মন্ত্রণালয় পরিচালিত হবে।
গত ৫ বছরে কোনো জন্য কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়া দূরের কথা, উল্টো তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে দাবি করে ড. খলিল বলেন, পদোন্নতি ও পদায়নের নীতি পুরোপুরি লঙ্ঘন করে তাদের প্রাপ্যতার চেয়ে ভালো জায়গায় পোস্টিং দেয়া হয়েছে।
যার মধ্যে অত্যন্ত গোপনীয় সরকারি চিঠি মিডিয়া ও সরকারবিরোধী সাইবার সন্ত্রাসীদের কাছে ফাঁস করা কর্মকর্তাও রয়েছেন। নতুন মন্ত্রীর আমলে সব অনিয়মের মূলোৎপাটন আশা করে তিনি বলেন, এবার তার অবসান হবে এবং সবকিছু প্রচলিত নিয়ম-নীতির মধ্যে সম্পাদিত হবে বলে আশা করি। মন্ত্রণালয়কে কেউ যেন আর তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ড. খলিল তার নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাসে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ের অবতারণা করেছেন। যা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। কারণ কারও প্রতি সরাসরি অভিযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ না করে আলোচনার ক্ষেত্রটি তিনি উন্মুক্ত রেখেছেন। চাকরিতে নেই বা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়- এমন অনেকে পোস্টটি শেয়ার করেছেন, কমেন্ট করে প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। লেখাটি ভালো হয়েছে মর্মে লেখককে অভিনন্দনও জানানো হয়েছে। তবে একজন ইঙ্গিতপূর্ণ কমেন্ট করেছেন। তিনি লিখেন- ‘মানুষের লোভ, চাওয়া-পাওয়া অন্তহীন।’ সেগুনবাগিচার বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ড. খলিলের পোস্টটি তারা দেখেছেন। চাকরির কারণে তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে নিবৃত রয়েছেন।
মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘স্বাধীনতাবিরোধী ভূত’ থাকার মতো স্পর্শকাতর অভিযোগের বিষয়টি প্রায় সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এটাই কর্মকর্তাদের সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছে। এক কর্মকর্তা বলেন, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ধারাবাহিকতা রয়েছে। ঢালাও তদন্ত না হলেও পোস্টিং-পদায়নের আগে নানা পর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিষয়ে তদন্ত হয়। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্সি রয়েছে। সেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বাধীনতার বিরোধিতার মতো স্পর্শকাতর বিষয় থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরা পড়তো এবং অভিযুক্তদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। ২০০৯ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে ৩ দফা পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ডা. দীপু মনি, আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং সর্বশেষ ড. একে আব্দুল মোমেন দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রী বদল হলে অনেকে কারণে-অকারণে ফেসবুকে সরব হন এবং নতুন মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এমন মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ফেসবুকে প্রচারিত বার্তাটি নিশ্চয়ই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও গেছে। তারা বুঝবেন কেন ওই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক আজ চাকরি জীবনের সায়াহ্নে এসে এসব অভিযোগ তুলছেন? বিশেষ কোনো স্বার্থ হাসিলে এই স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে কিনা সেটাও নিশ্চয়ই সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনা করবেন।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন ড. খলিলুর রহমান। দায়িত্বগ্রহণের ১ বছরের মাথায় (২০২১ সালে) তার চাকরির পূর্বনির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলে সরকার ২ বছরের চুক্তিতে তাকে হাই কমিশনারের পদে বহাল রাখে। গত বছর সেটিও শেষ হলে দ্বিতীয় দফায় চুক্তি অর্থাৎ গত ৩১শে অক্টোবর থেকে ছয় মাসের জন্য তার চুক্তি নবায়ন করা হয়। সে হিসেবে আগামী এপ্রিলে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
নিজের রাজনীতি, মন্ত্রীর নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গ- ফেসবুক বার্তার সূচনাতে ড. খলিলুর রহমান লিখেন- “মাননীয় মন্ত্রী হাসান মাহমুদ স্যারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি পাওয়াতে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে আসা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্যাডারভুক্ত একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা হিসেবে স্যারের এই নিযুক্তি আমার কাছ অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের। সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতি করে আসা আর কেউ কখনই এই গুরুত্বপূর্ণ পদে এর পূর্বে নিযুক্তি পাননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। ছাত্রলীগের রাজনীতি শেষ করে ব্রাসেলসে পড়তে গিয়েও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্যার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। যদিও ২০০৯ সালেই স্যার এই পদে নিযুক্তি পেতে পারতেন, কিন্তু বর্তমান সময় সরকার ও দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সময়েই তাঁকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই পদে নিযুক্তি দিয়েছেন। পরিবেশ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি যেমন সফল ছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি ইনশাআল্লাহ তাঁর চেয়েও বেশি সফল হবেন।”
ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং…
ড. খলিল লিখেন- “২০০৯ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অল্প যে ক’দিন স্যার ছিলেন সে সময়েই স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় এক সন্ধ্যায় উনার ধানমণ্ডির ৫ নম্বর রোডের সরকারি বাসায়। এরপরে ২০১২ সালে আবার ব্যাংককে (তখন আমি UNESCAP এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি) এক প্রাতঃরাশ মিটিং-এ স্যারের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়। দুই সাক্ষাতেই পররাষ্ট্র বিষয়াবলী নিয়ে স্যারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। কানাডা আসার পর স্যারের সঙ্গে প্রায়ই যোগাযোগ হতো বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা জন্য। গত বছর জানুয়ারি মাসে আবারো উনার ঢাকার সরকারি বাসায় এক প্রাতঃরাশ মিটিংয়ে স্যারের সঙ্গে কানাডায় আমাদের বিশেষ কিছু কাজ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয়। বিশেষ কিছু সাহায্য ও পরামর্শ পাবার ব্যাপারে, যা মূলতঃ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে পাবার কথা ছিল। স্যার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসার পর এখন আর অন্য কোথাও যেতে হবে না। তাই কাজের দিক থেকে আমি মনে করি যে সাহায্য গত তিন বছর পাওয়া যায়নি তা এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই পাওয়া যাবে। গত সেপ্টেম্বর মাসে টরোন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বঙ্গবন্ধুর উপর Biopic এর সফল প্রিমিয়ারের সময় স্যারের সঙ্গে দুই মাস ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। এ উপলক্ষে টরোন্টোতে উনার পাঁচ দিন অবস্থানকালে আবারো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। ওই সময় দেখেছি কানাডার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন ও অমীমাংসিত বিষয়- বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত নেয়ার বিষয়ে তাঁর একনিষ্ঠ উদ্বেগের ও উদ্যোগের বিষয়টি। কানাডার সংসদ গ্রীষ্মকালীন বিরতিতে থাকা সত্ত্বেও আমরা কয়েকজন এমপি/সিনেটরের সঙ্গে তাদের বাসায় পর্যন্ত গিয়ে দেখা করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, আমি স্যারকে বলেছিলাম যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উনার মতো নেতৃত্ব দরকার। তাই স্যার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত খুশি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমে আমরা এখন আরও বেশি আশাবাদী হতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিকে আমরা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্রুত ফেরত নিয়ে খুনিদের সাজা কার্যকর করতে পারবো।”
মুক্তিযুদ্ধে তরুণ কূটনীতিকদের অবদানের কথা স্মরণ করে যা বললেন-
মহান মুক্তিযুদ্ধে তরুণ কূটনীতিকদের অবদানের কথা স্মরণ করে ড. খলিলুর রহমান ফেসবুক বার্তায় লিখেন- “স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিছু তরুণ কূটনীতিক, যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, এদের অন্যতম ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রদূত শিহাবউদ্দিন স্যার, বর্তমান মাননীয় অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী স্যার, রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী স্যার সহ অন্যরা। যারা পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে বিদেশে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেই ধারা অব্যাহত ছিল। ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ভূত চেপে বসে বিশেষ করে ’৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানি সরকারের চাকরিতে নিযুক্ত ছিল, তাদের মাধ্যমে। এই মন্ত্রণালয়ই খুনিদের ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে পাঠায়, এমনকি তাদের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই সময়েই পররাষ্ট্র ক্যাডার উন্মুক্ত করে অন্য ক্যাডার থেকে নিম্নমানের কর্মকর্তাদের আত্তীকরণ করা হয় এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারের ঐতিহ্য ও মানের সমূহ ক্ষতিসাধন করা হয়। যদিও ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ ২০ বছর ক্ষমতায় ছিল/আছে, তারপরেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মা পুরোপুরি দূর করা যায়নি বা হয়নি। বরং বলা যায় দিন দিন আরও চেপে বসছে। স্বাধীনতার পক্ষের বা স্বাধীনতার চেতনা ও মূলনীতিতে বিশ্বাসী কর্মকর্তাদেরকে নানাভাবে বঞ্চিত বা হয়রানি করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে।”
manabzamin