দিদারুল ভূঁইয়া : সারা দেশ অনেক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকদফা হরতাল ও অবরোধ পালনের পর এখন একটু ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে বিকল্প কর্মসূচি খুঁজছে। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মাঠের আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, এই মুহূর্তে সরকার এবং শাসনব্যবস্থা বদলের একদফা আদায়ে জনগণ এবং বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলনের বিপরীতে সরকার, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন ও কিছু দালাল রাজনৈতিক দল বেশ ব্যবধানে এগিয়ে আছে।
প্রশ্ন হলো শেখ হাসিনা সরকার কি আসলেই তার অধীনে নির্বাচন করতে পারবেন? সেটা ঠেকাতে কতোটা মূল্য বিরোধী দলগুলো এবং জনগণকে দিতে হবে? সেটা করতে সরকার ও সরকারী দলও কতোটা মূল্য দিতে প্রস্তুত? শেষরক্ষা করতে পারবেন কি? বিরোধী দলগুলো এবং জনগণের এ সময়ে করণীয় কী?
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নামের ভোট ছাড়া ‘সিলেকশন’ এবং ‘রাতের ভোট’ জনগণ এবং বিরোধী দলগুলোকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছে, প্রতারিত বোধ করিয়েছে। আজকে যে তরুণের বয়স ৩০, তাদের বেশির ভাগই এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন নাই। এ লজ্জা পুরো জাতির। এ ক্ষোভ এখনো এদেশের তরুণদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তাঁতিয়ে মারছে।
আশার কথা হলো- ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ধূর্তামির বিপরীতে বিরোধী দলগুলো পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও এবার তারা বেশ শক্ত করে কোমর বেঁধে নেমেছে। ২০২২ সালে প্রথমে গণতন্ত্র মঞ্চ প্রতিষ্ঠা এবং এরপর ৩৭ দলের সমন্বয়ে যুগপৎ আন্দোলন মানুষের মনে বেশ ভরসা তৈরি করেছে- এবার হয়তো একটা কিছু হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম সরকার পতনের আন্দোলনের একদফা দাবিতে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে শাসনব্যবস্থা বদলের দাবিও যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে গণতন্ত্র মঞ্চ এবং বিএনপি’র সমঝোতা এবং ৩৭ দলের সমন্বয়ে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা মানুষের আশার পালে বাড়তি হাওয়া জুগিয়েছে।
মানুষের এই আশা-ভরসার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ২৯শে অক্টোবরের হরতাল এবং ৩০ তারিখের অবরোধে। কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এত স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন আর হয়েছে কিনা, তা গবেষণার দাবিদার। এর আগেও সারা দেশে বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ ও অন্যান্য বিরোধী দলের সমাবেশ, রোডমার্চে জনগণের আগ্রহ-আশা-ভরসার প্রমাণ ছিল সুস্পষ্ট।
অবশ্য পরবর্তীতে সরকারের জেল, জুলুম, বন্দুক, হুমকির মুখে অথবা কোনো প্রলোভনে বড় বিরোধী দলগুলো রাজপথে সরব উপস্থিতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। বিএনপি ঘোষণা দিয়ে ‘গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন’-এর কৌশল নিয়েছে। এই কৌশল এরইমধ্যে তাদের নেতাকর্মী, জনগণ এবং অন্যান্য বিরোধী দলের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেÑ গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন করে মাফিয়া সরকারকে আসলেই কি উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে?
গ্রেপ্তার অবশ্য তাতে থেমে থাকেনি। বিরোধীদের অনেক নেতাকর্মী প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ইসরাইলি সার্ভেইল্যান্স প্রযুক্তি সজ্জিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে ফাঁকি দিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানো যে প্রায় অসম্ভব। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে তার পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
২৮শে অক্টোবরের সরকারি ক্র্যাকডাউনের পরও অন্তত ঢাকায় গণতন্ত্র মঞ্চ এবং অন্য কয়েকটি দল সক্রিয় রয়েছে। তাতে মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি দলের নেতাকর্মীরা সরকার ও সরকার দলীয় হামলা- মামলার শিকার হচ্ছেন, জেলের ঘানি টানছেন। বাড়িঘর, এলাকা ছাড়াও হয়েছেন অনেকে।
গ্রেপ্তারকৃতদের কাউকে কাউকে এবং এর বাইরেও অনেককে নির্বাচনে যেতে কোটি কোটি টাকার, বড় বড় পদের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। আমার কাছেও এমন প্রস্তাব এসেছিল। আমি ঘৃণাভরেই তা প্রত্যাখ্যান করেছি। সবাই সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারছেন না বা করছেন না। কাউকে কাউকে জেল-জুলুমের ভয়ও দেখানো হচ্ছে। আবার কেউ কেউ এইদিনের জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। এসবেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কয়েকদিন আগেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে শক্ত অবস্থানে ছিলেন এমন কোনো কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেবার ঘোষণার মধ্যদিয়ে; কোনো কোনো নেতার মুখ ঢেকে রেখে কিংবা ব্যান্ড বাজিয়ে বিভিন্ন কিংস পার্টির টিকিট কেনায়। অবশ্য এটা নিশ্চিত জানি, শেষ পর্যন্ত এদের সংখ্যা খুব কম হবে এবং এরা প্রত্যেকেই ইতিহাসের নিকৃষ্ট দালাল, বেইমান, মীরজাফর হিসেবে পরিচিত হবেন।
রাজবন্দিদের বিরুদ্ধে মামলার রায় রকেটগতিতে হচ্ছে। ১৮/২০ সালের মামলার রায়ও এখন দিয়ে দেয়া হচ্ছে। যদিও অরাজনৈতিক লক্ষ লক্ষ ফৌজদারি অপরাধের মামলা যুগের পর যুগ আটকে আছে। একেক দিন ৮০-১৫০ জনের কারাদণ্ডের খবর পত্রিকায় আসছে নিয়মিত। এ গতি আরও বাড়বে বলে দেয়া যায়। বিরোধী নেতাদের নির্বাচন করার অযোগ্য, বিরোধী দলগুলোকে নেতাকর্মী-শূন্য করতে চায় সরকার। সেই পরিকল্পনাতেই তারা আগাচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব সবসময় ছিল, আছে, অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশির ভাগ বিদেশি শক্তির অন্তত বিভিন্ন দৃশ্যমান উদ্যোগগুলো এদেশের জনগণের পক্ষে ছিল বলে জনগণ তাদের স্বাগত জানিয়েছে।
তবে বিদেশি শক্তিগুলোর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কিছু অতি উৎসাহীর কার্যকলাপ হিতে বিপরীত হয়েছে। এতই বিপরীত হয়েছে যে এখানে শয়তানি কিংবা সরকারি পরিকল্পনা থাকলে অবাক হবার কিছু নাই।
বেশির ভাগ বিদেশি শক্তির বিভিন্ন কার্যক্রমকে এত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এ অতি উৎসাহীরা প্রচার করেছেন যেন বিদেশিরাই সরকার পতন করে বিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন। বিরোধী দলগুলোসহ জনগণ বসে বসে আঙ্গুল চুষলেও অসুবিধা নাই। তারা এমনকি এটাও ভাবলেন না, ফ্যাসিস্ট সরকার ও ফ্যাসিজমকে রাজপথের সফল আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে হয়। তাহলে সরকার পতনের পর আন্দোলনের ফলাফল জনগণের পক্ষে থাকে, নচেৎ নয়। আমাদের দেশেই আমরা বহুবার দেখেছি জনগণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আন্দোলনের ফলাফল বেহাত হয়েছে। আর কোনো আন্দোলনের বেহাত ফলাফল বাংলাদেশ সইতে পারবে না।
এই অতি উৎসাহী কার্যক্রমের ফলাফল হাতেনাতে পেয়েছি আমরা। কোনো কোনো বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে ঠিক সর্বোচ্চ সাহস, শক্তি, সংকল্প নিয়ে এখনো অংশ নিচ্ছেন না। ঝুঁকি এড়িয়ে চলছেন, এমনকি আন্দোলনের ক্ষতি করে হলেও। এমনকি যখন ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে আন্দোলনের ক্ষতি করেও নিরাপদ থাকতে পারছেন না, তখনো।
সরকারের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্য, শক্তিশালী বিরোধী দলগুলোর গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলনের কৌশল, সোচ্চার ও সাহসী বিরোধী দলগুলোর যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি না থাকা বাংলাদেশকে মূলত বিদেশিদের যুদ্ধক্ষেত্র হতে ঠেলে দিচ্ছে। এমন কিছু হলে সেটা এ দেশের জনগণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে।
শুরুতে যে বলেছিলাম, আন্দোলনে এ মুহূর্তে সরকার এগিয়ে আছে। বিরোধী দলগুলো এবং জনগণ পিছিয়ে আছে। তাদের এখন কয়েকটা বাড়তি লাফ দিয়ে সরকারকে পেছনে ফেলতে হবে।
প্রথমত বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে কারও যদি জেলের ভয় থাকে, সেটা দূর করতে হবে। ইনফ্যাক্ট বাংলাদেশটাই একটা বড় জেল। সেখানে ছোট জেলে থাকলে খুব বেশি ক্ষতি বৃদ্ধি আসলে হয় না। কিন্তু জেলের ভয় আন্দোলনকে নৈতিকভাবে হারিয়ে দেয় অনেকাংশে। বিশেষ করে যেসব দলের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টায় রাজপথ থেকে দূরে থেকেও গ্রেপ্তার এড়াতে পারছেন না, তারা যদি সিদ্ধান্ত নেন, গ্রেপ্তার যদি হতেই হয় রাজপথ থেকেই হবো-এই একটা সিদ্ধান্তই আন্দোলনকে অনেকাংশে সফল করবে নিশ্চিত।
বিভিন্ন বিরোধী দলের যারা এখন গ্রেপ্তার হয়ে আছেন, জেল খাটছেন, তাদের পরিবারগুলো যদি একসঙ্গে রাজপথে নামতেন, সেটাও আন্দোলনকে একটা বিশাল বুস্ট এনে দিতে পারতো।
আরেকটা কর্মসূচি এখন আন্দোলনে বিশাল একটা এডভান্টেজ এনে দিতে পারে। সেটা হলো অসহযোগ। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে সেটা সফল হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেই মনে করি। আমি বিশ্বাস করি আমলা, পুলিশসহ প্রশাসনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে মরিয়া। কেবল একটু যোগাযোগ, একটা উদ্যোগ তাদের অনেককেই গণমানুষের পক্ষে আসতে সাহায্য করবে।
এই মুহূর্তে যে কর্মসূচি নিশ্চিতভাবেই আন্দোলন ১০০ ভাগ সফল করবে, সেটা হলো স্বেচ্ছায় কারাবরণ। যদি ৫শ নেতাকর্মীও ঘোষণা দেন স্বেচ্ছায় কারাবরণের, সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনের মোড় ঘুরতে বাধ্য। আন্দোলনের রাজনৈতিক বিজয় সেখানেই হয়ে যাবে। পরাজিত হবেন মাফিয়া সরকার ও মাফিয়াতন্ত্র। এমনকি সরকার তাৎক্ষণিক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্যও হতে পারেন।
খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার ও শাসনব্যবস্থা বদলের একদফা আন্দোলন ব্যর্থতার ঝুঁকিতে পড়েছে। কেবল সকল বিরোধী দল ও জনগণের সর্বাত্মক উদ্যোগই পারে আন্দোলনকে এ অবস্থা থেকে টেনে তুলে শতভাগ সফল করতে। এদেশের আপামর জনগণের যে আন্দোলনের শতভাগ সফলতা ছাড়া একদমই কোনো মুক্তি নাই।
লেখক: অর্থনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
মানব জমিন