একতরফা নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণের বিপদ

 

বদিউল আলম মজুমদার

 ২০১৪ সালে আমাদের যে নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সে নির্বাচনটি ছিল গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। সে জন্য এই সরকারের বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৪ সালে আমরা প্রতিবাদ করিনি; তখন আমাদের বোধেই আসেনি। যে সাংবিধানিক সংশোধনী তথা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনও টিকে আছে, তা অসাংবিধানিক। সেটা আমাদের বোধে ছিল না। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তা তুলে ধরতে পারেননি।

পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক হওয়ার বড় কারণ হলো, তখন আদালত সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছিলেন, সংসদ চাইলে দুটি নির্বাচন এ ব্যবস্থায় (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে) হতে পারে। তার মানে পঞ্চদশ সংশোধনী আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে পাস করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি হলো অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন। এটি অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধনী হওয়ার আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সুবাদে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক হলেও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময়ে তা করা হয়নি। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদ অসংশোধনযোগ্য করা হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করা সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক অধিকার, যা খর্ব করা যায় না। কিন্তু সেই মৌলিক অধিকারটিও খণ্ডন করার মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, ভবিষ্যতের সংসদের হাতে তেমন ক্ষমতাই থাকবে না। অর্থাৎ এক সংসদ ভবিষ্যৎ সংসদের হাত-পা একদম বেঁধে দিল। সংবিধান অনুসারে তা তারা করতে পারে না।

যে নির্বাচন কমিশন ১৫ নভেম্বর তপশিল ঘোষণা করল, তাদের তপশিল ঘোষণার নৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ এই নির্বাচন কমিশনই গঠিত হয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। আমি বিষয়টি নিয়ে আগেও অনেকবার বলেছি এবং লিখেছি। গত বছর একটা আইন হয়েছিল– প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২। এই আইনের অধীনে কেবল রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনকে নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যখন অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয় তখন এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারতেন, নিজের নামও প্রস্তাব করতে পারতেন। এটি সুস্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন। এই নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হলে, তাদের কার্যকলাপ আইনানুগ হয় কীভাবে?

আমাদের উদ্বেগের মূল বিষয় হলো ভোটাধিকার। এটি মানুষের অধিকার। ২০১৪ থেকে ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। এই অধিকারের জন্য মানুষ প্রতিবাদী হওয়া শুরু করেছে। মানুষের অধিকার হরণ করা যায় না। আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্যে দেখি, ফিলিস্তিনিদের অধিকার হরণের জন্য ইসরায়েল সব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা পারেনি। এখন আমরা দেখছি, পৃথিবীজুড়ে মানুষ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে। যারা এখন ‘একতরফা’, ‘সাজানো’, আমি বলি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের চেষ্টা করছে, তারা সঠিক পথে নেই। খুলনার নির্বাচনের পর আমি বলেছিলাম, খুলনা মডেল কিংবা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। যারা সেভাবে নির্বাচন করার চেষ্টা করছে, তারা জনগণের প্রতিপক্ষ। জনগণের এ অধিকারের বিপক্ষে তারা দাঁড়িয়েছে, সে জন্য তাদের পরাজয় অনিবার্য।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সর্বজনীন মানধিকারের ঘোষণায় যথার্থ নির্বাচনের কথা বলা আছে। আমরা পছন্দ করি আর না করি, বাংলাদেশে প্রধান দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এর একটিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হতে পারে না। ভোটাররা যদি শতভাগও আসেন, কিন্তু তাদের সামনে যদি বিকল্প না থাকে; তাহলে নির্বাচন হয় কীভাবে?

এ বছরের খুলনা সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের কথা বলছিলাম। তখন একটা বৈশিষ্ট্য ছিল– বিরোধী দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল না। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করে। বিরোধীরা প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেনি। এভাবে তারা নিজেদের জয় নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এভাবে জয়লাভের মাধ্যমে তারা কি শক্তিশালী হয়েছে? না, বরং দুর্বল হয়েছে। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে, কেবল নিয়ন্ত্রিত বা সাজানোই নয়; এখন হচ্ছে একতরফা নির্বাচন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত এবং অন্যদের ব্যবহার করে তারা একতরফা নির্বাচন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এতে তারা দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। এভাবে নির্বাচনের কারণে এখন বিদ্রোহ প্রার্থীরা সেই সুযোগ নিচ্ছে। এতে নিয়ন্ত্রিত একতরফা নির্বাচনও কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। কর্তাব্যক্তিদের সেদিকটাও ভেবে দেখা দরকার।

বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)