একটু-আধটু ঝগড়াঝাঁটি

Daily Nayadiganta


সারা দেশে এখন খুন, গুম, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ, ব্যাংক ডাকাতির ‘উৎসব’ চলছে। যারা যেখানে খুশি, যখন খুশি, যাকে খুশি নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, এসব অপরাধীকে খুঁজে বের করার তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সে খুন-খারাবি শুধু দলীয় লোকদের মধ্যে যে হচ্ছে, তেমন নয়; দলের বাইরেও নানা কারণে ঘটছে খুন-খারাবির ঘটনা। ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সেটা সরকারিভাবেও হয়ে যাচ্ছে।

এমন দুটি মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ঘটেছে চুয়াডাঙ্গায়। সেখানকার আলমডাঙ্গার দুই আসামি মোকিম ও ঝড়ু। তারা অত্যন্ত দরিদ্র। ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন এলাকার সাবেক মেম্বর মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় মনোয়ারের চাচাতো ভাই মোকিম, ঝড়ু ও আবুল কালাম আজাদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল মামলার বিচারে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড, দু’জনের যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদাতল-২। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু। আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ-রেফারেন্ড নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট বাকি আসামিদের খালাস দেন।

পরে মোকিম ও ঝড়ু ২০১৩ সালেই আপিল দায়ের করেন। মোকিমের পক্ষে আপিল মামলাটি তদারকির দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো: হুমায়ুন কবির। এর পরও দীর্ঘ আট বছর চলে গেছে।

সম্প্রতি আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চে শুনানির জন্য গত ৩ নভেম্বর দিন ধার্য ছিল। কিন্তু মামলার শুনানি হওয়ার আগেই জানা যায়, আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যায়। মোকিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে মোকিমের ফাঁসি কার্যকর করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। অপর আসামি ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়ে গেছে।

নিয়ম অনুযায়ী বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমতি প্রয়োজন হয়। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন হওয়ার পর তা কার্যকর করতে আরো কিছু প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলার কোনো পক্ষ যদি আপিল করে, সে ক্ষেত্রে নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে কারা কর্তৃপক্ষ সে অপেক্ষা করেনি। এই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এই দুই ব্যক্তি খুবই দরিদ্র। তাই তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা সেভাবে মামলার বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে পারেননি। সে সামর্থ্যও তাদের ছিল না। হতেও তো পারত, সে আপিল শুনানিতে তারা খালাস পেয়ে যেতেন যেভাবে খালাস পেয়েছেন তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ।

আপিল বিভাগের শুনানির আগেই এই দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এক ধরনের ‘হত্যাকাণ্ড’ই বটে। কিন্তু এর দায় কে নেবে?

এ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, যেকোনো মামলার আসামিকে সর্বোচ্চ দণ্ড দেয়ার আগে অন্তত ১০ বার চিন্তা করি। অ্যাটর্নি জেনারেল অবশ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পক্ষে যুক্তি দেখান। কিন্তু প্রধান বিচারপতি বলেন, এতে এই কোর্টের ওপর এক্সট্রা ব্লেইম আসে। এটা কোর্টের জন্য বিরাট বিব্রতকর। আমরা প্রত্যেকটা ফাঁসি দেয়ার আগে ভালো করে দেখি। তিনি বলেন, আমাদের এখানে এখনো সবকিছু ডিজিটাল হয়নি। ডিজিটাল হলে সঙ্গে সঙ্গে ডিটেক্ট করা যেত। কোন মামলার কোনটা থেকে কোনটা এসেছে। কিন্তু আমাদের এখানে তো ডিজিটাল হয়নি। সেটাই সমস্যা।

তেমনি ঘটনা ঘটল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে। এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান ইলেকশন হয়েছে দলীয় প্রতীকে আর মেম্বর ইলেকশন হয়েছে নির্দলীয় ভিত্তিতে। মেম্বর পদের জন্য যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। সরকার ইউপি নির্বাচনেও দলীয়করণ করার লক্ষ্যে সেখানে দলীয় প্রতীকের ব্যবস্থা করেছে। ফলে ধুমছে চলছে মনোনয়ন বাণিজ্য। এই বাণিজ্যে এক দিকে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন ছিলেন, অপর দিকে ছিলেন এমপিরা। তাদের দু’জনের দু’পক্ষ। এমপি চেয়েছেন মিস্টার এক্স মনোনয়ন পাবেন। আওয়ামী লীগ চেয়েছে মিস্টার ওয়াই মনোনয়ন পাবেন। ফলে দু’পক্ষেই মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে ব্যাপকভাবে। কোনো কোনো প্রভাবশালী মনোনয়ন পাইয়ে দেবেন বলে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা খেয়েছেন। কিন্তু এক পদে তো দু’জনের জন্য নৌকা মার্কা জোগাড় করা যায় না। ফলে কেউ বঞ্চিত হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে একে-৪৭ রাইফেলের ভয় দেখিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, আওয়ামী লীগে ভোট না দিলে সেখানকার মাটিতে তাদের ঠাঁই হবে না। এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, নৌকায় ভোট না দিলে লাশ পড়বে এবং এলাকায় কবরও দিতে দেয়া হবে না। আরো নানা রকম হুঙ্কার-ধমকি দিয়েছিলেন যা ছিল নির্বাচনী আচরণবিধির সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। কিন্তু না সরকার, না নির্বাচন কমিশন কাউকে কোনোরূপ ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

ফলে যা হবার তাই হয়েছে। নৌকার প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে এবার নতুন চিত্র দেখা গেছে, সেটি হলো বুথে নির্বাচনের ফল ঘোষণা না করা। যেখানেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরে যাচ্ছিলেন, সেখান থেকেই ব্যালটগুলো থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তা নিয়ে একাধিক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ কেন্দ্র ও থানা ঘেরাও করেছে। পুলিশ নির্বিচারে টিয়ার শেল, লাঠিচার্জ, গুলি চালিয়েছে। এটা ১৯৭৩ সালের নির্বাচনী সিনড্রোম। ওই বছর সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পাস করাতে কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার হেলিকপ্টারে করে জেলা সদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লক্ষণ ভালো নয়।

যাই হোক, নির্বাচনী হানাহানিতে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এতে খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই। তা সে নৌকার প্রার্থীই হোন বা বিদ্রোহী প্রার্থী। আওয়ামী লীগ আয়নায় মুখ দেখে না। যে খুন হয়েছে সেও আওয়ামী লীগ, যে খুন করেছে সেও আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ খুনোখুনিটা আওয়ামী লীগের মধ্যেই হয়েছে। মাঝে মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে হুঙ্কার দিতে শুনি যে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা। কিন্তু দৈনিক যুগান্তর খবর দিয়েছে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রথম স্থান তো দূরের কথা দ্বিতীয় স্থানেও নেই। অর্থাৎ জনভিত্তি না থাকায়, গুণ্ডামি, পাণ্ডামি, লুটপাট করায় আওয়ামী লীগকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। সমস্যা সেখানে নয়। আমরা যে সমস্যা আলোচনা করতে বসেছি, তা হলো এই যে, শতাধিক ব্যক্তি খুন হলেন তাদের মধ্যে বিএনপির কেউ নেই, কারণ বিএনপি নির্বাচনে অংশই নেয়নি।

সরকারি প্রচারযন্ত্রগুলো খুব করে বলার চেষ্টা করেছে যে, বিএনপি থেকে লোক গিয়ে আওয়ামী লীগের নমিনেশন নিয়েছে। কিন্তু দিলেন কেন? সেজন্য তো আর বিএনপির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়ী নয়। হয় মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন, নইলে দল ভারী করেছেন। আর বাস্তবতা হলো হেরে গেছেন।

কিন্তু এই শতাধিক পরিবারের পাশে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা মন্ত্রী গিয়ে দাঁড়াননি। তারাও তো আওয়ামী লীগারই। যেহেতু ভোটে মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রার্থীর সাথে তারা থাকেননি, তাই তারা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। কিন্তু তারা যদি আওয়ামী লীগার নাও হয়ে থাকেন তারা তো এ দেশেরই মানুষ। সরকার তাদের পাশে দাঁড়াবে না কেন? তাদের খুনিদের ধরার চেষ্টা করবে না কেন? কখনো করেনি, ধারণা করি, ভবিষ্যতেও করবে না।

আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো এই যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সংঘর্ষ পুরোপুরি এড়ানো যায় না। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাজ ঠিক মতো করেছে। এ ধরনের নির্বাচন আধিপত্যের নির্বাচন, গোষ্ঠীর মধ্যে নির্বাচন – এখানে একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়ই।’ শতাধিক ব্যক্তির প্রাণ গেল আর আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মনে হলো খুব স্বাভাবিক ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য আমার স্বদেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com