দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একই ভৌগোলিক রেখায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে একক মুদ্রা (কমন কারেন্সি) প্রচলনের মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এখনো তৈরি হয়নি। এই অবস্থায় দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে হবে। কমাতে হবে ব্যবসার খরচ। পাশাপাশি নিয়মিত পারস্পরিক পরামর্শ চালু করতে হবে। এর নেতৃত্ব দিতে হবে ভারতকে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সম্মেলনে ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও একক মুদ্রা প্রচলনের সম্ভাবনা’ শীর্ষক অধিবেশনে দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদেরা এমন অভিমত দিয়েছেন। ঢাকার একটি হোটেলে আজ শনিবার অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমানও একক মুদ্রা প্রচলনের বিষয়টি নাকচ করে দেন।
অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, একটি অঞ্চলের জন্য একক মুদ্রা প্রচলন করতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। এর মধ্যে অর্থের অবাধ চলাচল, সীমান্ত অতিক্রম করার স্বাধীনতা, ঝুঁকি সহনশীলতা, পারস্পরিক আস্থা, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন ইত্যাদি। একই ভৌগোলিক সীমায় অবস্থানের পরও প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা ভিন্ন। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতের মুদ্রা রুপি বেশ অস্থিতিশীল। তাই কোনো ব্যাংক রুপি কিনে রাখলে তাতে ঝুঁকি থাকতে পারে। এ ছাড়া সার্বভৌমত্ব ইস্যু বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা চালুর প্রেক্ষাপট এখনো তৈরি হয়নি।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। একক মুদ্রা বা কোনো দেশের মুদ্রাকে নীতিনির্ধারক ধরে চালকের আসনে বসানো যুক্তিযুক্ত হবে না। একক মুদ্রা ব্যবহারের মতো ইউনিয়ন গড়ে তোলার সময়ও হয়নি।
টাকা-রুপি ও চীনা মুদ্রায় লেনদেন চালু হলেও তাতে সাড়া মিলছে না জানিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ও চীনের বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতি আছে। এ জন্য মুদ্রা অদলবদলের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা প্রচলনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ মিলে ‘রুপা’ নামের মুদ্রার প্রচলন করতে চেয়েছিল। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। তিনি আরও বলেন, এখন যে পরিমাণ রুপি আয় আছে, রুপিতে শুধু সে পরিমাণ আমদানি করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আবিদ কাইয়ুম সুলেরি বলেন, ‘রাশিয়া, আফগানিস্তান ও চীনের সঙ্গে আমাদের নিজস্ব মুদ্রার লেনদেন হয়। একক মুদ্রার আশা না ছেড়ে আমাদের বিকল্প খোঁজ করা উচিত। যাতে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে।’
চ্যালেঞ্জ থাকলেও বসে না থেকে স্বল্প পরিসরে নতুন উদ্যোগ হিসেবে শুরু করার প্রস্তাব দেন স্থানীয় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যকে সামনে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য স্বল্প পরিসরে হলেও একক মুদ্রার প্রচলন হতে পারে। এর চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে দেশগুলোর আমদানি-রপ্তানি ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া একই ধরনের হওয়া।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতিটি দেশের পণ্য শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ডকুমেন্ট বা কাগুজে প্রমাণাদির সংখ্যাও ভিন্ন। এতে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় বেশি। একটি নির্দিষ্ট ছকে সবাই শুল্কায়ন করলে তা নিয়ে আপত্তি উঠলেও নিষ্পত্তি করা সহজ হয়। এটি সব দেশ চাইলেই পারে।
ভারত কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে না, এই প্রশ্ন তুলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, তাদের সঙ্গে ভিসা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যু আছে। রুপি-টাকা লেনদেন চালু হয়েছে, কিন্তু লেনদেন হচ্ছে না। এই লেনদেন চালু করতে হলে ভারতকে বড় অঙ্কের লাইন অব ক্রেডিট দিতে হবে। বড় ধরনের ঝুঁকি সামলাতে ভারতীয় ও বাংলাদেশি মুদ্রার অদলবদল (সোয়াপ) করতে হবে। এসব উদ্যোগে ভারতকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি উভয় দেশকে করনীতি পরিবর্তন করতে হবে। দুই দেশ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রানীতি নিয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে সভা করতে পারে। বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়েও এমন সভার প্রয়োজন আছে।
সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আসামের চেয়ে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কয়েক গুণ বেশি। ফলে এখন আর কেউ আসামে চলে যাবেন না।’
এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিসের মহাপরিচালক শচীন চতুর্বেদি বলেন, ডলারের বিকল্প লেনদেন চালু হলে খরচ কমবে। ধীরে ধীরে বৈশ্বিক বাজারে ডলারের লেনদেন কমছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে লেনদেনের ৯ শতাংশ ছিল ডলার-বহির্ভূত, যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবসা বাড়াতে খরচ কমাতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসার স্বার্থে নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রথম আলো