বিদেশী ঋণের সুদ হিসেবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৯ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এর প্রায় ৮৮ শতাংশ সুদ পরিশোধ হয়েছে শীর্ষ পাঁচ দেশ ও সংস্থার অনুকূলে। একক দেশ হিসেবে গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ করা হয়েছে রাশিয়াকে, যার পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের বিপরীতে এ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। দেশটির সঙ্গে স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটি চালুর আগেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য নেয়া ঋণের কিস্তি ও মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুদ পরিশোধ করা শুরু হয়েছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে।
ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ২৬ হাজার ৭৭৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। এর মধ্যে মূল ঋণের কিস্তি (আসল) ১৭ হাজার ৪০৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর সুদের পরিমাণ ৯ হাজার ৩৭১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ সময়ে শীর্ষ পাঁচ দেশ ও সংস্থার অনুকূলে মোট ২৩ হাজার ৫০৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা মোট পরিশোধিত ঋণের প্রায় ৮৮ শতাংশ।
এর মধ্যে একক দেশ হিসেবে রাশিয়াকে মোট পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪৪৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। পরিশোধিত এ অর্থের মধ্যে ঋণের আসলের পরিমাণ ১ হাজার ২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ২ হাজার ৪২০ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
রূপপুরের মূল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরুর আগেই একক দেশ হিসেবে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হয়ে উঠেছে রাশিয়া। এ বিষয়ে ইআরডির কর্মকর্তাদের ভাষ্য হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ শুরুর আগে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়েছিল। সেজন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। সেই ঋণের আসল ও সুদ এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের সুদও পরিশোধ শুরু হয়েছে। আর গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৭ সাল থেকে মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানেই বলা আছে রাশিয়া থেকে যে ঋণ আসবে, সেটি থেকেই সুদ পরিশোধ করা শুরু হয়ে যাবে। সবকিছু ঋণ চুক্তি অনুসারেই হচ্ছে।
রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশকে চাপে পড়তে হবে কিনা জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক পরিকল্পণামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ রেমিট্যান্সের খরা মিটে গেছে এবং এখন রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেশ ভালো। সামনে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে আরো রেমিট্যান্স আসবে। ফলে এ সময় আমরা ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে পারব। এরপর আবার চাপ আসবে, একটা লম্বা সময় রেমিট্যান্স কম আসবে। এক্ষেত্রে আমাদের মুন্সিয়ানা দেখিয়ে চলতে হবে। বর্তমানেও আমাদের চাপ আছে কিন্তু এতে সমস্যা হবে না বলেই আমার ধারণা।’
ঋণদাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি)। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির অনুকূলে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪০৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণের অর্থ প্রায় ৬ হাজার ৬১৪ কোটি ২৯ লাখ এবং সুদ ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনকে (আইডিএ) গত অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ৭৫৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণের অর্থ ৫ হাজার ৯৯ কোটি ৫৪ লাখ এবং সুদের পরিমাণ ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
সরকার গত অর্থবছরে চীনকে ২ হাজার ৪৫৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে মূল ঋণের কিস্তি ১ হাজার ৪১০ কোটি ১৭ লাখ ও সুদ ১ হাজার ৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। জাপান সরকারের সহযোগিতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অনুকূলে গত অর্থবছরে ১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল ঋণ ৯৯২ কোটি ৫৮ লাখ ও সুদ ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন এডিবি ও আইডিএর ঋণ পরিশোধ বেশি। এ চিত্রটি আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যেই পাল্টে যাবে। রাশিয়া এবং চীন থাকবে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে। এরই মধ্যে রূপপুরের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে আংশিকভাবে। স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। রূপপুর আমরা কেন নিয়েছি, কী কারণে নিয়েছি জানি না। কিন্তু এটা আমাদের গলার কাঁটা হয়ে থাকবে। হয়তো এটিকে বন্ধও করে দিতে হতে পারে। এ ধরনের আর দ্বিতীয় কোনো ভুল করা যাবে না। প্রকল্পটির যথাযথ ব্যবস্থাপনাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি পদ্মা রেলের প্রকল্পটিও আমাদের বড় ধরনের ভোগান্তির কারণ হবে। প্রকৃত অর্থেই এগুলো হলো সাদা হস্তী। এগুলো থেকে কোনো বিদেশী মুদ্রা আসবে না। কাজেই ঋণ পরিশোধের উৎস হবে রফতানি ও রেমিট্যান্স। আমাদের ব্রড বেজ রফতানি খাত নেই। এ খাতে বৈচিত্র্যও নেই। রেমিট্যান্সেও একই অবস্থা। এখনো দরিদ্র মানুষগুলোকেই পাঠিয়ে যাচ্ছি, যারা বিদেশী মুদ্রা পাঠাচ্ছে। ভবিষ্যৎ সমস্যা মোকাবেলায় প্রযুক্তি ও দক্ষতা কোনো ক্ষেত্রেই আমরা নিজেদের আপগ্রেড করছি না। ওই সময়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি আমাদের নেই।’
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়া বাংলাদেশকে মোট ১ হাজার ২২৮ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার ঋণ অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে ইআরডির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে শুধু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য। ইআরডির চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত ঋণ বাবদ রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় হয়েছে প্রায় ৬২৭ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
রাশিয়া সরকারের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। একটি হলো আন্তঃসরকার চুক্তি, অন্যটি আন্তঃসরকার ঋণচুক্তি। এর মধ্যে প্রথম দফায় ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে, যার পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার। এ ঋণ দিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করা হয়। এ ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। আরেকটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে, ২০১৬ সালে। এর আওতায় বাংলাদেশকে রাশিয়া ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ঋণ দিচ্ছে। এ ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ। এ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটের প্রতিটির সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। চলতি বছরেই রূপপুরের প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার কথা। প্রথম ইউনিটের জ্বালানি দেশে এসেছে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর। আর ২০২৫ সালের মধ্যেই দ্বিতীয় ইউনিট চালু হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
সামনের দিনগুলোয় ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালে রূপপুরের উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড গণনা শুরু হয়েছে ২০১৬ সালে। ২০২৬ সালে গ্রেস শেষ হচ্ছে, তারপর ২০২৭ সাল থেকে নতুন প্রিন্সিপাল পেমেন্ট যোগ হবে। স্বাভাবিকভাবেই ঋণ পরিশোধের বোঝা উল্লেখযোগ্য হারেই বাড়বে। আমাদের এখানে এডিবি, আইডিএর প্রাধান্য থাকার কারণে আমরা এখনো কনসেশনাল জোনে আছি। মোট বিদেশী ঋণের সিংহভাগই এখন এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের। এগুলো যেহেতু অনেক আগে নেয়া, সস্তায় নেয়া হয়েছিল, দীর্ঘমেয়াদি ছিল। এগুলোর চাপও আগামীতে বাড়বে। এদের ঋণের শেষের দিকে পরিশোধের পরিমাণ বেশি, কারণ অ্যামোরটাইজেশনের রেটটা বেশি। যে প্রকল্পগুলোর ঋণ আমরা ’৯০-তে নিয়েছি বা ২০১০-এ নিয়েছি, এগুলোর অ্যামোরটাইজেশন রেট আগামীতে বাড়ছে। এরপর আবার ব্যয়বহুল রূপপুর প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ বাধ্যবাধকতা বা কার্যভারগুলো এরই মধ্যে বহন শুরু হয়ে গেছে। এতে করে সমস্যাগুলো যতটা প্রকট হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি প্রকট যেন না হয় সেই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রূপপুর থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রবাহটাও যথাযথভাবে হতে হবে, উচ্চ প্রযুক্তির এ প্রকল্পে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেটিও দেখতে হবে। কারণ এটা ব্যবস্থাপনাও একটা চ্যালেঞ্জ। রূপপুরের বিদ্যুৎটা যেন গ্রহণযোগ্যভাবে জাতীয় গ্রিডে আসে, সে বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। এর জন্য যে ইউরেনিয়ামটা কিনতে হবে সেই আমদানি ব্যয়টাও বাড়বে। এগুলো মাইক্রোম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। কোনো ধরনের অবাস্তব চিন্তার ভিত্তিতে এত বড় চ্যালেঞ্জগুলোকে হ্যান্ডেল করা যাবে না। সমস্যা বেড়ে যায় এমন কোনো পদক্ষেপ যেন আমরা না নেই। যে কৌশলই আমরা গ্রহণ করি না কেন সেটা তথ্য-উপাত্তভিত্তিক হতে হবে। ডলারের প্রবাহ যদি অর্থনীতিতে যথেষ্ট থাকে, তাহলে ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। এক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, বাজেট, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বিনিময় হার প্রত্যেকটি বিষয়ে আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। বিদেশী ঋণ ও আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য ডলারের প্রবাহটা যেন যথেষ্ট স্থিতিশীল থাকে সেই দিকে নজর দিতে হবে।’
শীর্ষ পাঁচ সংস্থা ও দেশের বাইরে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (আইডিবি) ১ হাজার ২২৯ কোটি, ভারতকে ৬৯৯ কোটি ৮০ লাখ, এশীয় অবকাঠামো ও বিনিয়োগ ব্যাংককে (এআইআইবি) ৪৯১ কোটি ৯৭ লাখ, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টকে (ইফাদ) ২০১ কোটি ৭২ লাখ, দক্ষিণ কোরিয়াকে ১১৭ কোটি ৮১ লাখ, কুয়েতকে ১৭০ কোটি ২৭ লাখ, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টকে (ওএফআইডি) ২০৮ কোটি ৭০ লাখ, সৌদি আরবকে ১২৭ কোটি এবং এএফডি/ফ্রান্সকে ২৪৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।
Bonik Barta