এই লাখো–কোটি মানুষকে এখন কী জবাব দেবেন আপনারা

আমিনুল ইসলাম

রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ

দেশের শিক্ষার্থীরা বেশ কিছুদিন ধরে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। জগতের বেশির ভাগ দেশেই অনগ্রসর মানুষদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য কোটার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেটা সহনীয় পর্যায়ে। সেখানে মেধারও মূল্যায়ন হয়। দেশের শিক্ষার্থীরা ঠিক সে জায়গাতেই আন্দোলন করছেন।

তাঁরা কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের কথা বলছেন। যাতে মেধার সঠিক প্রয়োগ তাঁরা করতে পারেন চাকরির ক্ষেত্রে। তাঁদের হয়তো মনে হয়েছে, চাকরির ক্ষেত্রে একধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে। যে বৈষম্যের কারণে তাঁরা হয়তো মেধার ভিত্তিতে চাকরিটা পাচ্ছেন না।

কোটা নিয়ে ২০১৮ সালে একবার আন্দোলন হয়েছিল। সে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনেও নিয়েছিল। এরপর আদালতের একটি সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব। যদিও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁরাও কোটা সংস্কারের পক্ষেই রয়েছেন। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে যে সরকার এই বিষয়ে আদৌ আন্তরিক কি না!

এ কারণে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতে পৃথিবীর যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে এমনটি আশা করাই যায়। কিন্তু আমরা কী দেখলাম?

আমরা দেখলাম, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে উল্টো আন্দোলনকে দমন করার একধরনের হার্ডলাইনে গিয়েছে। সরকারের অনুগত ছাত্রবাহিনী ও পুলিশ মিলে ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুরো দেশবাসী লাইভে দেখল রংপুরে পুলিশের গুলিতে কীভাবে একজন ছাত্র মারা গেল। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।

বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে ভাষণ আন্দোলনকারীদের শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। ফলে আন্দোলনকারীরা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। আজ বৃহস্পতিবার তাঁরা কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

আজ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকাসহ দেশজুড়ে অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। ঢাকা শহরসহ গোটা দেশের অনেক জায়গায় সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন নিহতের ঘটনার খবর দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো। আহত হয়েছেন অনেকে।

এর আগে ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ নামের যে ছেলেটিকে গুলি করে মারা হলো, তিনি হয়তো স্বাধীন দেশের পুলিশ বাহিনীকে বিশ্বাস করেছিলেন। তাই হয়তো বুক পেতে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবার সামনে ছিলেন।

কিন্তু তাঁর বুকটা ঝাঁজরা করে দিল একটি স্বাধীন দেশের পুলিশ। গুলিগুলো যেন সাঈদের বুকে নয়, এসে লেগেছে দেশের লাখো, কোটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের বুকে। এই লাখো, কোটি মানুষকে এখন কী জবাব দেবেন আপনারা? কেন সাঈদের বুক এভাবে ঝাঁজরা করা হলো? তাঁর অপরাধটা কী ছিল?

তিনি তো নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করছিলেন। তিনি তো কোনো ব্যক্তিস্বার্থের জন্য আন্দোলন করছিলেন না।

এই দেশের শতকোটি টাকা মেরে দিয়ে এনবিআরের মতিউর রহমান বুক চিতিয়ে এই জনপদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। না তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, না তাঁকে কোনো হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কোটিপতি বনে যাওয়া আবেদ আলীরা এই জনপদে নিশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁদের সন্তানেরা নিজেদের দানবীর-জনদরদি প্রচার করে গেছেন।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর এই দেশের সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করছেন। এঁরা হয়তো দূর থেকে সাঈদকে দেখে উপহাস করে বলছেন, দেখলে তো তোমাকে মরতে হয়েছে। আমরা দিব্যি আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি।

গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান সাঈদ পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছেন। ক্লাস এইটেও বৃত্তি পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করছিলেন। এই মেধাবী ছাত্রকে নিশ্চয় চাকরি পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হতো না। এরপরও তিনি আন্দোলনে গিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে।

সাঈদের বুক হয়তো ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোটি মানুষের বুকে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে, সে ক্ষোভ কি আপনারা দমন করতে পারবেন? ক্যাম্পাসে পুলিশ, বিজিবি নামিয়ে ছাত্রদের মনে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে; সেই ক্ষোভ কি দূর করতে পারবেন? ইতিহাস থেকে আপনারা কি কোনো শিক্ষা নেননি?

পাকিস্তানি আর্মি কি পেরেছিল? এরশাদ কি পেরেছিল? সমস্যা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিতে চায় না। ক্ষমতার দম্ভ পেয়ে বসেছে আপনাদের। প্রজন্মের ভাষা আপনারা বুঝতে পারছেন না। এই ছেলেমেয়েগুলো একসময় বড় হবে। দেশের বড় বড় জায়গায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। তাঁরা কি এক জীবনে এ ঘটনা ভুলতে পারবে?
তাঁরা কি আদৌ পারবে আপনাদের আর বিশ্বাস করতে?

সাইদ তো বিশ্বাস করে বুক পেতে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসের বলি হতে হয়েছে তাঁকে। এরপর আর কেউ আপনাদের বিশ্বাস করতে চাইবে? কী করে আপনারা একটা পুরো প্রজন্মের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবেন?

পুলিশ নামিয়ে দিয়ে ছাত্র হত্যা করার যে জঘন্যতম অপরাধ আপনারা এর মধ্যেই করে বসেছেন; সে অপরাধের দায় একদিন না একদিন আপনাদের মেটাতেই হবে। এই দায় থেকে আপনারা কোনো দিনও মুক্তি পাবেন না। এ অপরাধ আপনাদের কুরে কুরে খাবে।

প্রজন্ম দেখছে এই দেশে মতিউর, আবেদ আলী ও বেনজীরদের অভয়ারণ্য। যেখানে সাঈদদের মতো বীরদের মরতে হয়। এই প্রজন্মই হয়তো একদিন সিদ্ধান্ত নেবে—এই দেশ কি বীরদের হবে, নাকি মতিউর, আবেদ আলী ও বেনজীরদের মতো কাপুরুষদের!

  • ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]