এই নিষ্ঠুরতার হেতু কি?

Daily Nayadiganta

এই নিষ্ঠুরতার হেতু কি? – নয়া দিগন্ত

এক বড় ভাই একটি গল্প বলেছিলেন। তিনি এর ভালো রেফারেন্স আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। গল্পটি একটি বানর ও তার বাচ্চা নিয়ে। বানরের উচ্চবুদ্ধিমত্তা সবার জানা। মানুষের পর যদি প্রাণিজগতে আর কারো নাম নিতে হয়, তাহলে বানরের নামটি আসে সবার আগে। ঘটনাটি ছিল একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের। বানরটি ছিল বাচ্চাসমেত একটি বাড়িতে খাঁচায় বন্দী।

বাড়িতে আগুন লাগার পরপরই বানরটি টের পেয়েছিল। সে জানত, আগুন শেষ পর্যন্ত তার খাঁচাটিও পুড়িয়ে দেবে। সে নিজের বাচ্চার নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তাকে কিভাবে বাঁচানো যায় সেটাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। বাচ্চাটিকে নিয়ে সে বিভিন্ন ধরনের কসরত করতে লাগল। একবার কোলে তুলে নেয়, একবার মাথায় নেয়। আগুন যতই কাছাকাছি আসছিল, এ নিয়ে তার উৎকণ্ঠাও বাড়ছিল। কারণ তার বাচ্চাটিকে বাঁচাতে হবে।

Ad by Valueimpression

তার চেঁচামেচি ভাব ভাষায় এ সময় কেবল বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেয়েছিল। ঠিক আগুন যখন খাঁচার নিচ দিয়ে হানা দিলো, মুহূর্তের মধ্যে বাচ্চাটিকে সে মাথায় তুলে নিলো। আগুন যখন সত্যি সত্যি খাঁচার নিচের অংশটি পুড়ে ফেলছিল, তখন আগুনের কঠিন উত্তাপে তার পা-ও ঝলসে যাচ্ছিল। এ ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে বানরটি নিজের মাথার ওপর থেকে বাচ্চাটিকে নিচে ছুড়ে ফেলে দিলো। বাচ্চাকে পায়ের নিচে দিয়ে আসন্ন উত্তাপ থেকে নিজের পা বাঁচাতে চাইল। নিজেকে রক্ষার জন্য সামান্য একটি অবলম্বন হিসেবে বাচ্চাটির শরীরকে ব্যবহার করল।

প্রথম থেকে বানরটি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেনি। নিজে মরে গিয়ে হলেও বাচ্চার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ভেবেছে। প্রকৃত বাস্তবতা যখন সামনে এলো- সব ভুলে আসন্ন বিপদ মোকাবেলা করতে চাইল। সেখানে নিজের বাচ্চার প্রতি মায়া-মমতা আর মূল্য পায়নি। বাচ্চাটিকেই আসন্ন ব্যথা উপশমের জন্য ব্যবহার করেছে। পায়ের নিচে ফেলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্বস্তি পেতে চেয়েছে। বানরটির ঠিক এ চেহারাটি আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি। সঙ্কটের ভয়াবহতা তাকে এমন নিষ্ঠুর করতে বাধ্য করেছে। প্রকৃতপক্ষে এমন বিপদে পড়ে কেউ কি তার অস্তিত্বের বিনিময়ে অন্যকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়ার জন্য আত্মবলিদান করতে পারে?

মানুষের ক্ষেত্রে এর একটি সম্পর্ক কি রয়েছে? বলা হয়- বিপদে বন্ধুর পরিচয়। সঙ্কটে এলে সে তার মূল চরিত্রে স্বচেহারায় প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে করোনার মতো ভয়াবহ বিপদ মানুষের সামনে আসায় মানুষকে নতুন করে চেনা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে রক্ত, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো এখন যাচাই হয়ে যাচ্ছে। আগুনের মতো কঠিন দহনের কষ্ট ছাড়াই মানুষ অন্যের প্রতি ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করছে।

করোনায় ইউরোপের করুণ অবস্থার কথা আমরা জানি। সেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আক্রান্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। হাসপাতালগুলো রোগীদের জায়গা দিতে পারছে না। কিন্তু কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেখবর কিংবা অন্যের অবহেলার পাত্র হয়ে মারা যাচ্ছে এমনটি ঘটছে না। এখনো জানা যাচ্ছে, কেউ বিপদগ্রস্ত হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হচ্ছে। এটা উন্নত ইউরোপের একটা ভালো নজির। কল্যাণরাষ্ট্র বলতে যা বোঝায় তা তারা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে গেছে। এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা। পরিবার ও নিকটাত্মীয়রা সে ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হলেও রাষ্ট্র কিন্তু সেই ভূমিকা পালন করছে।

আমাদের দেশে পরিবার প্রথা অটুট রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর ভেঙে পড়া পরিবারিক বন্ধনের বিপরীতে আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গভীর জোড়ালাগা সম্পর্ক আমাদের অহঙ্কার। আমরা যারা সবসময় মা-বাবা-সন্তানদের নিরাপত্তার কথা বলি, তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সব কিছু সেক্রিফাইস করি, তারা আসলে কেমন মানুষ সেটা পরীক্ষার জন্য এ ধরনের কঠিন সঙ্কট একটি উৎকৃষ্ট সময়। এ ব্যাপারটা এখন যাচাই করার সময় এসেছে। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের বিশ্বাস- মানুষের কষ্ট লাঘবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যথেষ্ট আন্তরিক নয়। তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। তবে আমরা নিজেরা কি নিজেদের প্রতি সুবিচার করতে পারছি?

ফরিদপুরের মধুখালীতে এক ব্যক্তি রাস্তার পাশে সারা দিন পড়ে ছিলেন। সারা দিন রাস্তায় তিনি কাতরাতে থাকেন। তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। প্রশাসনের লোকেরা যতক্ষণে এসে তাকে হাসপাতালে নিতে গেলেন, ততক্ষণে তিনি মারা যান। অন্য একটি ঘটনায়- এক আত্মীয়কে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন একজন। ডাক্তার তার করোনা সন্দেহে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলে ওই আত্মীয়কে ফেলে ওই ব্যক্তি পালিয়ে যান। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের এমন নিষ্ঠুর আচরণের অসংখ্য খবর এখন চারদিকে।

আমরা দেখলাম, লাশ বহন করার জন্য খাটিয়া দেয়া হয়নি। এর দ্বারা কিভাবে ওই সমাজের মানুষর উপকৃত হলো। খাটিয়া দিয়ে তো জীবিত মানুষকে বহন করা হয় না। লাশ বহনের পর খাটিয়াটি এমনিতেই ধোয়া হয়। এবার না হয় জীবাণুনাশক দিয়ে সেটিকে ধোয়া হতো। একইভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এই সন্দেহে আমাদেরই আশপাশের মানুষগুলোর সাথে পৈশাচিক আচরণ করা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে কবরস্থ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা করতে এসেছে এমন অসুস্থ রোগীকে সন্ত্রাসী কায়দায় আক্রমণ করে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। অনেকে অসুখের উপসর্গ নিয়ে বাড়িঘরে ঢুকছে। একদিকে আশপাশের মানুষের ভয়, অন্যদিকে প্রশাসনের ভয়। আমাদের নিজেদের বেলায় ধারণা হচ্ছে- আমরা নিজেরা পূতপবিত্র। করোনা যাদের ধরছে তারা অভিশপ্ত!

হঠাৎ করে আমাদের সব যেন বদলে গেল। আমরা যেন এক ভিন্ন মানুষ হয়ে গেলাম। করোনা একটি উচ্চ ছোঁয়াচে ভাইরাস। একজন করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অন্যরা আক্রান্ত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, একজন করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তি থাকলেই আশপাশের সবাই আক্রান্ত হয়ে যাবে। আমরা দেখেছি, সবচেয়ে নিরাপদ থাকা ব্যক্তিরা এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরা সর্বোচ্চ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন। তাদের আশপাশে বাইরের কোনো সদস্য সংস্পর্শে আসতে পারে না। আমরা দেখলাম- রানী ও প্রিন্স আক্রান্ত হয়েছেন। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখতে পারার কারণে তিনি আক্রান্ত হয়ে যাবেন এমনটা ভাবাও যায় না। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী কিভাবে আক্রান্ত হলেন। আরো অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন তারা সামাজিক দূরত্ব কিংবা অস্বাস্থ্যকর মেলামেশার কারণে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছেন বলা যাবে না। আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি, সবচেয়ে অরক্ষিত বাসাবাড়ির মানুষ সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থেকেও এখনো আক্রান্ত হয়নি। কোভিড-১৯ এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সবাই আতঙ্কিত। কিন্তু এই আতঙ্ক যেন আমাদের মানবিক আচরণ করতে ভুলিয়ে না দেয়।
[email protected]