ঋণ নিয়ে ভাবনা-বসে থাকা আর না

  • খন্দকার হাসনাত করিম
  •  ০১ আগস্ট ২০২২, ১৯:৫১
ঋণ-নিয়ে-ভাবনা-বসে-থাকা-আর-না – প্রতীকী ছবি

বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ কেবল বেড়েই চলেছে। সরকারের বিশটি মেগা-প্রকল্পে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থের দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশী ঋণ। এসব উচ্চাভিলাষী অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ ইতোমধ্যেই ৫০% হয়ে গেছে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫% এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ১২%। ২০১০ থেকে বড় প্রকল্পে কাজ শুরু হলেও অনেক বড় প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪-২০১৮ সালের মধ্যে, অর্থাৎ বিশটি বড় প্রকল্পের তেরোটিই এসেছে এই পাঁচ বছরের মধ্যে। ২০১৮ সালের পর হাতে নেয়া প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়, এগুলোর রিটার্নও অনিশ্চিত। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগছে, ব্যয়ও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হবে এই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারটি। জিডিপির অনুপাতে দেনা পরিশোধ ১% হলেও ২০২৬ সাল নাগাদ তা হবে ২% এরও বেশি। সেই পর্যন্ত যদি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আশানুরূপ না থাকে তাহলে ধার শোধ করতে বাংলাদেশকে দিশাহারা হয়ে পড়তে হবে।

মূল ঋণের হাত ধরে বেড়ে চলেছে ঋণের সুদ। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে বিদেশী ঋণ ছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে ঋণ দাঁড়ায় ৭৮.০৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে দেখা যাচ্ছে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভশীলতা বেড়েই চলেছে। দেশের মোট উপার্জনের বেশির ভাগ যদি ধার পরিশোধেই ব্যয় হয়ে যায় তাহলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নীতিনির্ধারণীরা বিদেশী ঋণের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘সন্তোষজনক’ পর্যায়ে থেকেছে। কিন্তু এখন সে অবস্থায় নেই। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখন ৩৯ বিলিয়ন ডলারেরও কম। বিদেশী ঋণ উৎসের দেশে প্রচলিত মুদ্রায় হিসাব করা হয় এবং সেই মুদ্রাতেই ঋণ পরিশোধ করার কথা।

এ ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবনতি তথা টাকার বিনিময় হারে অস্থিরতা বৈদেশিক ঋণ দায়কে আরো ব্যাপক করে তুলবে। বাংলাদেশকে তাই তার বিদেশী ঋণের সঠিক এবং যথাযথ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নাই। ঋণ অর্থের যথার্থ ব্যবহার এবং দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনায় ঋণের অর্থ তামিল করতে পারলে ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা এড়ানো সম্ভব হবে বলে অর্থনীতিবিদদের দৃঢ় বিশ্বাস। এই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি বলেই ঋণের অর্থ শ্রীলঙ্কার গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেনা দায় যে কত বড় দায় বাংলাদেশ তা বুঝতে পারবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কালে অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ সাল নাগাদ। বড় প্রকল্পের স্বপ্নপূরণের আনন্দে এখন আমরা যতই মাতোয়ারা হই না কেন, দেনা পরিশোধকার্যক্রম শুরু হলে বোঝা যাবে দায় পূরণের কষ্ট কতখানি। তখনই শুরু হবে আনন্দের ‘অস্বস্তিকর’ অবস্থায় পরিণত হওয়ার জ্বালা। কারণ এমন অনেক প্রকল্প আছে যেগুলোর বাস্তবায়নে উচ্চ ব্যয়ের কারণে দেনাদায়ও বেড়েছে। আগে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান সরকার কম সুদে ঋণ দিতো। সেই সুযোগ কমে অসায় সরকার উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছে। ওই প্রকল্পগুলো কবে নাগাদ ‘ব্রেক ইভেন’ পর্যায়ে যাবে, তারও কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। ফলে সরকারের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশী সব ঋণ বেড়েছে, যার ‘রিটার্ন’ কতটা হবে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

সরকারের গৃহীত ঋণ গোটা ‘জিডিপি’র ২.৫%, যা ২০১৩ থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত কেবল বেড়েই চলেছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন। অতীতেও দেখা গেছে নির্বাচনের বছরের আগের বছর কিংবা পরের বছর সরকারের ঋণপ্রবণতা বাড়ে। চলমান প্রকল্পগুলো শেষ করতে এই ঋণ আরো বাড়বে কিনা, বা বাড়লে কতটা বাড়বে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ দেশে মোট বিদেশী ঋণে গোটা গড় মাথাপিছু সরকারি দেনা ৪৩২ ডলার। এই দায়দেনা পরিশোধ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক ‘পারফরম্যান্স’ সন্তোষজনক ছিল এই দাবি করা যাবে না। এর ফলেই প্রতি বছর বাজেট ঘাটতি মোকাবেলা করতে হয়।

ঋণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থির বিনিয়োগ হার, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এবং প্রকল্পগুলো থেকে উপার্জন তথা এগুলোর অর্থনৈতিক ‘ভায়াবিলিটি’ এখনো অনির্ধারিত বা অনির্দিষ্ট। ঋণ দায়ভার এতটা ব্যাপক হওয়ার পরও সরকার সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে নতুন করে ১,৭২০ কোটি টাকা ঋণ করেছে, যে উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হলো বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগের বহর বাড়ানো। বাংলাদেশের ’পার্সপেক্টিভ প্ল্যান’ ২০২১-২০৪১-এ উল্লিখিত অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় ঘাটতি পূরণ এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন লক্ষ্যমাত্রার সাথে এই নতুন উদ্যোগ সরাসরি সম্পৃক্ত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণ ১৮ বছরে পরিশোধিতব্য। উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের জন্য উচ্চ ঝুঁকির এই ঋণদায় নিশ্চয়ই সরকারের বিবেচনায় আছে। তবে ঋণ দায়ে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার বাস্তবতায় মানুষের উদ্বেগ অকারণ নয়।

এই উদ্বেগে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সরকারের ঋণ আবেদন। দৃশ্যত আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্যতার চাপ সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ‘আইএমএফ’ এর কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ধার চেয়েছে সরকার। ১৭ জুলাই (২০২২) ঢাকায় সংস্থার এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের মধ্যে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। সংস্থার আঞ্চলিক অফিস থেকে আর একটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই ঢাকায় আসবে। ওই সফরে ঋণশর্ত চূড়ান্ত হবে।

এখন কথা হলো- সেই শর্তাবলি বিবেচনা করাই লাগবে যা দেশের স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। শর্তের মধ্যে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের কথা উঠতেই পারে। উঠতে পারে সরকারি ভর্তুকি কামানোর কথা। ভর্তুতি কমালে অর্থনীতির ওপর নতুন যে চাপ পড়বে সেটা ভালো করে তাদেরকে বুঝাতে হবে। অতীতের ঋণ শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থানুক‚লে ছিল, এমন দাবি করা যাবে না। নতুন বাস্তবতায় আরো কঠিন শর্ত বিবেচনাযোগ্য না হলে সরকারের উচিত হবে সাফ সাফ তাদেরকে জানিয়ে দেয়া। এমনিতেই ‘করোনা’ ও ‘ইউক্রেন যুদ্ধের’ ধকল আমরা নিতে পারছি না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, খাদ্যশস্য প্রভৃতি আমদানিতে কমে আসা বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। মজুদ প্রায় অর্ধেকে কমে এসে ৪০ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। ঠিক মতো এবং যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি।